দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কিংবদন্তি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক নজর দেখার জন্য শনিবার রাতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়েছিলাম। চিকিৎসাধীন অবস্থায় এর আগে দুবার তাকে হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি। তখন অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন ছাড়াও মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন ও অধ্যাপক ডা. আফম সিদ্দিকী ছিলেন। কিন্তু এবার হাসপাতালের সাত তলায় গিয়ে চিকিৎসকদের পেলাম না। সেখান থেকে বলা হলো চিকিৎসকরা নিচের চারতলায় সিসিইউতে খালেদা জিয়ার কাছে রয়েছেন। চারতলায় সিসিইউতে এসে অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা হলো। কিন্তু সিসিইউর ভেতরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই এবং মনে হলো যাওয়া উচিতও নয়। একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে জানলাম, খালেদা জিয়ার অবস্থা এখন আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন। এ কথা শুনতে পেয়ে ভালো লাগল।
ফুসফুসের সংক্রমণ থেকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। এরপর দেখা দেয় নিউমোনিয়া। এর সঙ্গে কিডনি, লিভার, আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসের পুরোনো সমস্যা তো আছেই। ফলে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। একটি রোগের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আরেকটির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাই চিকিৎসকরা খুব সতর্কতার সঙ্গে তাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। গত বুধবার থেকে তিনদিন প্রায় সাড়াহীন ছিলেন খালেদা জিয়া। শনিবার সামান্য কথা বলেছেন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমানের সঙ্গে। তবে তার শারীরিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও সামগ্রিক সংকট কাটেনি। যতটুকু জানা গেছে, কিডনির কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ডায়ালাইসিস করতে হয়েছে। তার চিকিৎসাটি চলছে দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের একটি সমন্বিত প্রচেষ্টায়। মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য আবার বিদেশে নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে তার শারীরিক অবস্থা বিমান যাত্রার ধকল সামলানোর জন্য কতটা সক্ষম, তার ওপর নির্ভর করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে তাকে লন্ডন ক্লিনিক কিংবা সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হতে পারে। ইতোমধ্যে ওইসব হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
এভারকেয়ার হাসপাতালের চারতলার সিসিইউর সামনে যখন বসেছিলাম, তখন বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল খালেদা জিয়ার মুখখানি। ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার সান্নিধ্যে থেকে সরাসরি কাজ করার আমার সুযোগ হয়েছে। ওই সময়ের কিছু কিছু ঘটনা ও স্মৃতি মনে হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে খাল খনন নিয়ে একটি পর্যালোচনা বৈঠকে তিনি সভাপতিত্ব করছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী ও বিএনপির মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার বৈঠকে ছিলেন। বিভিন্ন বৈঠকে বক্তৃতার সময় উদাহরণ হিসেবে সাইফুর রহমান মৌলভীবাজার এবং সালাম তালুকদার সরিষাবাড়ীর কথা বলতেন। এ দুটি জায়গায় তাদের গ্রামের বাড়ি। খাল খননবিষয়ক বৈঠকেও এই দুই জায়গার নাম তারা বললেন। খালেদা জিয়া হেসে হেসে বললেন, আচ্ছা আপনারা কি দেশের অন্য কোনো জেলা-উপজেলায় যান না? প্রায়ই শুনি মৌলভীবাজার এবং সরিষাবাড়ীর কথা। আপনারা তো কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলোর কথাও আনতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর এ কথায় সবাই হাসলেন। একই বৈঠকে তৎকালীন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী লুৎফুর রহমান আজাদ খাল খনন বিষয়ে বলতে গিয়ে বলছিলেন, ম্যাডাম এই সময়ে তো ‘কামলা’ পাওয়া যায় না। সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়া অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, আজাদ আপনি একি শব্দ ব্যবহার করলেন। ‘কামলা’ শব্দটা তো একটি গালির পর্যায়ে পড়ে। তাদের শ্রমজীবী মানুষ বলতে পারেন না?
একবার কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার কার্যালয়ে এসেছিলেন। সাক্ষাতের কিছুক্ষণ আগে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডাকলেন। আমি যেতেই বললেন, হুমায়ূন আহমেদ আমার সঙ্গে দেখা করবে। তিনি তো অনেক বড় মাপের লেখক। আমি তার বেশ কিছু বই পড়েছি, নাটকও দেখেছি। খুব সুন্দর লেখেন। তার সম্পর্কে একটি ব্রিফ আমাকে দাও, যাতে ওনার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আমি ফোন করি সালেহ চৌধুরী ভাইকে। সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী হূমায়ুন আহমেদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সালেহ ভাই দৈনিক বাংলার ফিচার সম্পাদক এবং আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদ এ পর্যন্ত কত বই লিখেছেন তার সংখ্যা, তার নাটক ও সিরিজ নাটক, ছবি ইত্যাদি সম্পর্কে জানালেন। একটি এক পাতার ব্রিফ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীকে দিলাম। তাকে আরো জানালাম, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে বসে হুমায়ূন আহমেদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি খালেদা জিয়ার সমর্থক এবং ধানের শীষে ভোট দেবেন। এরপর হুমায়ূন আহমেদ এলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আমার কৌতূহল ছিল, তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা জানার জন্য। একান্ত সচিব সাবিহউদ্দিন ভাইয়ের কক্ষে বসা ছিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পর হুমায়ূন আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ থেকে বেরিয়ে সাবিহ ভাইয়ের কক্ষে এলেন। তাকে দেখলাম খুব আবেগপ্রবণ। বললেন, আমার লেখালেখি আজ সার্থক বলে মনে হয়েছে। খালেদা জিয়া বলেছেন, ভাই আপনি বাংলাদেশের খুবই উপকার করছেন। আপনার বইয়ের কারণে কলকাতার বই আর আসে না। নইলে কলকাতার বইয়ে বাজার সয়লাব হয়ে যেত। আমাদের প্রকাশনা শিল্প মার খেত। আপনি দুই হাতে লিখে যান। হুমায়ূন আহমেদ আরো বললেন, আমি বিস্মিত খালেদা জিয়া আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেন। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা হুমায়ূন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এবং ‘দেয়াল’ উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন বিস্তারিতভাবে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হুমায়ুন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ ছবিটি নির্মাণ শেষ হওয়ার পরপর ডিএফডিতে দেখতে গিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম।
খালেদা জিয়া সরকারকে বিপর্যস্ত করার জন্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে গণআদালত গঠিত হয়েছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন গণআদালতের প্রধান। তিনি ক্যানসার আক্রান্ত ছিলেন। তার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর তখন সংসদ ভবনে থাকা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নজরে আনা হয় বিষয়টি। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে শোক বার্তা দেব কি না জিজ্ঞাসা করলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বললেন, অবশ্যই। জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের একজন অসাধারণ লেখক। তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমির মা। দেখুন, কী উদারতা তার!
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উপপ্রেস সচিব হিসেবে যোগদানের সময় প্রেস সচিব ছিলেন আবদুস সোবহান। পিআইডির কর্মকর্তা। তিনি পিআইও হিসেবেও বহু বছর কাজ করেছেন। খুব ভালো মানুষ। এই অফিসে জেনারেল এরশাদের সময় প্রেস সচিব ছিলেন সাংবাদিক তোয়াব খান। প্রেস সচিবের টেবিলের ড্রয়ারগুলো ছিল তালাবদ্ধ। আমি একদিন সোবহান ভাইকে বললাম, ড্রয়ারগুলো খুলুন। এরশাদ আমলের ডকুমেন্ট পাওয়া যেতে পারে। সোবহান ভাই তালাগুলো খোলার ব্যবস্থা করলেন। পাওয়া গেল অনেক প্রাপ্তিস্বীকার পত্র। এরশাদের কাছ থেকে কারা কারা টাকা নিয়েছেন তার ফিরিস্তি। কিছু রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক শিল্পীর নাম রয়েছে। টাকার পরিমাণ খুব বেশি নয়, ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মতো। প্রাপ্তিস্বীকার কাগজগুলো আমি ও সোবহান ভাই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দেখাতে নিয়ে যাই। তিনি সবগুলো একটি একটি করে পড়ে দেখলেন। আমরা বললাম, ম্যাডাম এগুলো পত্রিকায় দিয়ে দিই, এরশাদ যে টাকা বিলাতেন সেটা প্রকাশ পাবে। তৎক্ষণাৎ তিনি বলেন, দেখুন ওনারা আমাদের দেশের গুণী মানুষ। ওনাদের সম্মানহানি করা যাবে না। প্রেস সচিবকে বললেন, সোবহান সাহেব এখনই সব কাগজ পুড়িয়ে ফেলুন। সোবহান সাহেব ওই কাগজ আমাকে আর ধরতে না দিয়ে সরাসরি চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেললেন।
প্রেস ক্লাবের সামনে ‘জনতার মঞ্চ’ হয়েছিল। সেই মঞ্চে বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সুরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গান করছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার ও শিল্পী ছিলেন। প্রেস ক্লাবের সহযোগী সদস্য। পরদিন তার সঙ্গে আমার দেখা। বললাম, দাদা আপনাকে গতকাল খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গান করতে দেখলাম। তিনি আমার কথায় ক্ষেপে গেলেন। আমি বললাম, দাদা আপনি যদি জানতেন খালেদা জিয়া আপনার কত বড় উপকার করেছেন, তাহলে রাগ করতেন না। এরপর তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, কী সেটা? আমি বললাম, আপনি এরশাদের কাছ থেকে এত টাকা নিয়েছিলেন, প্রাপ্তিস্বীকার পত্রে আপনার স্বাক্ষর ছিল। আমরা এই চিঠি পত্রিকায় দিতে চেয়েছিলাম। খালেদা জিয়া দিতে দেননি। বলেছেন, ওনারা গুণী মানুষ। ওনাদের সম্মানহানি করা যাবে না। এ কথা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। বলেন, ভাই আমি আর কোনো দিন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কিছু করতে যাব না। তুমি তাকে আমার শ্রদ্ধা জানিও।
একবার রাজশাহী থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সড়কপথে ফিরছি। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গাড়ির একেবারের পেছনের আসনে আমি ও সালাহউদ্দিন ভাই বসেছি। বর্তমানে সালাহউদ্দিন ভাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। খালেদা জিয়ার পাশে বসেছিলেন বেগম ফরিদা হাসান। তারা পুরোনো দিনের গান ও ছবি নিয়ে কথা বলছিলেন। খালেদা জিয়া বারবার বলছিলেন ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিনের বিভিন্ন গানের কথা। বললেন, গানের ভুবনে এরা আমাদের রত্ন। প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ বছরে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য একজন শিল্পীর নাম প্রস্তাব এসেছে। ফাইল গেছে খালেদা জিয়ার টেবিলে। খালেদা জিয়া একান্ত সচিব সাবিহ ভাইকে বললেন, ওনাকে পরে দিলেও চলবে। ফেরদৌসী রহমানকে এবার আমরা পুরস্কারটি দিই, এরপর নিজ হাতে তিনি ফেরদৌসী রহমানের নাম লিখলেন। পুরস্কার দেওয়ার দিনে হরতাল ছিল। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক খ্যাতিমান ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু অনুষ্ঠানে গেলেও ফেরদৌসী রহমান যাননি। তবে এজন্য তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হননি। কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের পরিবারকে তিনি খুব সম্মান করতেন।
১৯৯৪ সালের দিকে জাপান গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। যমুনা সেতুতে জাপান বিনিয়োগ করেছিল। সেই সফরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। জাপানি পার্লামেন্টের তৎকালীন স্পিকার সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন খালেদা জিয়ার সম্মানে। তিনি তার বক্তৃতায় বললেন, ‘মাননীয় খালেদা জিয়া, জাপান চেরি ফুলের দেশ। চেরি ফুলের উৎসব করি আমরা। ১৫ দিন আগেই চেরি ফুল ফোটার কথা। কিন্তু এতদিন ফুল ফোটেনি। আজ বুঝতে পারছি কেন চেরি ফুল ফোটেনি। আপনি এলেন আমাদের চেরি ফুলও ফুটেছে। চেরি ফুলও আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রতীক্ষায় ছিল। শ্রোতারা মুখর করতালির মাধ্যমে জাপানি স্পিকারের বক্তৃতার পক্ষে সমর্থন জানান। খালেদা জিয়া এ সময় হাসছিলেন।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচন নিয়ে খুব বিতর্ক হয়। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার বক্তৃতায় বারবার উল্লেখ করেন, এটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিল পাসের নির্বাচন। তবু আন্দোলন চলতে থাকে। হরতাল-অবরোধ হয়। বিল পাসের পর ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। ওইদিন বেলা ৩টার দিকে তিনি জনসভায় বক্তৃতা দিতে বের হবেন, বক্তৃতার পর বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা। তেজগাঁও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ তার মনে হলো নিহত পুলিশ কর্মকর্তা ফরহাদের পরিবারকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া অনুদান দেওয়া হয়নি। তিনি সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীকে ডেকে বললেন, ফাইল আনুন। পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারকে টাকাটা পৌঁছে দিন। কামাল সিদ্দিকী ফাইলটি নিয়ে গেলে তিনি স্বাক্ষর করে দেন। এটা ছিল তার পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ ফাইলে স্বাক্ষর। পরে নিহত পুলিশ অফিসারের পরিবারকে টাকাটা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁও অফিসে কেবিনেট কক্ষ উদ্বোধনের দিনের একটি ঘটনা। এ সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছিলেন তৎকালীন কেবিনেট সচিব আইয়ুবুর রহমান। পরদিন সংবাদপত্রে কেবিনেট কক্ষ সম্পর্কে খবর বের হয়। খবরটি পড়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডাকলেন। কিছুটা রাগতস্বরে বললেন, এভাবে খবরটি দেওয়া ঠিক হয়নি। ওনার বলা শেষ হলে আমি বললাম, ম্যাডাম এই ব্রিফিং কেবিনেট সচিব করেছেন। তিনি আর কিছু বলেননি। আমি চলে গেলাম। ১০ মিনিট পর আবার তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। স্নেহের সুরে বললেন, আমি তোমাকে কিন্তু বকিনি, কেবিনেট সচিবকে এ কথা বলেছি। আমি বললাম, ম্যাডাম ভুল করলে অবশ্যই বলবেন, না হলে আমরা শিখব কীভাবে। ভুলটি আমার ছিল না, অথচ আমাকে তিনি এ নিয়ে বলেছেন, আমি মন খারাপ করতে পারি সেই চিন্তা করে ১০ মিনিট পর আবার আমাকে ডেকে এমন কথা বলেন। এমনই ছিলেন মায়ের মতো স্নেহময়ী খালেদা জিয়া।
আজ সারা দেশের মানুষ তার জন্য উদ্বিগ্ন। তিনি এখন আর বিএনপির নেত্রী নন। সারা দেশের মানুষের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এটা তার অসাধারণ গুণাবলির কারণে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এক অনন্য নাম। মানুষ তাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে আসছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাকে মানুষ একজন সাধক হিসেবে দেখেন। প্রায় চার দশক ধরে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি আলোকিত করে আছেন এবং নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। কারাবন্দি এবং অসুস্থতার সময়ও তিনি মানসিকভাবে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ছিলেন। তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল আপসহীন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তেমনি তার রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো সহজ-সরল এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি যেটা বিশ্বাস করতেন সেটাই করতেন। কোনো ভনিতা করতেন না। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন হয়ে ওঠা এবং এ দলকে এত বড় দলে পরিণত করা তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বেরই প্রমাণ। এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ৯ বছরের আপসহীন লড়াই, ১/১১-এর জরুরি সরকারের বিরুদ্ধে তার লড়াই এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে দেশ ও গণতন্ত্রের প্রতি তার ভালোবাসারই বড় প্রমাণ।
১৯৯১ সালে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সচিবালয়ে এক সাক্ষাৎকারে আমি তার স্বপ্নের কথা জানতে চেয়েছিলাম। দাবার গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে সুখী দেখা এবং এ দেশের উন্নতি হয়েছে, সেটা দেখাই আমার স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলাদেশকে আমি মা, জননী, জন্মভূমি হিসেবে দেখি। এই দেশই আমার ঠিকানা। এই দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই।’
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ
abdal62@gmail.com