ঈশপের গল্পগুলো সাধারণত ছোট ও মজার। তার গল্পের প্রাণীরা কথা বলতে পারত। সেই ঈশপের গল্পের কাক ছিল মেধাবী। একদিন তৃষ্ণার্ত অবস্থায় সে একটি কলসিতে পানির খোঁজ পেল। পানি ছিল কলসির তলায়, বাইরে থেকে মুখ ঢুকিয়ে পানির নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না। সে একটার পর একটা নুড়ি পাথর কলসিতে ফেলতে লাগল। একসময় পানি কলসির উপরের দিকে উঠে এলে সে পানি পান করে তৃষ্ণা মেটাল। এ রকম মেধাবী কাক শিয়ালের চাতুরীর কাছে হেরে যেত। একদিন সে গাছের ডালে বসে ছিল। তার ঠোঁটে ছিল এক টুকরো পনির। ঠিক তখন এক ধূর্ত শিয়াল নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। কাকের ঠোঁটে পনিরটা দেখে তার জিভে জল এলো। ভাবল, ‘এই পনিরটা যদি কোনোভাবে পাওয়া যেত!’ তাই সে বুদ্ধি খাটাল। শিয়াল মিষ্টি গলায় বলল, ‘ওহে সুন্দর কাক! তোমার পালক কত চকচকে, দেখতে কত রাজসিক! নিশ্চয়ই তোমার গলা খুব সুমধুর। আমায় একটু গান শোনাও না ভাই!’ কাক মনে মনে খুশি হয়ে গেল। সে ভাবল, ‘আমার গান শুনতে চায়! আমি তো সত্যিই প্রতিভাবান!’ তাই সে মুখ খুলে গান গাইতে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে পনিরটা পড়ে গেল নিচে! শিয়াল সেটা মুখে নিয়ে হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ, মিষ্টি কণ্ঠের কাক! তোমার গানটা বেশ মধুর, কিন্তু বুদ্ধিটা কম!’ এ কথা বলেই সে পনির নিয়ে পালাল। কাক বুঝতে পারল ভুল হয়ে গেছে; তাই লজ্জায় মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। চাটুকারের কথায় ভুলতে হয় না কাক তা বুঝতে পারেনি।
ঈশপের গল্পের কাক আর শিয়াল কোন দেশের ছিল জানা নেই। তবে বাংলাদেশে প্রকৌশলবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত বুয়েটের শিক্ষকদের অবস্থা ঈশপের গল্পের কাকের মতোই। মেধার প্রশংসা শুনলেই তারা মুখ হাঁ করে ফেলেন আর পনির নিয়ে যায় অন্যরা। বুয়েটের একটা সুনাম আছে বটে; তবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার তেমন কোনো গল্প আজও তৈরি হয়নি। এখানে ভর্তি পরীক্ষাটা নিরপেক্ষভাবে হয়। ক্লাস ও পরীক্ষাগুলো যথাযথভাবে হয়। মেধার পরীক্ষায় প্রথম দিককার ছাত্ররা এখানে পড়াশোনা করে। অ্যালামনাইরা বিশ্বের সেরা জায়গাগুলোয় চাকরি করে। ব্যস! এতটুকুই। এত্থেকেই বুয়েটের একটি হাওয়াই ইমেজ তৈরি হয়েছে। বুয়েট হলো সব কাজের কাজি। তাই এ দেশে বড় প্রজেক্টে বুয়েটকে মাঝে মাঝে ডাকা হয় শুধু এই ইমেজটা ব্যবহার করার জন্য; কাজের কাজ করার জন্য নয়। আসলে বুয়েটের সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে এই দেশের কর্তাব্যক্তিদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বুয়েটে যারা চেয়ারে বসে আছেন, তাদের আগ্রহ আছে কি না, সেটিও পরিষ্কার নয়। বুয়েট দেশের সেরা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানÑএই প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অনুরোধে বুয়েট শিক্ষকদের এমন সব কাজে নিয়োজিত করা হয়, যা করার জন্য তাদের মতো মেধাবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তারপরও বুয়েটশিক্ষকরা ঈশপের গল্পের সেই কাকের গান গাওয়ার মতো বছরের পর বছর ধরে সেসব কাজ করে চলেছেন। অথচ দেশের প্রকৌশল খাতের প্রকৃত সমৃদ্ধির জন্য তাদের মেধা কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে না।
দেশের প্রযুক্তি খাতে শত শত ঘটনা ঘটে যায়, বুয়েটসহ স্থানীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয় না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তবেই তাদের ডাক পড়ে। বাংলাদেশের প্রকৌশল খাতের অবস্থা অনেকটা সেই হাসপাতালের মতো, যেখানে ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগীটি মরিয়া যায়’। ডাক্তার যখন আসেন, তখন কিছুই করার উপায় থাকে না। হাজার হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রজেক্ট হয়, বুয়েটকে ডাকা হয় না। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রজেক্ট হয়, বুয়েটকে ডাকা হয় না। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট হয়, বুয়েটকে ডাকা হয় না। বুয়েটকে ডাকা সম্ভব না হলে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদেরও সংযুক্ত করা যায়, সেটিও করা হয় না। বিদেশি পরামর্শক, বিদেশি কন্ট্রাক্টর কাজে অভিজ্ঞ হতে পারে। কিন্তু ঠিকমতো সুপারভিশন করা না হলে তাদের কাজে ত্রুটি থাকবেই। এর খেসারত দিচ্ছে জাতি। ফলে আমরা দেখছি, মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ বিআরটি প্রজেক্টটিই মুখ থুবড়ে পড়েছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট আমরা নিরাপদে পরিচালনা করতে পারব কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তবে বুয়েটশিক্ষকদের দিয়ে যে অকাজের কাজগুলো করিয়ে নেওয়া হয়, তার একটা হলো বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুসারে দরপত্র মূল্যায়ন করা। বুয়েটের শিক্ষকরা প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞ নন। তাদের ডাকা হয় শুধু তাদের উচ্চ নৈতিক অবস্থানের কারণে। ক্রয় প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হবে এই আশায়। এই কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের ডাকা দরকার নেই, ডাকা দরকার সৎ প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞদের। যখন জাতীয় পর্যায়ের কোনো প্রকল্পের সম্ভাব্য যাচাই সমীক্ষা হয় বা বিশদ প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয় কিংবা দরপত্রের শর্তাদি প্রস্তুত করা হয়, তখন যদি কমিটিতে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে কারিগরি বিষয় নিয়ে মতামত প্রদানের সুযোগ থাকে। ভালো অবদান রাখার সুযোগ থাকে। মজার ব্যাপার হলো, তখন তাদের ডাকা হয়েছেÑএমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। ডাকা হয় একদম শেষ মুহূর্তে দরপত্র মূল্যায়নের সময়, যখন কারিগরিভাবে অবদান রাখার কোনো সুযোগ থাকে না।
বুয়েটশিক্ষকদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া এমনই আরেকটি অকাজ হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনা করা। প্রশ্ন করা, খাতা দেখা, মেধা তালিকা তৈরি করাÑএই কাজগুলোয় বুয়েটের সততার দীর্ঘদিনের সুনাম থাকলেও প্রকৌশল চর্চার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই বললেই চলে। অথচ বুয়েটের প্রায় সব বিশেষজ্ঞ শিক্ষক আর কর্মকর্তা ছুটির দিনগুলো নষ্ট করেন নিয়োগ পরীক্ষার তদারকি করে। শিক্ষকরা তাদের সুন্দর বিকালগুলো পার করে দেন এসব খাতা দেখে দেখে। এই কাজগুলোয় যেই সামান্য আয় হয়, সেই পরিমাণ আয় গবেষণা থেকে হয় না, পেশাগত বিশেষজ্ঞ সেবা দিয়ে হয় না। কাজেই বুয়েটের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা আয় কমে যাওয়ার ভয়ে এই অকাজ ছাড়তে পারেন না। মেধার অপচয়ের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর হয় না।
এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। দেশের বড় প্রজেক্টগুলো ‘মরিয়া যাওয়ার পূর্বেই’ যাতে ডাক্তারের দেখা পায়, সেই ব্যবস্থা করা দরকার। বুয়েটসহ সরকারি-বেসরকারি খাতের যোগ্যতা সম্পন্ন প্রকৌশলীদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রজেক্টে সম্ভাব্য যাচাইয়ের পর্ব থেকেই বাধ্যতামূলকভাবে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে প্রবাসী বিশেষজ্ঞদেরও সম্পৃক্ত করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এতে প্রজেক্টের ব্যয় সামান্য বাড়লেও দেশ দুভাবে উপকৃত হবে। প্রথমত, দেশের পক্ষ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য যোগ্য জনবল থাকলে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও কন্ট্রাক্টরদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল হবে কম। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি হবে এবং পর্যায়ক্রমে প্রকৌশল খাতে বিদেশনির্ভরতা কমে আসবে।
আমাদের দেশে কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনায় সাধারণত প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। অথচ তাদের অনেকেরই প্রাথমিক পর্যায়ের কারিগরি জ্ঞানও থাকে না। দিনদিন প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়, প্রজেক্টের জটিলতা বাড়ে। ব্যবস্থাপনার জটিলতাও বাড়ে। কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনা সাধারণ ব্যবস্থাপনা থেকে ভিন্ন। তাই কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনার শীর্ষপর্যায়ে লাগসই কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন প্রকৌশলীদের সম্পৃক্ত করা না হলে সুপারভিশন ভালো হবে না। প্রজেক্ট শেষে নানা রকম কারিগরি ত্রুটি বের হয়ে আসবে; অথচ তখন কিছুই করার থাকবে না। কাজেই, এখন থেকে নিয়ম করা উচিত, যাতে সব কারিগরি প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনার শীর্ষপর্যায়ে যথাযথ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রকৌশলীদের সম্পৃক্ত করা হয়। দেশে এত শত শত প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের কার্যকর সক্ষমতা তৈরি না হওয়াটা দুঃখজনক। এই দুর্নাম যত তাড়াতাড়ি ঘুচবে, দেশ হিসেবে তত তাড়াতাড়ি আমরা এগিয়ে যাব।
লেখক: অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট।