এত দ্রুত দেশ নির্বাচনি ট্রেনে উঠবে, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সবাই ভেবেছিলেন অন্তত কয়েক বছর এ সরকার ক্ষমতায় থাকবে । আর এটিই ছিল বৃহত্তর জনগণের একান্ত চাওয়া। তারা আশা করেছিলেন, এ সরকারের মাধ্যমে দেশ থেকে দূর হবে দুর্নীতি আর অনিয়মের নৈরাজ্য, কমবে মানুষের ভোগান্তি।
একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষ যে কত শান্তি অনুভব করে, তার উদাহরণ হয়ে আছে ১৯৯০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পরপর তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সময়ে গঠিত তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাসের মেয়াদ নিয়ে মানুষের মনে অনেক আক্ষেপ ছিল। অনেকেই তখন বলত, এ সরকার যদি কয়েক বছর থাকত তাহলে অনেক ভালো হতো।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের চেহারা কেমন হয়, সে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই বর্তমান তরুণ প্রজন্মের। কিন্তু এর পরও গত ১৬ বছরের টানা দুঃশাসনে অতিষ্ঠ তরুণসমাজসহ গণমানুষের চাওয়া ছিল সংস্কার করে তারপর নির্বাচন হোক। কিন্তু গণমানুষের এই চাওয়া পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে বড় মাত্রার সংশয় দেখা দিয়েছে। যে আশা নিয়ে জনগণ চেয়েছিল এই সরকার অন্তত কয়েক বছর ক্ষমতায় থাকুক, তার তেমন কিছুই এখনো দেখাতে পারেনি বর্তমান সরকার। শুরুতে মানুষ তাদের সময় দিয়েছে আর অপেক্ষা করেছে—হয়তো ভালো কিছু করবে।
ছয় মাস পরও যখন সরকার নিজেই ধুঁকে ধুঁকে চলছে, তখন জনগণের মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। যার নিজেরই মেরুদণ্ড দুর্বল, সে অন্যের জন্য আর কী করবে, এটা বুঝে গেছে জনগণ। ফলে অনেকেই অল্প সময়ের মধ্যে বলতে শুরু করলেন—‘নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিলেই ভালো।’ তাদের মতে, এ সরকার ভালো কিছু করতে পারবে না। খামোখা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে লাভ কী? জণগণের এই মোহভঙ্গের জন্য দায়ী সরকার, দেশের রাজনীতিবিদরা এবং গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতৃত্বের ব্যর্থতা ।
বর্তমান সরকার সম্পর্কে অনেকের নেতিবাচক মনোভাব তৈরির বেশ আগে থেকেই নির্বাচনি রোডম্যাপের জন্য বারবার জোর চাপ দেওয়া হয় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সম্ভাব্য একটি সময়সীমা দেওয়া হলো। নির্বাচনি এ সময়সীমা ঘোষণার পর নতুন করে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে সংস্কার ও বিচারপ্রত্যাশী অনেকের মাঝে।
কারণ ছয় মাস পার হয়ে গেছে, তেমন কিছুই হলো না। নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঠিক থাকলে সামনে আছে আর মাত্র ১০ মাস বা এক বছর। অল্প দিনের মধ্যেই দেশে শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনি প্রচারণার ডামাডোল। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় কোনো কোনো দলের প্রার্থী চূড়ান্ত হয়ে গেছে । তার মানে সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নই থেকে যাবে মানুষের মনে ।
নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে খুব শিগগিরই হারিয়ে যাবে সবকিছু। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থাকে অপসারণের পর যে মাত্রায় দেশে সংস্কার প্রয়োজন, তা যে এ স্বল্প সময়ে আদৌ সম্ভব নয়, তা সবার কাছে পরিষ্কার। তাড়াহুড়া করে কোনো কাজ ভালো হয় না, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়নের পাশাপাশি দেশে চলছে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার । এ বিচারও স্বল্প সময়ের মধ্যে তাড়াহুড়া করে শেষ করা সম্ভব নয়। কেবল জুলাই গণহত্যা নয়, শাপলা চত্বর গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ডসহ গত ১৬ বছরে দেশে যত গুম, খুন, অপহরণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তারও বিচার হতে হবে। এর একটিও তাড়াহুড়ার কোনো কাজ নয়। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে দেশ সংস্কার করবে এবং চলমান এ বিচার সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে, এমনটা বিশ্বাাস করতে পারছে না জনগণের বিরাট অংশ।
বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের পর থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পরপর তিনটি নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করেছে, কিন্তু তারা জনগণের কাছে এখন পর্যন্ত এ আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। এমনকি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করবে, সে বিশ্বাস অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিটি সরকার।
অন্যদিকে অনেকে মনে করছেন, এ সরকারের মাধ্যমেও প্রকৃত সংস্কার আসলে সম্ভব নয়। কারণ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সে অনুযায়ী এ সরকার গঠন করা যায়নি। সেজন্য অনেকের এখন সবচেয়ে বড় চাওয়া—অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সংস্কার আনা হোক, এ সরকার ভেঙে দিয়ে নতুন করে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা হোক।
সেটা সম্ভব না হলে অন্তত বিতর্কিতদের সরিয়ে দিয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের মধ্য থেকে নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হোক। এরপর তাদের প্রথম কাজ হবে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করা। দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ফ্যাসিবাদের দোসরদের বসিয়ে রেখে কাগজে-কলমে সংস্কার ফরমুলা দিয়ে কোনো কিছু হবে না।
দ্রুত নির্বাচন নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা। দ্রুত নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়েছে, যখন ভারতের বিভিন্ন মহল থেকেও একই দাবি হাজির করা হয়েছে। শুরু থেকেই ভারত প্রকাশ্যে শত্রুতা করে আসছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে। বর্তমান সরকারকে বিপদে ফেলতে এবং সম্ভব হলে উৎখাতের জন্য তারা চালিয়েছে নানামুখী ষড়যন্ত্র।
কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতের সামনে হিমালয়সম বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্ববরেণ্য ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ভারত বিশ্বের কোথাও কোনো পাত্তা পায়নি বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে। ভারত বুঝতে পেরেছে, প্রফেসর ইউনূসকে হটানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এখন তাদের লক্ষ্য দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে নতুন সরকার আসুক। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম লক্ষ্য—নতুন নির্বাচিত সরকারও যেন হয় যথাসম্ভব ভারতপন্থি, সে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশে ভারতের দ্রুত নির্বাচিত সরকার চাওয়া নিয়ে আরেকটি কারণে বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। অনেকের বিশ্বাস নতুন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসার অল্প সময়ের মধ্যে তাকে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্র করবে ভারত। নতুন নির্বাচিত সরকাকে হটিয়ে পুরোপুরি তাদের পছন্দের সরকার তথা আওয়ামী লীগকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে তারা।
এখন পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা তার দোসরদের যেসব প্রকাশ্য ও গোপন পরামর্শ সামনে এসেছে, তাতে এ ধরনের সন্দেহ তৈরি হওয়া অযৌক্তিক নয়। এছাড়া অতীতে শেখ হাসিনা প্রতিবার বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যেভাবে হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওসহ আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য আর অরাজকতা সৃষ্টি করে বিএনপিকে দেশ পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করেছে, তাও সাক্ষ্য বহন করছে এ ধরনের সন্দেহ তৈরির ক্ষেত্রে। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে একবার শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এক দিনও তিনি শান্তিতে দেশ চালাতে দেবেন না বিএনপিকে।
এ অবস্থায় দেশের অনেকের দ্রুত নির্বাচনের দাবি এবং ভারতের দ্রুত নির্বাচন চাওয়ার মধ্যে অনেকে অনেক ধরনের যোগসূত্র তৈরি করছেন।
সরকারের এখন পর্যন্ত যে পারফরম্যান্স তাতে তারা একটি প্রকৃত সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো বসিয়ে রাখা হয়েছে ফ্যাসিবাদের দোসরদের। প্রধান উপদেষ্টা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘স্বৈরাচারের লোকজন চলে যায়নি। তারা তোমার গ্রামেও আছে। আমাকে আমার গ্রামে তার ভয়ে পথ চলতে হবে, এই বাংলাদেশ গড়লাম আমরা!’
ফ্যাসিবাদের বড় বড় অনেক দোসর ও চিহ্নিত অনেক অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে এবং পাল্টা আঘাত শুরু করেছে। এমনকি গাজীপুরে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। বিদেশে পলাতক এক আওয়ামী লীগ নেতা দেশে তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন সমন্বয়ক ও বিএনপি-জামায়াতের লোকদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার জন্য। এ অবস্থায় ফ্যাসিবাদকে এভাবে টিকিয়ে রেখে দ্রুত নির্বাচনের পর দেশের সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে শঙ্কিত অনেকে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১২ ফেব্রুয়ারি আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে আয়নাঘরের বিষয়ে বলেছেন, এ থেকে যদি আমরা বের হয়ে আসতে না পারি, তা হলে এ সমাজ টিকবে না। প্রধান উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন। ১৬ বছর ধরে চলা ফ্যাসিবাদী শাসনামলের বীভৎসতার যদি বিচার না হয় এবং কলঙ্ক না মুছে যদি বাংলাদেশ আবার আগের মতোই পথ চলা শুরু করে, তবে বাংলাদেশ অচিরেই একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
জনগণের একান্ত চাওয়া প্রকৃত অর্থে দেশের সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের অপরাধীদের বিচার করা। ড. ইউনূস সরকারের প্রতি নানা কারণে অনেকে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ। এর পরও জনতার অনেকের চাওয়া সংস্কার ও বিচার না করে তিনি যেন চলে না যান। কারণ এ ধরনের সুযোগ আর জাতির জীবনে কখনো আসবে না।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ