রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে দীর্ঘ ৯ মাস মতৈক্যে পৌঁছার চেষ্টা করেও অনেকটা মতপার্থক্য রেখেই বিদায় নিচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বাস্তবায়ন পদ্ধতির একাধিক বিকল্পসহ চূড়ান্ত প্রস্তাব সরকারের হাতে তুলে দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার কাজের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টেনেছে কমিশন। সাংবিধানিক আদেশ কে জারি করবেন- রাষ্ট্রপতি, না প্রধান উপদেষ্টা, তা নিয়েও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি। ভিন্ন মত আছে গণভোটের সময় নিয়েও। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গণভোট কখন হবে, তা নির্ধারণের এখতিয়ার এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের।
উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি নিয়েও ভিন্ন অবস্থানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান হওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগসহ বেশকিছু মৌলিক সংস্কার ইস্যুতে বিএনপির আছে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধানের প্রস্তাবিত সংস্কারে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংস্কারগুলো সংবিধানে সংযুক্ত হবে বলে প্রস্তাব করেছে কমিশন। এ ব্যাপারেও ঘোর আপত্তি আছে জাতীয়তাবাদী দলটির। আগামী সংসদকে একইসঙ্গে সাংবিধানিক পরিষদের ভূমিকা পালনের বিষয়েও সম্মত নয় দলটি। এভাবে কমিশনের ৮৫টি সুপারিশের মধ্যে অধিকাংশের ব্যাপারে দলগুলো একমত হলেও মৌলিক প্রস্তাবে মতভিন্নতা আছে।
গতকাল যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ হস্তান্তর করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ।
দফায় দফায় আলোচনা, বিতর্ক, অসন্তোষের পর ঐকমত্য কমিশন গতকাল
গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের জন্য আদেশ দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ দিয়েছে। পরে সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ বলেন, আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার কথাও সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি। এই আদেশ জারির পর থেকে যে কোনোদিন গণভোট করতে পারবে। তবে কবে করবে, সে সিদ্ধান্ত সরকার নেবে।
তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তনের জন্য আমরা সাংবিধানিক ক্ষমতা হিসেবে জনগণের ক্ষমতা যেন ব্যবহৃত হয়-সেজন্য এ প্রস্তাব করেছি। আমরা আশা করি এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা অর্জন করা যাবে।’
গতকাল বিকালে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেন, কমিশন সুপারিশের মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে অনৈক্য তৈরির চেষ্টা করেছে। এ জন্য তাদের ‘ধন্যবাদ’।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের বৈঠকের পর গুলশানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিন হবে, এর বাইরে যাওয়ার ‘কোনো সুযোগ নেই’। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট বিষয়ে বিএনপি ‘একমত’ নয়।
জামায়াত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশের বিষয়ে আজ বুধবার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে। তবে গতকাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে করা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই যারা বলছেন, তারা ‘আলটিমেটলি’ জুলাই সনদ অকার্যকর করার জন্য অপরিণামদর্শী সর্বনাশের পথে হাঁটছে। এটা থেকে বিরত থাকা উচিত। যারা জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট চায়, তাদের খারাপ উদ্দেশ্য জাতি বুঝে গেছে।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম রাজশাহীর একটি হোটেলে সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সতর্ক করে বলেন, ক্ষমতার লোভে কোনো দল বা কোনো শক্তি যদি মনে করে তারা এককভাবে সবকিছু করবে, এই জাতীয় ঐক্য ভেঙে দেবে বা জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়াবে, তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে। তারা সংসদ টেকাতে পারবে না। সরকার টেকাতে তাদের কষ্ট হবে। জনগণের যে আস্থা, সেই আস্থা তারা পাবে না।
জুলাই সনদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান খুবই স্পষ্ট উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম আরো বলেন, জুলাই সনদ যেদিন স্বাক্ষর হয়, সেদিনই আমরা স্পষ্ট করেছি; বলেছি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। কেবলই কাগজে সই। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থ্যানের পরও ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা দেখেছিলাম। যেটা মূলত ছিল জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এর পুনরাবৃত্তি আমরা আর বাংলাদেশে হতে দেব না। এ কারণে আমরা এখনো সনদে স্বাক্ষর করিনি।
ভোটের দিন বা আগে গণভোট
জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে তিন ভাগে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথমে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি, আদেশের প্রশ্নে গণভোট আয়োজন এবং সবশেষে আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকার (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) ক্ষমতা দিয়ে প্রস্তাবগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সংলাপে ঐকমত্য হওয়া সনদের ৮৫টি প্রস্তারের মধ্যে ৯টি নির্বাহী আদেশে, ২৮টি অধ্যাদেশে এবং সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাব সংবিধান সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কথা আছে। এর মধ্যে প্রথম দুই ভাগের বিষয়গুলো দ্রুত বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর শেষভাগের প্রস্তাবগুলোর জন্য দুটি বিকল্প উপায় রাখা এবং গণভোটে জনগণের বৈধতা নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।
সুপারিশে অন্তর্বর্তী সরকারকে আদেশ জারি করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি এখন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যে কোনো একদিন গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। এতে গণভোটের দিনক্ষণের সিদ্ধান্তও এই সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো। সংসদের প্রথম ৯ মাসে (২৭০ দিন) সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংস্কার শেষ করতে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা আছে সুপারিশে।
আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে সরকারকে তিন ভাগে সুপারিশ করা হয়েছে। যেসব বিষয় সংবিধান-সংশ্লিষ্ট নয়, তা সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে এবং সুপারিশের অনেক বিষয় আছে, যা অফিস আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এসব বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের কোনো মতভিন্নতাও নেই। এ দুটি বিষয় অধ্যাদেশ এবং অফিস আদেশের মাধ্যমে অবিলম্বে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করেছে কমিশন। কোন কোন বিষয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে এবং কোন কোন বিষয় অফিস আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে, তা সুনির্দিষ্ট করে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবিধান-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে আইনি ভিত্তি প্রদান এবং বাস্তবায়নের পথ নির্দেশ করার জন্য সংবিধান-সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয়ের ব্যাপারে দুটি বিকল্প প্রস্তাব সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাব দুটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সনদে থাকা সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো কার্যকর করতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ জারি করবে।
আদেশ এবং এর তফসিলে উল্লিখিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবগুলো গণভোটে দেওয়া হবে। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠনিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যা সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে গঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। জাতীয় সংসদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথাও বলা হয়েছে।
এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে দেবে। গণভোটে অনুমোদন পাওয়া সংবিধান সংস্কার বিল পরিষদের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে এবং পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। অন্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে এবং সংস্কার কার্যক্রম শেষ হলে পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হবে।
বিকল্প দুই প্রস্তাবে গণভোটের দিনক্ষণ ঠিক করা সরকারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সুপারিশে বলা হয়েছে—জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর থেকে জাতীয় নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যেকোনো দিন গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, আদেশ জারির পর থেকে যে কোনো দিন বা জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করতে পারবে। তবে কবে করবেÑসে সিদ্ধান্ত সরকার নেবে। সরকারকে বলেছি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য। জনগণ গণভোটে সনদ প্রত্যাখ্যান করবে না বলে আমরা আশাবাদী।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি ভোটের দিন গণভোট চেয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি ভোটের আগেই গণভোট চেয়েছে।
দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর জুলাই সনদ প্রণয়ন ও তাতে সই করলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। তবে আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ অনুযায়ীই সংবিধান সংস্কার পরিষদকে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। সেক্ষেত্রে চাইলেও আগামী জাতীয় সংসদ তাদের ইচ্ছামতো সংবিধানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন করতে পারবে না। কেন পারবে নাÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মৌলিক সংস্কার করা হবে, এ বিবেচনায় গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের গাইড করবে জুলাই জাতীয় সনদ। গাঠনিক ক্ষমতা মানে এই নয় যে, যা খুশি তাই লেখা যাবে।
সংবিধান সংস্কার পরিষদে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তারা তাদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা আপত্তি অনুযায়ী সংস্কার করতে পারবে কি নাÑজানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, গণভোটের প্রস্তাবটি এসেছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার আলোচনায়, যেখানে প্রস্তাব ছিল সবকিছুই জনগণের কাছে নেওয়ার। জনগণ যদি রায় দেয়, তাহলে রাজনৈতিক দল তার ভূমিকা নির্ধারণ করবে। কমিশন মনে করে, কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের রায় পাওয়া জিনিসকে কেবল নিজস্ব দলীয় অবস্থান থেকে বিবেচনা করবে না।
গণভোটে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো পাস না হলে কী হবেÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গণভোটে পাস না হওয়ার মানে হলো জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। গণভোটে পাস না হলে বুঝতে হবে জনগণ তা গ্রহণ করছে না।
আদেশ জারির ভিত্তি হিসেবে দুটি প্রস্তাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে। জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন। সেজন্য গণভোট, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন ও পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার অপরিহার্য।
বিকল্প প্রস্তাব-১-এ বলা হয়েছে, গণভোটের আগে জনগণকে জানাতে এবং সংবিধানিক পরিষদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে জাতীয় সনদের অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের প্রস্তুত করা খসড়া বিল গণভোটে দেওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ৪৮টি প্রস্তাব বিল আকারে করতে হবে। সেখানে গণভোটের প্রশ্ন হবে ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এতে সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কারসম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবগুলোর সমর্থন করছেন?’ গণভোট করতে নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করতে বলা হয়েছে।
গণভোটের ফলাফল ইতিবাচক হলে আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দ্বৈত ভূমিকা পালন করবেন। তারা নিয়মিত সংসদ সদস্যের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদের দায়িত্ব পালন করবেন। এক্ষেত্রে তারা একই অনুষ্ঠানে প্রথমে এমপি এবং পরে সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন, যারা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা পাবেন এবং প্রথম অধিবেশন থেকে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হলে সংবিধান সংস্কার বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত হবে এবং সংবিধান সংস্কার আইন রূপে কার্যকর হবে। স্পিকারই পরিষদের সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান সংস্কার কার্যকরের ৪৫ দিনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।
বিকল্প প্রস্তাব-২-এ খসড়া বিলের কথা বলা নেই। সেক্ষেত্রে গণভোটের প্রশ্ন থাকবেÑ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং তাতে সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন করেন?’ এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়া হলেও প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার শেষ করবে এবং এরপর পরিষদের কার্যক্রম শেষ হবে। বাকি ধারাগুলো একই আছে।
জুলাই জাতীয় সনদে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির (নোট অব ডিসেন্ট) কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে সেটি রাখা হয়নি। দলগুলোর দেওয়া আপত্তি নিয়ে কী হবেÑজানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, তারা সরকারকে বলেছেন এগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যেতে। জনগণের রায় পাওয়ার পর রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত নেবে। কমিশন ৪৮ বিষয়ে জনগণের সম্মতি-অসম্মতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
সংবিধানসম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑসংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ, ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশন নিয়োগ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ, দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগ।
অধ্যাদেশ জারির জন্য ২৮ প্রস্তাবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑনির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, বিচারক ও সাবেক বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, তিনটি সরকারি কর্ম কমিশন গঠন, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের চর্চা বন্ধ করা, জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ, দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের করণীয়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর সংশোধন।
নির্বাহী আদেশে জুলাই সনদের ৯টি প্রস্তাব বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে, যার মধ্যে অন্যতমÑউপজেলাপর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ, আদালত ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও ডিজিটাইজ করা, আইনজীবীদের আচরণবিধি, গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠন।
রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন উপায়ের সুপারিশ কমিশন তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, বিশেষজ্ঞদের মতামত, আমাদের কমিশনের সম্মানিত সদস্যদের অভিজ্ঞতা এবং আন্তরিকতার প্রেক্ষাপটে আমরা সুপারিশগুলো তৈরি করেছি। এই সুপারিশ স্কুলের লক্ষ্য জুলাই জাতীয় সনদ যেন একটি আইনি ভিত্তি পায়। ভবিষ্যতের পথরেখা হিসেবে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো যেন বাস্তবায়ন হয়।
সব দলের জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, যারা স্বাক্ষর করেনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। এনসিপির সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে, হচ্ছে। আশা করি এনসিপি স্বাক্ষর করবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেনÑকমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
গত ১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি দল ও জোটকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ২৫টি দল অংশ নেয়। এর মধ্যে ২৪টি দল ওই দিন সনদে স্বাক্ষর করলেও গণফোরাম দুদিন পর সই করে। সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা না দেখে স্বাক্ষর না করার কথা জানায় গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এছাড়া সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদÑএ চারটি বাম দলও তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে সনদে সই না করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। তবে কমিশন আশা করছে, শেষ পর্যন্ত সব দলই সনদে সই করবে।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, যারা স্বাক্ষর করেনি, তাদের সঙ্গে কমিশনের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রয়েছে। তারা যেন স্বাক্ষর করে, সে অনুরোধ প্রকাশ্য ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগে করা হয়েছে। এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলÑআদেশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া জানলে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে। কমিশন আশা করে, তারা তা দেখবে, বিবেচনা করবে এবং স্বাক্ষর করবে। কমিশনের মেয়াদ আরো তিনদিন আছে। কমিশন আশা করে, এই মেয়াদের মধ্যেই তারা স্বাক্ষর করবে।