২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন জনগণের কাছে এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে সংঘটিত ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান যেমন ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে, ২০২৬ সালের নির্বাচন তেমনি বাংলাদেশকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় প্রবেশ করাবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। এই নির্বাচন শুধু একটি ক্ষমতার প্রতিযোগিতা হিসেবে নয়; বরং এটিকে বিপ্লব-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের পরীক্ষা হিসেবে দেখতে চায় জনগণ। আপামর জনতার ত্যাগ ও তরুণদের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে যে নতুন জাতীয় চেতনার উত্থান ঘটেছে, তা এই নির্বাচনের সত্যিকারের বৈধতা ও সফলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। গণঅভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো, একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা, যেখানে ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরে আসবে এবং রাষ্ট্রীয় নীতি হবে ন্যায়, জবাবদিহি ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে। নির্বাচন-পরবর্তী সংসদ পূর্ববর্তী সংসদের মতো ফ্যাসিবাদী তথা একদলীয় পলিসি নির্ধারণকারী হবে না; বরং হবে জাতির নয়া ঐকতানের প্রতীক। এর প্রাথমিক সময়ের অনেকটা অংশ কাটাতে হবে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমের বৈধতা প্রদান, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও এর আলোকে জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সংস্কার বাস্তবায়ন। সুতরাং ক্ষমতায় যে দল বা কোয়ালিশন আসুক, মূলত তাদের কাজ করতে হবে অনেকটা জাতীয় সরকারের মতোই। তাছাড়া, এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টিতেও তাৎপর্যপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি, বিশেষত ভারতের প্রভাববলয়, চীনের বিনিয়োগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন এক নতুন ভারসাম্যের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। বিপ্লব-পরবর্তী এই নির্বাচন তাই শুধু নতুন সরকার গঠনের নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌম অবস্থান ও হারাতে বসা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পুনর্নির্ধারণের সুযোগও এনে দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ কি পারবে গণঅভ্যুত্থানের আদর্শ ধরে রেখে একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নীতিনিষ্ঠ নির্বাচন আয়োজন করতে? বিদেশি স্বার্থের টানাপোড়েনের মধ্যে কীভাবে রক্ষা পাবে রাষ্ট্রের নীতিগত স্বাধীনতা? এবং সর্বোপরি, জনগণ কি বিশ্বাস করবে যে এই নির্বাচন সত্যিই তাদের ভোট ও কণ্ঠের প্রতিফলন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে ২০২৬ সালের নির্বাচনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। সেই প্রশ্নের আলোকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একটি সত্যিকারের নির্বাচনের জন্য কোন বিষয়গুলো সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ, তা নির্ধারণ করে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কারা এই নির্বাচন বানচাল করতে চায়, কীভাবে করতে পারে, কোন বিষয়গুলো বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তার নির্মোহ বিশ্লেষণ অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু এই নির্বাচন ফ্যাসিবাদীদের বাদ দিয়ে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম বাংলাদেশ বিনির্মাণের নির্বাচন, সুতরাং তাকে বানচাল করার জন্য আওয়ামী লীগ ও তাদের রক্ষাকর্তা দেশটি ষড়যন্ত্র করতেই থাকবে, সেই ষড়যন্ত্র কেমন হতে পারে, তার একটি বিশ্লেষণ এখন সময়ের দাবি।
প্রথমত, গত ৩০ অক্টোবর বুধবার, ভারতের দিল্লি থেকে পলাতক শেখ হাসিনার তিনটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া সাক্ষাৎকার, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নতুন শঙ্কা উত্থাপন করেছে। একই দিনে তিনটি প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে (রয়টার্স, এএফপি, দ্য ইনডিপেনডেন্ট) প্রকাশিত সাক্ষাৎকারগুলো এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়; বরং একটি কৌশলগত মিডিয়া ক্যাম্পেইন, যার উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রভাব বিস্তার এবং নির্বাচনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। রিপোর্টগুলোয় দেখা যায়, তিনটি সাক্ষাৎকারের মূল বার্তা প্রায় অভিন্ন ‘বাংলাদেশের চলমান প্রক্রিয়া অন্যায্য’ এবং ‘আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন অর্থহীন’। সাক্ষাৎকারগুলোয় কোনো সরাসরি মুখোমুখি আলোচনা হয়নি; বরং লিখিত প্রশ্নের লিখিত উত্তর ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়, যা অনেক কৌতূহলের জন্মও দিয়েছে লোকমুখে। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মিডিয়া সেল বিশেষত সজীব ওয়াজেদ জয় ও মোহাম্মদ এ আরাফাতের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন লবি গ্রুপের মাধ্যমে এই প্রচারণাটির সমন্বয় করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দলের অবস্থান আবার দৃশ্যমান করা, যাতে নির্বাচনের আগেই ‘রাজনৈতিক বৈষম্য’ ও ‘অংশগ্রহণহীনতা’-এর বয়ান ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, সরকার ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্থিতিশীলতা স্বাভাবিক রাখতে চাওয়া নানা মহলকে লক্ষ্য করে পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো বড় অঙ্কের টাকায় অস্ত্র ও ভাড়াটে খুনি সংগ্রহ করছিল। এছাড়া নিকট অতীতেই জাল টাকার এক বিশাল চালান ও আটকা পড়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। অভিযানে আটককৃতদেরের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য আবার প্রমাণ করছে যে অস্ত্র সরবরাহের এক সুপরিকল্পিত রুট গড়ে উঠেছিল; পাশাপাশি এলাকার ক্যাডার তালিকা, ভাড়াটে কার্যকারীর নাম ও আর্থিক যোগসাজশের কাগজপত্র উদ্ধার হয়েছে। তদন্তকারীরা বলছেন, এই সৃজনশীল অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে সশস্ত্র ও অশান্তি সৃষ্টির উপকরণ সংগ্রহ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ নেতাদের ওপর হামলা এবং ভয়ভীতি ছড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যাতে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে নির্বাচন বানচাল করা। তদন্তের সূত্রে আরো উঠে এসেছে যে শুধু খুন নয়, একইভাবে পরিকল্পিতভাবে নানা স্থানে আগুন লাগিয়ে জনজীবন বিঘ্নিত করা, বাজার ও গণপরিবহন কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়া, স্থানীয় রাজনৈতিক অফিস, গার্মেন্টসসহ নানা জায়গায় আগুন দিয়ে দেশকে অকার্যকর প্রমাণ করা টার্গেটে এসব কর্মকাণ্ডের ছক কাগজে উঠেছিল। এছাড়া সম্প্রতি বিমানবন্দরে স্মরণকালের ভয়াবহ আগুন, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে আগুন, চট্টগ্রাম বন্দরে আগুনের মতো ঘটনা ঘটেছে, যা মূলত কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া লীগ ও প্রতিবেশী দেশের ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রেরই প্রমাণ। নিরাপত্তা বাহিনী ও তদন্ত সংস্থাগুলোর আরো বেশি তদারকি ছাড়া এসব এসব ঘটনা ঠেকানো কঠিন হয়ে উঠবে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্প্রতি ঘটনাগুলোর পর নড়েচড়ে বসছে, সম্ভাব্য জোন বা হটস্পট চিহ্নিত করে সেখানে সতর্কতা বাড়িয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া ট্রানজ্যাকশন, ট্র্যাকিং ডেটা ও ফোন রেকর্ড যাচাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তৃতীয়ত, ৫ আগস্টের জুলাই বিপ্লবের পর দিল্লির প্রভাব ও আধিপত্যের বলয় থেকে বাংলাদেশ হাতছাড়া হওয়ায় ঘটনা ভারত সরকারকে স্তম্ভিত করে তোলে, ভারত ছিল অপ্রস্তুত। তাদের সহযোগী আওয়ামী লীগ ও মহাজোট দিয়ে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ কবজা করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তবে বাংলাদেশকে আবার ফিরে পেতে ভারত দিবাস্বপ্ন দেখছে। কেননা, শেখ হাসিনাকে আশ্রয়দান করা থেকে শুরু করে, তার লাখো নেতাকর্মীকে আশ্রয় প্রদান, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা চলমান, বাংলাদেশের বিপক্ষে একের পর এক কূটনীতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ ও গুজব প্রচারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করল। পরে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করার পরও শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া ও তাকে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত, ভারত তার বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান চলমান রাখবে এবং প্রয়োজনে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখবে এবং আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে ফেরানোর জন্য যা করার প্রয়োজন, তার সবটুকুই করবে। সুতরাং যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, হাসিনার বিচার ও তার নেতাকর্মীদের মানুষ হত্যার বিচার চলছে, এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও এই নির্বাচন বানচাল করে আওয়ামী লীগকে নিয়ে ইনক্লুসিভ নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে, সে জন্য কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলছে, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনের আন্তর্জাতিক বৈধতা লাগবে’। শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক মিডিয়া সাক্ষাৎকার তারই ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, এই মিডিয়া প্রকাশনা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব ছিল না। কারণ, শেখ হাসিনার অবস্থান, নিরাপত্তা ও যোগাযোগ বর্তমানে ভারতের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন। এটি দিল্লির অবস্থানের একটি বাস্তবসম্মত ইঙ্গিত দেয়, আগে ভারত ঢাকা পরিস্থিতি নিয়ে মুখে মুখে বন্ধুত্বের কথা আওড়ালেও, তার আধিপত্যের ছায়া সে ধরে রাখবেই। যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ও কূটনীতিক চাপ বজায় রেখে পতিত ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগকে আবার ফেরানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করবে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলোর সচেতনতা জরুরি। সরকারের উচিত, যেকোনো ভারতীয় মিথ্যা বয়ানের শক্ত জবাব দেওয়া। তার মিডিয়া সেল ও আন্তর্জাতিক লেভারেজ কাজে লাগানো, বিশ্বগণমাধ্যম, কূটনীতিক চ্যানেল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে এ কথা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা যে আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি কেন কোনো স্বাভাবিক রাজনৈতিক দল নয়; বরং একটি সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি, গণহত্যাকারী এবং গণতন্ত্রবিনাশী দল, যেটি ভারতীয় ‘র’ দ্বারা পরিচালিত। একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রমাণভিত্তিক আলোচনা তুলে ধরা। তাদের বারবার সুযোগ দিলে মূলত দেশে আবার গণহত্যা চালানো ও গণতন্ত্র বিনাশের সুযোগ তৈরি হবে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের উচিত কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সুস্থ নির্বাচনে সরকারকে সহায়তা করা। পতিত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিষয়ে ভারতকে কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানানো এবং জনগণের উচিত সদা-সর্বদা লীগ ও বামদের বাকশালী অংশ ও ভারতের ষড়যন্ত্র নিয়ে সর্বাত্মক সতর্ক থাকা।
লেখক : একাডেমিক ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ (সিজিসিএস)
khaled.du502@gmail.com