হোম > মতামত

সংবিধানে ‘বিসমিল্লায় গলদ’

আহমদ মুসাননা চৌধুরী

সংবিধান

বাংলার প্রচলিত কথায় ‘বিসমিল্লায় গলদ’ অর্থ—কোনো ভালো কাজের শুরুতেই ভুল বা বিপত্তি ঘটে যাওয়া। বাংলাদেশের সংবিধানে এ রকম একটি ‘বিসমিল্লায় গলদ’ রয়েছে। আর এই গলদ তৈরি হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।

১.

২০১১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ব্যাপক কাটাছেঁড়া ও পরিবর্তন আনা হয়—মূলত আওয়ামী রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতাদর্শকে সাংবিধানিক রূপ দিতে। এই উদ্দেশ্যকে চিরস্থায়ী করতে সংযোজন করা হয় অনুচ্ছেদ ৭খ, যেখানে সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিসহ আরো কিছু মৌলিক বিধানকে ‘সংশোধন-অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়। তবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের গোড়াতেই ছিল একটি মৌলিক ত্রুটি—যাকে আমি বলছি ‘বিসমিল্লায় গলদ’।

গলদটা কোথায়? ১৯৭২ সালের সংবিধান, অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রণীত সংবিধানে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ কিংবা এর কোনো বাংলা তর্জমা ছিল না। অর্থাৎ, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ‘বিসমিল্লা’র কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মূলত ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে একটি ঘোষণা আদেশ তথা ‘Proclamations (Amendment) Order 1977, i.e. Proclamation Order No. 1 of 1977’-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সংবিধানের প্রারম্ভে ইংরেজিতে ‘BISMILLAH-AR-RAHMAN-AR-RAHIM (In the name of Allah, the Beneficent, the Merciful)’ যুক্ত করা হয়। অতঃপর ১৯৭৮ সালের আরেকটি ঘোষণা আদেশ তথা ‘Second Proclamation (Fifteenth Amendment) Order, 1978 (Second Proclamation Order No. IV of 1978)’-এর মাধ্যমে বাংলায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং এর তর্জমা ‘দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে’ যুক্ত করা হয়।

পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আইন পাস করে এই ঘোষণা আদেশ দুটিকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে জারি করা অন্য আরো সামরিক ঘোষণা, আদেশ এবং কর্মের সঙ্গে বৈধতা দেওয়া হয়।

পরে ২০০৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগ বিখ্যাত ‘মুন সিনেমা হল মামলা’-এর রায়ে ১৯৭৮ সালের ওই ঘোষণা আদেশ দুটি এবং এদের বৈধতা দেওয়া পঞ্চম সংশোধনী আইনকে অবৈধ ও শুরু থেকেই বাতিল (void ab initio) ঘোষণা করে। রায়ে বলা হয়, এই ঘোষণা আদেশ দুটি শুরু থেকেই অস্তিত্বহীন (non est) ছিল। ২০১০ সালে আপিল বিভাগও এই রায় বহাল রাখে।

ফলত, সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী নামে আর কিছুর অবশিষ্ট রইল না। কিন্তু মজার জায়গাটি হলো—পঞ্চদশ সংশোধনীতে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’-কে সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ, যার অস্তিত্ব নেই তার সংশোধন? জি, হ্যাঁ।

২.

পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বলে সংবিধানের মাধ্যমে প্রথম যে সংশোধনীটি করা হয়, সেটি হলো—‘বিসমিল্লা’র বিষয়টি। ওই আইনের ২ ধারা অনুসারে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)’-এর স্থানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) / পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আর এটিই এখন হলো সংবিধানের এক নম্বর সংশোধনী পাদটীকা (footnote)।

যেখানে আদালতের রায়ের কারণে ‘বিসমিল্লা’রই কোনো সাংবিধানিক অস্তিত্বই নেই (non est), সেখানে সেটিকে অজ্ঞাত কারণে ‘প্রতিস্থাপন’ করা হয়েছে। অথচ পঞ্চদশ সংশোধনী যখন করা হয়, তখন ঘোষণা আদেশ (Proclamations) তথা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যেসব সংশোধনী সংবিধানে আনা হয়েছিল, সেগুলো অস্তিত্বহীন (non est) ধরে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। প্রমাণস্বরূপ, বর্তমান সংবিধানের কোথাও পঞ্চম সংশোধনী কিংবা প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়কালে জারি করা কোনো ঘোষণা আদেশ বা ফরমানের উল্লেখ বা অস্তিত্ব পাবেন না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, আদালতের রায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলের সামরিক ফরমান বা ঘোষণা আদেশের বেশ কিছু কর্মকে মওকুফ (condone) করা হলেও ‘বিসমিল্লা’র বিষয়টি মওকুফ করা হয়নি। অর্থাৎ ‘বিসমিল্লা’ সামরিক ঘোষণা আদেশগুলোর মতো শুরু থেকে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।

৩.

আইন কিংবা সংবিধানে কোনো নতুন শব্দ বা বাক্য যুক্ত করতে হলে তা সংযোজন (insertion) বা সন্নিবেশ (inclusion) হিসেবে যুক্ত করতে হয়, প্রতিস্থাপন (substitution) নয়। এখানেই মূল ত্রুটি—পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এরূপ ‘বিসমিল্লা’র প্রতিস্থাপনকে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এক ধরনের আইনি অসংগতি বা drafting error হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংযোজন বা সন্নিবেশ না করে প্রতিস্থাপন করা ছিল বাংলাদেশের সংবিধানের ‘বিসমিল্লায় গলদ’ বা ভুল। আর এই ভুলের ওপর আজ বাংলাদেশের সংবিধান দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনকি গত অক্টোবরে সংবিধানের ব্যাপক সংস্কারের উদ্দেশ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তত্ত্বাবধানে প্রণীত ‘জাতীয় জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করেছে চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দল। কিন্তু এই জুলাই সনদেও ‘বিসমিল্লা’র ত্রুটির ব্যাপারটির ওপর কোনো আলোকপাত দেখা যায় না।

লেখক : আইনবিষয়ক গবেষক, অ্যাডভোকেট

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট (বর্তমানে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বরত)

অর্থহীন হয়ে গেছে ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন

খালেদা জিয়ার প্রতীক্ষায় জাপানের চেরি ফুল

কপ-৩০ সম্মেলন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বন্দর ব্যবস্থাপনা : ভারতের বয়ানে সমালোচনা

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ফ্রন্ট মধ্য এশিয়া

জুলাই বিপ্লবের উচ্ছ্বাস ও সামনের কঠিন বাস্তবতা

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে কিছু প্রস্তাব

চক্রের ফাঁদে পড়েছে চীন আর ভারত

আসল বাউল নকল বাউল

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শঙ্কা