হোম > সাহিত্য সাময়িকী > প্রবন্ধ

বই কীভাবে বিপ্লবকে প্রভাবিত করে?

নুর আহমদ

বই শুধু তথ্যবহুল মাধ্যম নয়; সামাজিক ধারণা, নৈতিক গঠন, ঐতিহাসিক স্মৃতি ও রাজনৈতিক ধারণাকে গঠন করে এবং এই গঠিত জ্ঞান সংগ্রহই বিভিন্ন ইতিহাসে বিপ্লবী মুহূর্তগুলোর সূচনা, গতিশীলতা ও পরিণামকে প্রভাবিত করেছে (Abrams & Dunn, 2017; Owens, 2017; Allinson, 2019)। আধুনিক বিপ্লবতত্ত্ব এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বই ও লেখনীচর্চা আন্দোলনের চিন্তা-চেতনা-বোধ প্রভাবিত করে; এটি কেবল একক নেতৃত্বের কাজ নয়, বরং বৃহৎ সামাজিক-সামাজিক বল ও বৌদ্ধিক পরিবেশের মধ্যস্থতামূলক কার্যকলাপও বটে (Abrams & Dunn, 2017; Maskey, 2023)।

বই, ইতিহাস ও বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা

ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে হান্না অ্যারেন্টের মতো বিশিষ্ট মানুষেরা দেখিয়েছেন, ইতিহাসের ব্যাখ্যা ও স্মৃতি রচনার ধরন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক কাজকে আকার ও আকৃতি প্রদান করে। অ্যারেন্টে তার পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কীভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার মিশ্রণ নিখুঁত রাজনৈতিক পাঠ তৈরিতে সহায়ক হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়, বই শুধু তত্ত্ব নয়—এর পঠন ও প্রাসঙ্গিকতা আন্দোলনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত, আদর্শগত লক্ষ্য এবং জনবিশ্বাসকে পরিবর্তন করতে পারে (Owens, 2017; Allinson, 2019)।

বই আইডিয়ার বাহক

বহু আধুনিক আন্দোলন, তা সমাজতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী বা ধর্মীয় যা-ই হোক—তাদের মূল ধারণা বিভিন্ন বই বা গ্রন্থ থেকেই নিয়েছে। মার্কসবাদ থেকে চীন-স্টাইল আধুনিকীকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন তত্ত্ব লেখনীর মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে এবং রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের কল্পনাকে প্রভাবিত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে সাহিত্য ও তাত্ত্বিক গ্রন্থগুলোই নতুন রাজনৈতিক কল্পনা, রাষ্ট্র-সংক্রান্ত মূলধারা বা গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার ভাষা সরবরাহ করেছে, যা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে অনুবর্তীভাবে ফ্রেম ও উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে।

নৈতিক-সাংগঠনিক ফ্রেম এবং সাহিত্যিক অনুশীলন

সামাজিক আন্দোলন অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ‘ফ্রেমিং’, যেটি সংস্কৃতি ও নৈতিক ভাষা ব্যবহার করে স্বীকৃতি, ধারণা ও অনুপ্রেরণা গড়ে তোলে। নৈতিক-সাংগঠনিক দৃষ্টিকোণে বই ও সাহিত্যিক পাঠ্য আন্দোলনকারীদের আত্ম-আচরণ ও নৈতিক পুনঃপরিকল্পনায় সহায়তা করে এবং আন্দোলনকে ‘জীবন্ত জীববৈচিত্র্য’ হিসেবে নানা সামাজিক আবেগ ও অনুশীলনে যুক্ত করে। ধর্মীয় মর্মবাণীমূলক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, যেমন ইঙ্গিতাত্মক ব্যাখ্যা বা পুনর্নির্বাচন লেখ্যসম্ভার ভিন্ন ভিন্ন আশা, ভয়ের কথা বা মুক্তির বিমূর্ত কল্পনা প্রদান করে। এগুলো আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও সময়সূচি নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

ধর্মীয় গ্রন্থ ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা : ঐতিহ্য, সহনশীলতা ও বিভাজন

ধর্মীয়-তাত্ত্বিক গ্রন্থ এবং তাদের ব্যাখ্যা রাজনীতি ও সেক্টরীয় সংঘাতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মরছি এ-সংক্রান্ত ইতিহাসগত উপস্থাপনায় দেখিয়েছেন, কীভাবে ধর্মীয় ব্যাখ্যা-সম্পর্কিত গ্রন্থগুলো একটি গোষ্ঠীর ধ্যানধারণা ও সাম্প্রদায়িক অবস্থান পরিবর্তন করে। একই সঙ্গে ধর্মীয় গ্রন্থ ও তার আধুনিক ব্যাখ্যা রাজনৈতিকভাবে তাদের আশাবাদী বা হিংসাত্মক আচরণের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলে। এটি ভালো ও খারাপ উভয় আচরণকে উসকে দিতে পারে। এমন তথ্যও ধর্মতাত্ত্বিক ও সামাজিক বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

স্মৃতি, দলিলীকরণ ও স্থানীয় ন্যারেটিভের ভূমিকা

বই ও গ্রন্থভিত্তিক দলিল—বিশেষত মৌখিক ইতিহাস, স্থানীয় সাংবাদিকতা ও আন্দোলন-নির্ভর লেখা—যেকোনো বিপ্লবকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কীভাবে উপস্থাপন করবে, তা নির্ধারণ করে। ইরানিয়ান কুর্দিস্তানের গবেষণায় দেখা যায়, মৌখিক ইতিহাস, সংবাদপত্র ও স্থানীয় গ্রন্থ সংগ্রহ আন্দোলনের অংশগ্রহণ, নারীবাদের পুনরুজ্জীবন এবং অস্ত্র পরিচালনার ইতিহাস সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বইয়ের পৃষ্ঠায় যে স্মৃতি লিপিবদ্ধ হয়, তা সমাজের মানুষের মধ্যে মুক্তির মনন তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যেখানে বই ও প্রকাশনা একটি অঞ্চলের মানুষকে প্রতিরোধী হিসেবে গড়ে তোলে। এছাড়া বই ও প্রকাশনা স্থানীয় সমাজের আত্মপরিচয়, নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধারণ করে সেই সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

বই, ভয়চক্র ও আন্দোলনের সাফল্য-বিফলতা

আধুনিক আন্দোলনগুলো কেন ক্রমাগত ব্যর্থ বা সীমিত ফলাফল দেয়—তার মধ্যে ‘ভয়চক্র’ একটি ব্যাখ্যা প্রদান করে। যেখানে জনগণের প্রতিক্রিয়া, আন্দোলন পরিচালনার ব্যর্থতার আশঙ্কা এবং অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তা মিলিত হয়ে সমগ্র পরিবর্তন-প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করে। এ প্রেক্ষিতে বই ও স্থানীয় প্রকাশনা দ্বারাই বিকল্প ভবিষ্যৎ, নীতি-রূপরেখা ও সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা গেলে ভয়ের চক্র দূরীভূত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

সাহিত্যে বিদ্রোহ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর

বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এবং কবিতার বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে বিভিন্ন শিল্পী তাদের শিল্পের বিভিন্ন রূপান্তরের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আধুনিক পার্সিয়ান কবিতার গবেষণায় দেখা যায়, কাব্যিক আঙ্গিক ও রূপগত অভাবনীয়তা ১৯০০-১৯৬০ সময়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিল। এ ধরনের নানাবিধ আর্কিটেকচার আন্দোলনের ধারণাগত ভিত্তিকে বদলে দিয়েছে। কবিতা, নাটক ও গল্পযাত্রা মানুষের অভিজ্ঞতাকে রূপ দিতে এবং আন্দোলনের প্রতীকী ভাষা তৈরি করতে সক্ষম এবং এভাবেই সাহিত্য রাজনৈতিক কৌশল ও জনসমর্থনের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে তোলে।

লিঙ্গ, গ্রন্থ ও ঘটনাবলির উপস্থাপন

বিপ্লব ও সংঘাতের সময় নারীর ভূমিকা ও নারীর দেহ কীভাবে রাজনৈতিক নির্মাণের অংশ হয়—এই বিষয়টিও সাহিত্য ও ইতিহাস-লেখার মধ্যেই প্রস্থাপিত হয়। মেক্সিকোর এক শতাব্দীর যুদ্ধবিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, নারীদেহ কখনো লক্ষ্য, কখনো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের ন্যারেটিভ মানচিত্র রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও সংগ্রাম-কৌশলকে প্রভাবিত করে। তদুপরি, মুসলিম বিশ্বে নারী অধ্যয়নের প্রকাশনা বৃদ্ধির বিশ্লেষণ দেখায়, নারী বিষয়ের গ্রন্থসম্ভার ও গবেষণা আন্দোলনকে লিঙ্গ-আধারিত প্রকাশ্যতায় ও ন্যায়বিচারের দাবিতে শক্তিশালী করতে পারে।

ডিজিটাল যুগে বই : বিভক্তি ও অংশীদারিত্বের চিত্র

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বই ও পাঠ্যবস্তুর ভোক্তা-আচরণ রাজনৈতিক অর্থনীতি ও গোচারণকে প্রভাবিত করে। অনলাইনে বই কেনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাঠ্যচয়নও পার্টাইজান প্রেক্ষাপট অনুসরণ করে। অর্থাৎ অনলাইন ক্রয়-নিশ্চিতকরণ অনেক ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত রাজনৈতিক মতামতকে আবারও শক্ত করে তুলতে পারে (Shi et al., 2017)। সচেতনভাবে বহুমুখী পাঠ্য ও অনুবাদ প্রচার না করলে বই প্ল্যাটফর্মও গণতান্ত্রিক বিতর্কের বদলে ধূসর বা ভিন্নমতকে সংকুচিত করে দিতে পারে। এমন সম্ভাব্যতা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে (Shi et al., 2017)।

শহর, নাগরিক সমাজ ও প্রকাশনার স্থানীয় ভূমিকা

স্থানীয় সরকার, নাগরিক সংগঠন ও শহুরে সামাজিক তত্ত্ব এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউরোপীয় শহরগুলোর উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, শহরের নীতি-নির্ধারণে স্থানীয় প্রকাশনা, সিভিল সোসাইটি ও বোধোদ্দীপক গ্রন্থসংগ্রহ শহরীয় মুক্তি-আন্দোলনকে সহায়তা করেছে। ফলে বই ও স্থানীয় প্রকাশনা-আলোচনা শহরভিত্তিক রাজনৈতিক চাহিদা, নাগরিক অধিকার ও আন্দোলনের কৌশলকে সফলতায় পৌঁছে দেয়। এটি একটি অঞ্চলের স্থানীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতেও কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে

বিশ্বজুড়ে ধারণাগত, সাহিত্যিক ও ধর্মীয় গ্রন্থের বৈপ্লবিক প্রভাব বিশ্লেষণ থেকে যেসব শিক্ষা নেওয়া যায়, তা বাংলাদেশেও প্রাসঙ্গিক—(ক) বহুমুখী, অনূদিত ও স্থানীয় ইতিহাস প্রকাশে বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ স্থানীয় মূল্যবোধ ও স্মৃতি আন্দোলনের ধারাকে শক্তিশালী করে। (খ) নারীবিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনা বাড়ানো, যা লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়ের দাবি ও অংশগ্রহণকে বাড়ায়। (গ) পাঠ্যবস্তুর পরিবর্তনশীল ও সমালোচনামূলক পাঠক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এতে ভয়চক্র মোকাবিলায় কৌশলগত ভাবনা তৈরি করা যায়। (ঘ) ডিজিটাল ভোক্তা-আচরণকে বিবেচনায় রেখে বহুভাষিক, বৈচিত্র্যময় পাঠ্য পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ অনলাইন বই-ভোক্তা চয়নকে বিভাজিতকরণ নয়, সংলাপে পরিণত করা জরুরি। উপরোক্ত প্রস্তাবনাগুলো গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত এবং আন্তর্জাতিক তুলনামূলক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।

বিপ্লবের ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং গণতান্ত্রিক কপিকালচারের অংশ

সংক্ষেপে বলা যায়, বই কেবল তথ্যের মাধ্যম নয়। বই আদর্শ, আশা, ভীতি, নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক ভাষা গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ইতিহাসবোধ ও তত্ত্বগত ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে স্থানীয় স্মৃতি-সংগ্রহ, লিঙ্গচর্চা ও আধুনিক ডিজিটাল ভোক্তাভিত্তিক বিভাজন—সব ক্ষেত্রেই বই বিপ্লবের আকার, সুযোগ ও সীমা নির্ধারণে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। অতএব বাংলাদেশের পাঠক-সংস্কৃতি, প্রকাশনা-নীতি ও নাগরিক শিক্ষা যদি বহুমুখী ও সমালোচনামূলক হয়, তাহলে বই শুধু বিপ্লবের প্রেরণা হবে না; বরং তা সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক ও দায়িত্বশীল সামাজিক পরিবর্তনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে।

কবিরা যা বলেন

পতাকা

৭০ বছর পূর্তি: বাংলা একাডেমির ভবিষ্যৎ

কবি আবদুল কুদ্দুস ফরিদীর ইন্তেকাল

তাইরান : সাহিত্যের চেয়ে বেশি

৩৬ জুলাই ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব ও বাঙালি মুসলিম ফিউচারিটি (শেষ পর্ব)

জুতো

সামাজিক ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের উপাখ্যান

খারাপ বই নিয়ে কথা বলা ভালো বইগুলোর মতোই আকর্ষণীয়

উপন্যাস : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ