স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন সৃষ্টির জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। যার দায়িত্ব হবে স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য সেবার মান এবং পরিমাণের তদারকির উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ; প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়ের তদারকি; জবাবদিহির নিশ্চয়তা বিধান, সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ বা ক্রয় এবং সংগ্রহে অভিযোগের তদন্ত; জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও দপ্তরের নীতি, কৌশল, কর্মসূচি, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন কার্যক্রম ইত্যাদির তদারকি ও জবাবদিহি। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশনকে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হলে তাকে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। প্রস্তাবিত এই কমিশনের জবাবদিহি থাকবে শুধু সরকারপ্রধানের কাছে। এছাড়া প্রয়োজনে স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে অন্য কোনো খাতের সমন্বয় করতে কমিশন সরাসরি সহযোগিতার মঞ্চ সৃষ্টি করবে। যেহেতু কমিশনটি স্বাস্থ্যবিষয়ক, তাই কমিশনের প্রধান হবেন একজন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ। কমিশনের প্রতিবেদনে কমিশনের সদস্য কারা হবেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কমিশনের একটি সাচিবিক দপ্তর থাকবে, থোক বরাদ্দ করা যথোপযুক্ত এবং প্রয়োজনীয় বাজেট থাকবে; যা নিরীক্ষিত হবে কিন্তু অন্য কোনোভাবে এই বাজেট বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে না।
সংস্কার কমিশন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একটি পৃথক অবকাঠামোর রূপ এবং নাম দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। একজন চিফ সেক্রেটারি ও তিনটি অধিদপ্তর সরাসরি জনপ্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে । তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরে থাকবে আর্থিক ও জনবল-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকৃত ক্ষমতা ।
মেধা ও শিক্ষাকাল বিবেচনায় চিকিৎসক পদ প্রারম্ভেই হতে হবে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবের পদের সমান এবং শিক্ষাকালের ফলের আলোকে বা চাকরিকালে সেবার মান, গুণ ও পরিমাণ এবং কর্মস্থলের দুর্গমতার আলোকে বেতন, ভাতা ও পদোন্নতি দিতে হবে।
মেডিকেল ও সহযোগী শিক্ষা অধিদপ্তরে নার্সিং এবং প্যারামেডিক শিক্ষায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি করে অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং দুটি করে পরিচালক পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। মেডিকেল ও সহযোগী বিষয়ের শিক্ষকরা শুধু শিক্ষা ও গবেষণাকাজে ব্যাপৃত থাকবেন এবং এ জন্য তাদের উপযুক্ত পরিমাণে সম্মানী দিতে হবে। হাসপাতালের কনসালট্যান্টরা কখনো কখনো শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেবেন, যাতে তারা চিকিৎসার আধুনিকতম জ্ঞানের চর্চার মধ্যে থাকেন।
জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম রোগপ্রতিরোধ, রোগনিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ও পারিবারিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং পুষ্টির উন্নয়নভিত্তিক। এ জন্য যারা এই বিভাগ পরিচালনা করবেন, তাদের স্বাস্থ্যের সামাজিক-প্রভাবকগুলো যেমন : স্বাস্থ্যবিষয়কনীতি, কৌশল, আইন ও কর্মসূচি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত হলে এর মহাপরিচালকের অধীন চারজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক থাকবেন গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা, নগর-স্বাস্থ্যসেবা, পারিবারিক স্বাস্থ্যসেবা এবং পুষ্টিসেবার জন্য। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাস্থ্য বিভাগ এই অধিদপ্তরে একীভূত হবে। বলাবাহুল্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক বা কারিগরি সামর্থ্য নেই। পরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রম ২০১১ সাল থেকে স্থবির। এই অধিদপ্তরের অধীন ১১২০ জন চিকিৎসক স্বাস্থ্যবিভাগে এবং ৩০৩ জন অচিকিৎসক অন্য কোনো ক্যাডারে আত্মীকৃত হতে ইচ্ছুক। অধিদপ্তরের অবশিষ্ট কর্মীরা বার্ধক্যজনিত এবং শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম জনগণকে পরিবারভিত্তিক সেবা প্রদান, তাদের ওষুধ ইত্যাদির সংস্থান করা, ব্যায়ামের ব্যবস্থা করা, সঙ্গ প্রদান, তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এবং পুষ্টির অবস্থা নিরূপণ ও সে অনুযায়ী পরামর্শ প্রদান করবেন, প্রয়োজনে স্থানীয় সেবাকেন্দ্রে নিয়ে যাবেন এবং মানসিক এবং শারীরিক পুনর্বাসন সেবা দেবেন।
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো মহামারি, অতিমারি এবং দুর্যোগকালীন সমস্যার ব্যবস্থাপনা। এসব কার্যক্রমের জন্য জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ফ্যাক্টরি আইনের মাধ্যমে আপৎকালীন সময়ের জন্য ব্যবহারের ক্ষমতা দিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে পৃথক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো অবকাঠামো নেই। পৃথিবীর সব উন্নত দেশে, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং ভুটানে ও জনস্বাস্থ্যের জন্য আলাদা অধিদপ্তর আছে এবং সার্ক অঞ্চলে এই তিনটি দেশের স্বাস্থ্যসূচক সর্বোত্তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই অঞ্চলে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ায় ও জনস্বাস্থ্যের পৃথক অবকাঠামো আছে। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আর যেসব দপ্তর ও কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তা কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সংস্কার কমিশন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য বিনামূল্যে দেওয়ার প্রস্তাবে দিয়েছে। এই সেবার ব্যবস্থাপনা একটি জটিল বিষয়। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়েছে এটাকেও বিবেচনায় রেখে।
জনস্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করে বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের নতুন নাম দিতে হবে। যেমন : হাসপাতাল ও রোগ নির্ণায়ক সেবা। যেহেতু কিছু কিছু সেবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর অংশ হিসেবে থাকবে এবং উপজেলা ও এর ওপরের সেবা অবকাঠামো থেকে শুধু রেফার করা সেবা দেওয়া হবে তাই এ নাম। এর ফলে ওপরের দিকে যারা সেবা দেন, তারা আরো সময় নিয়ে রোগী দেখতে পারবেন। ফলে চিকিৎসাসেবার মান উন্নত হবে। তবে এ জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে রোগীরা সরাসরি রেফার করা সেবাকেন্দ্রে যেতে তাগিদ অনুভব না করেন।
হাসপাতালে প্রদত্ত সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ার একটা বড় কারণ নার্স ও চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণকারীর দ্বৈত এবং পৃথক সংস্থা। এ জন্য নার্সদের হাসপাতাল ও রোগ নির্ণায়ক সেবা অধিদপ্তরে একীভূত করতে হবে এবং এ জন্য হাসপাতাল সেবা অধিদপ্তরে একটি অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে প্যারামেডিকদের জন্য ও একটি পরিচালকের পদ সৃষ্টি করতে হবে । হাসপাতাল সেবার মানোন্নয়ের জন্য চারটি সহায়ক কর্মসূচিকে শক্তিশালী ও সমন্বিত করতে হবে। এগুলো হলোÑপরীক্ষাগার, ফার্মাসি, রক্ত পরিসঞ্চালন ও অ্যাম্বুলেন্স। এই সেবাগুলোর জন্য একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও চারটি পরিচালক পদ সৃষ্টি করতে হবে। এই সেবাগুলো জাতীয় পর্যায় থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। দেশের সব হাসপাতালে এসব সেবা চব্বিশ ঘণ্টা প্রাপ্য থাকবে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানে প্রাপ্য এসব সেবা ওই নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
সবার জন্য হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে প্রদান করার জন্য সর্বস্তরে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেবা প্রদানকারী ও তাদের তত্ত্বাবধানকারী নিয়োগ করতে হবে এবং তাদের কার্যধারা বা উদ্দিষ্ট জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনতে হবে এবং এসব একটিই অবকাঠামোর অধীনে থাকবে। সেবার অর্থায়নের জন্য সংস্কার কমিশন জিডিপির ৫ শতাংশ এবং বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ১৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দল এবং চিকিৎসক সমিতিগুলোও একমত। বার্ষিক কর ছাড়াও অর্থের সংস্থান হতে পারে বিভিন্নভাবে। উদাহরণস্বরূপ, সিন-ট্যাক্স, দাতা ও রোগীদের দান। কমিশন প্রস্তাব করেছে যে, যারা সংগঠিত (ফর্মাল) খাতে চাকরি করেন, তাদের জন্য সামাজিক স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। তবে ২০ শতাংশ অতিদরিদ্রকে সব হাসপাতাল সেবা বিনামূল্যে দিতে হবে, যার ১০ শতাংশ হবে আগের মতো বেসরকারি খাতে। সমন্বিত এবং দ্বৈততা পরিহার করে সেবা দেওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক মানচিত্র তৈরি করতে হবে, যা নির্দেশ করবে কোন এলাকার দরিদ্ররা কোন হাসপাতালে যাবে। কোথায় কী ধরনের সেবা দিতে হবে, তা নিশ্চিত করতে হবে প্রতি দশকে উপজেলাওয়ারী জরিপের মাধ্যমে। উল্লেখ্য যে, মেডিকেল ও সহযোগী শিক্ষা এবং রোগীকে প্রদত্ত সেবার মানোন্নয়ের জন্য এবং চিকিৎসাসেবার মূল্যহ্রাসের জন্য ও প্রতিবেদনে বিভিন্ন কৌশলের সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণির চিকিৎসক নিয়োগ দ্রুত এবং সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য একটি স্বাধীন কর্ম কমিশন সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে।