হোম > মতামত

নিঝুম সন্ধ্যায় পথ ভুলে যাওয়া

ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী

ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। অসহ্য যন্ত্রণা, কষ্ট, ত্যাগস্বীকার ও বেদনা পেরিয়ে নতুন দিনে পৌঁছে যাওয়ার শুরুর কালের স্বপ্নে বিভোর সেই সময়কার সাড়ে ৭ কোটি জনতা, ঢাকার রাজপথে যার কেন্দ্রভাগ। যারা দেখেনি, যাদের জন্ম হয়নি কিংবা বোঝার বয়স হয়নি সে সময়, তারা বুঝতেই পারবে না হাজার বছরের পথ পেরিয়ে, চব্বিশ বছরের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে কীভাবে একটা জনপদের মানসভূমি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এ জন্যই ভোট দিয়ে আনা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে শেষ করে এখানকার সমষ্টি মানুষ। ওইদিন বিকেল থেকে জনস্রোত রাস্তায় নামে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। হানাদার বাহিনী নিজের দেশের লোকদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করছে। খবরটি চারদিকে বিদ্যুৎ গতিতে ছড়াল। রাস্তাঘাট জনাকীর্ণ আনন্দাশ্রুসহ।

২৫ মার্চের আর্মি ক্র্যাকডাউনের পরপর মধ্যরাতে মেজর জিয়া কর্তৃক ‘উই রিভোল্ট’, ২৬ এবং ২৭ মার্চে স্বাধীনতার সুদৃঢ় ও উজ্জ্বল ঘোষণা সেই ভয়ংকর দিনে যখন কি না রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে এবং পালিয়েছে, তখন সমগ্র জাতিকে নতুন আশায় উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে সর্বাধিক কার্যকর হয়েছে। তারপর তেলিয়াপাড়া রণকৌশল, যেখানে প্রথমে গেরিলাযুদ্ধ ও পরে সম্মুখযুদ্ধ-উভয়টিরই সম্মিলন ঘটানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুযায়ী ৯ মাস চলেছে একটানা রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার লড়াই। এ সময় ঢাকাসহ সর্বত্র দিনে ছিল পাকিস্তান আর রাতে ছিল বাংলাদেশ। আমাদের গেরিলারা জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন তথা আশ্রয়, খাদ্য, পানীয়, অর্থসাহায্য, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, রেকি করা, শত্রুর সন্ধান জানিয়ে দেওয়া, শত্রুকে বিভ্রান্ত করা, নিজেদের অংশগ্রহণসহ মাছের মতো পানিতে থেকে বিচরণকরত শত্রুকে ঘায়েল ও নিধন করেছে। গেরিলাযুদ্ধের বিশ্বময় স্বীকৃত থিসিস যেমন : স্প্যানিশ, চায়নিজ, চে গুয়েভারিয়ান, ভিয়েতনামিজ, কম্বোডিয়ান, রেজিস দেবরে গেরিলা ওয়ারফেয়ার থিসিসসহ কোনো থিসিস অনুযায়ী বাংলাদেশে গেরিলাযুদ্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল না। গেরিলাযুদ্ধের ইতিহাসে মধ্য ত্রিশের বয়সের লোকরাই গেরিলা হয়েছে সবচেয়ে সফলভাবে। অথচ বাংলাদেশের গেরিলাদের অধিকাংশের বয়স ছিল কুড়ির কোঠায়। আবার, গেরিলাযুদ্ধের জন্য উপযোগী ভূখণ্ড হওয়া দরকার বিশাল এবং পাহাড়, অরণ্য, অগম্য বিস্তার, পশ্চাৎভূমিসহ স্বল্প ও বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করা জনসংখ্যা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে একাত্তরে সবকিছুই ছিল বিপরীতমুখী। তবু এখানে সফল গেরিলাযুদ্ধ হয়েছে। এর পেছনে একমাত্র নতুন ব্যাখ্যাকৃত কারণ হতে পারে টোটাল হ্যাট্রেড অ্যাগেইনস্ট এ সিস্টেম। এ কারণে কোনো শর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ১৯৭১-এ ঘটেছে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক সফল গেরিলাযুদ্ধ। এটা শেষের দিকে একের পর এক সম্মুখযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। ঢাকাসহ গ্রাম ও শহরগুলোতে ক্র্যাকপ্লাটুন ও গেরিলা বাহিনী এবং অন্যত্র মুক্তিযোদ্ধারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলে যে, হানাদার বাহিনী ক্যান্টনমেন্টগুলোতে সীমিত হয়ে যায়। একটা অপেক্ষাকৃত প্রলম্বমান গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ যখন নিজেকে নিজেই স্বাধীন করে ফেলার অবস্থায় চলে গেছে, তখন ৩ ডিসেম্বর এয়ারস্ট্রাইক করে ভারত বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে এবং আমাদের জনগণের নিজস্ব প্রচেষ্টায় প্রায় সাফল্যের দ্বারে পৌঁছানো মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে ছিনতাই করে।

এভাবেই আমরা স্বদেশে, স্বভূমিতে পেছন দিক দিয়ে চাণক্য চালে পড়ে আওয়ামী অন্তর্ঘাতের শিকার হয়ে অরক্ষিত হই। হাঙর হিন্দুস্তানি আধিপত্যবাদ নিজস্ব দীর্ঘদিনের ব্রাহ্মণ্যবাদী লালসাকে এদেশে বিস্তার করে। প্রথমদিনই বিকালে তৎকালীন রমনা রেসকোর্সে ইস্টার্ন কমান্ডের অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে নিয়াজী। ইতিহাসের পরিহাস এই যে, এক পাঞ্জাবি আরেক পাঞ্জাবির কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেখানে এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার উপস্থিত থাকলেও তার কোনো ভূমিকাই ছিল না। তৎকালে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে তার হেলিকপ্টারে গুলি করে ফোর্স ল্যান্ডিং করতে বাধ্য করা হয়েছিল সিলেটের দিকে। অর্থাৎ দেখানো হয়েছে, পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের মধ্যকার যুদ্ধে প্রথমোক্ত দেশ পরাজিত হয়েছে এবং শেষোক্ত দেশ বিজয়ী হয়েছে। বাংলাদেশ কোথায় ছিল? কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হয়েছে? সেই থেকেই শুরু। আজ এত দীর্ঘসময় ধরে প্রতিবছর ভারতীয় ইস্টান্ড কমান্ড ১৬ ডিসেম্বরকে নিজেদের বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।

এর পরের পঞ্চান্ন বছরের ইতিহাস আরো করুণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হিন্দুস্তানে বাংলাদেশের আশ্রয় নেওয়া জনগণের জন্য সারাবিশ্ব থেকে প্রেরিত নজিরবিহীন অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য অধিকাংশই আত্মসাৎ করেছে ভারত। পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওয়া কয়েক লাখ কোটি টাকা, যা ক্ষতি পূরণবাবদ বাংলাদেশ পেতে পারত, তাও পকেটে ঢুকিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র, অর্থ, সামরিক যানবাহন, গোলাবারুদসহ সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ ও যানবাহন লুটে নিয়েছে। তারা সামরিক-বেসামরিক হাসপাতাল, বাজারগুলোসহ বেসামরিক মানুষের গাড়ি ও সম্পদ লুট করেছে। সবকিছু বিরাট কনভয় করে ভারতে নেওয়া হয়েছে।

এরপর ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়েছে। অন্যান্য নদীতে বাঁধ, ড্যাম, গ্রোয়েন দিয়ে চুয়ান্নটা অভিন্ন নদীর পানি আটকানো হয়েছে। কোনো রকম পরোয়া না করে পানিকে অন্যদিকে ভারতের ভেতরে সংযুক্ত খালের মাধ্যমে প্রবাহিত করা হয়েছে একতরফা চাণক্যবাদী স্পর্ধায়। গ্রীষ্মকালে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারা এবং বর্ষাকালে স্লুইসগেট খুলে দিয়ে বারবার বন্যায় ডুবিয়ে মারা দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ এবং সব ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে। ফেলানী হত্যাসহ সীমান্ত হত্যা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। বেরুবাড়ী নিয়ে গিয়ে পাঁচ দশকেও তিন বিঘা করিডোরের একক মালিকানা দেয়নি। সীমান্তের ওপারে শত শত ফেনসিডিল, ইয়াবা, মাদক ও গাঁজার কারখানা খুলে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে শেষ করেছে। চোরাচালান করে বাংলাদেশের বাজারকে সয়লাব করেছে। একতরফা ভারসাম্যহীন বাণিজ্য অসমতা জারি রেখেছে। ২০ কোটি মানুষের বাজার দখল করেছে। ভারতের ভিসার ফাঁদ পেতে বাংলাদেশের জনগণের অর্থ, স্বাস্থ্য, চরিত্র ও পরিবার ধ্বংস করেছে এবং ৬৪ জেলায় ‘র’ অপারেটিভ দিয়ে গোয়েন্দা জাল বিস্তার করেছে। বাংলাদেশে সব সেক্টরে নিজেদের লোক বসিয়ে নিজেদের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশ বানিয়েছে এই ভূখণ্ডকে। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের নামে মাল্টিমোডাল করিডোর নিয়েছে। সোপ অপেরা, সস্তা সিরিয়াল, স্যাটেলাইট আগ্রাসনসহ সর্বদিকে অশ্লীল উলঙ্গপনায় ডুবিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম জনসমাজের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিকে পৌত্তলিকতার পঙ্কিলতায় পতিত করেছে। এ অকাজকে সর্বাত্মকভাবে চালু থাকতে দিয়েছে তাদেরই কর্তৃক ক্ষমতার মসনদে বসানো বশংবদ আওয়ামী-বাকশালী পাণ্ডাশক্তি। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় হর্স ডিপ্লোমেসি করে মঈন উ আহমেদ ১/১১ ঘটিয়েছে। ৭২-৭৫ পর্যায়ে মুজিব সাত দফা গোপন চুক্তি এবং ২৫ বছরের চুক্তির আওতায় ছিলেন। গদির বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা হরণ। ৭ নভেম্বর ৭৫-এ সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদকে হটানো হয়। জিয়াউর রহমানের সাড়ে ৪ বছরের শাসনকাল ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল উদ্ধারের দিন। ওই সময়টুকুতে বাংলাদেশ নিজের মাথাকে স্বাধীনভাবে বিশ্বসভায় তুলতে পেরেছিল। ‘র’-এর অপারেটিভরা এবং পঞ্চম বাহিনী ও অন্যান্য এজেন্ট সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে ঘরের শত্রু বিভীষণের মাধ্যমে জিয়াকে শেষ করে দেয়। এর আগে জিয়া আওয়ামী লীগকে লাইসেন্স দিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের আওতায়। হাসিনাকে দেশে আসতে দিয়ে তার সব সম্পত্তি বুঝিয়ে দেন। একই সময় জিয়া দক্ষিণ তালপট্টির ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার দাবি করেন। ভারত তখন একদিকে এর আগে তৈরি করা সেবাদাসী হাসিনাকে ১৭ মে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে পাঠায় তাদের আলটিমেট মিশন দিয়ে। আর ৩০ মে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করা হয়। এভাবেই ভারত বাংলাদেশকে তার কবজায় আবার নিয়ে নেয় দীর্ঘ প্রলম্বিত কালোছায়া ফেলে।

একাত্তরে স্বাধীন হয়েও আমরা বাহাত্তরেই ভারতীয় খপ্পরে পড়েছি। ৭ নভেম্বর ছিল আধিপত্যবাদবিরোধী প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সাফল্যের দিন। ওইদিনকে আমরা আবার সম্মিলিত চেষ্টায় নিজেদের করে নিয়েছি ৫ আগস্ট ৩৬ জুলাইয়ের বর্ষাবিপ্লবের মাধ্যমে। গত এক বছর তিন মাসে আবার কি আমরা তা হারাতে বসেছি? আনুষ্ঠানিক ও প্রতীকী অর্থে ম্যাঙ্গো ডিপ্লোমেসি এবং ইলিশ ডিপ্লোমেসি কীসের ইঙ্গিতবহ? হাসিনা ও ফ্যাসিবাদী চক্রকে কোন মতলবে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে? আর কেনইবা তাকে ফেরত পাঠানো হবে না, এক্সট্র্যাডিশন চুক্তি থাকা সত্ত্বেও?

আমরা কি চাণক্যবাদী ইন্ডিয়ান ডকট্রিনের মাধ্যমে নতজানু হয়ে বাংলাদেশকে ওভাররান করতে দেব? আমরা কি ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী খপ্পরের বাইরে স্বাধীন, স্বশাসিত, স্বনিয়ন্ত্রিত, স্বনির্ভর, সম্পন্ন ও সমমর্যাদার জীবনে পৌঁছাতে পারব না? ১৬ ডিসেম্বর বিকালবেলা এই লেখক ঢাকার নিউ মার্কেটের বিপরীতে নীলক্ষেতের মোড়ে গাছে বেঁধে রাখা মাইকে গান শুনতে পেয়েছিলেন : ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়’। ওই গানটি সেদিন সেখানে জড়ো হওয়া জনতা শুনেছে। আর সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল ভারতীয় আগ্রাসন, লুটপাট ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির চালান। ৫৫ বছর ধরে সেটাই চলে আসছে। লেখকও গানটি ভোলেননি। সত্যিই কি বাংলাদেশ তার সামষ্টিক ইচ্ছা ও আশাকে হারিয়ে ফেলছে কোন চক্রে পড়ে? আমরা কি জাতিগতভাবে ঘোরতর নিঝুম সন্ধ্যায় পড়ে গিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কুলাকে ভুলে যাব? আজ তাই একজন জিয়ার কথা বারবার মনে পড়ে।

লেখক : প্রফেসর (অব.), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রপ্তানিতে দরকার বৈচিত্র্য

নির্বাচনের সংস্কৃতি ও জনগণের আস্থাসংকট

সামরিক শাসনের নতুন মডেল

বাক্সবন্দি নয়, দরকার দ্রুত বিচার

বিডিআর হত্যাকাণ্ড : ভারত ও হাসিনার প্রতিশোধ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেষ জননন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া

গণতন্ত্র ধার করার প্রয়োজন নেই আফ্রিকার

ছয় কোটি নতুন মুখ দারিদ্র্যসীমার ঝুঁকিতে কেন?

বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ও বাস্তবতা

সংবিধানে ‘বিসমিল্লায় গলদ’