তিস্তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাণ। এই নদীই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার দুই কোটি মানুষের জীবন, সংস্কৃতি আর অর্থনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে নীলফামারীর কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। এরপর এটি লালমনিরহাট, রংপুর ও গাইবান্ধার মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার, যার প্রায় ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশের অংশে, এর মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার ভাঙনপ্রবণ, বিশেষ করে প্রায় ২০ কিলোমিটারে পরিস্থিতি ভয়াবহ। কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলায় টানা ভাঙন চলছে, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধাতেও দেখা যাচ্ছে ভাঙনের চিত্র। তিস্তার ১০০ কিলোমিটার উজানে ১৯৭৫ সালে চালু হওয়া গজলডোবা ব্যারাজের ওপর দিয়ে পাশের দেশ ভারতের নিয়ন্ত্রিত জলপ্রবাহের কারণে তিস্তা বর্ষায় ভারী ঢলে উন্মত্ত থাকে আর শুষ্ক মৌসুমে দেখা যায় বিরানশূন্য মরুভূমির মতো শুকনো চরের বিস্তৃতি। কখনো মাঠ-ঘাট, ফসলি জমি আর বাড়িঘর ডুবিয়ে দেওয়া বন্যা, কখনো মাটির ফেটে যাওয়া খরা, এই দুইয়ের মাঝখানে আটকে আছে তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষ।
বিগত বছরগুলোয় পর্যাপ্ত পানির আভাবে ২৪০ বছরের পুরোনো তিস্তা শুধু নাব্যই হারায়নি, বরং এর তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে কমে গিয়েছে নদীর পানি ধারণের ক্ষমতাও। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ৫ হাজার কিউসেক হওয়ার কথা থাকলেও ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০০ কিউসেকে, ফলে প্রতিবছর ব্যাহত হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। তিস্তা অববাহিকায় শুধু কৃষিই নয়, নদীর শুকিয়ে যাওয়ায় বিলীন হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম এবং বন্ধ হয়ে গেছে নদীনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা। এর প্রভাবে চরম সংকটে পড়েছে জেলে ও মাঝিসহ তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা। রিভারাইন পিপলের গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিবছর তিস্তার ভাঙন ও প্লাবনে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে উত্তরের ৫ জেলার বাসিন্দা। এছাড়া বাড়ছে বাস্তুভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যাও। বর্ষাকালে ঘন ঘন বন্যা, পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ নদীভাঙন আর শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকটে ফসল উৎপাদনে বিপত্তির কারণে বহু বছর ধরে ভোগতে থাকা এই প্রান্তিক মানুষদের কণ্ঠ থেকেই এবার উঠে এসেছে, ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ আহ্বান।
গত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর, তিস্তা অববাহিকার প্রায় ১০৫ কিলোমিটারজুড়ে মশাল প্রজ্বালন কর্মসূচি হয়। নদীর দুই তীরে, চরাঞ্চলে, রাস্তার মোড়ে কৃষক, জেলে, ছাত্র নির্বিশেষে অত্র অঞ্চলের কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এই মশাল মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেয়, দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশের নিয়ন্ত্রিত জলপ্রবাহের বিরুদ্ধে। তাদের সবার মুখে একটাই কথা, ‘নদী বাঁচলে বাঁচবে জীবন’। এর আগে গত ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি তিস্তার দুই তীরে ৫ জেলার ১১টি পয়েন্টে একযোগে অবস্থান কর্মসূচি পালন, ৫ অক্টোবর জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি পাঠানোসহ ৯ অক্টোবর উপজেলা শহরগুলোয় গণমিছিল হয়েছিল। ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’-এর সূত্রে জানা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গত ৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তাপাড়ে এক গণশুনানিতে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করার আশ্বাস দেন। তার ভাষ্যমতে, ১০ বছরের মেয়াদে দুই ধাপে বাস্তবায়িত এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। প্রথম ধাপে ৫ বছরে ৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা চীন থেকে ঋণ হিসেবে এবং বাকি ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা দেওয়া হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবিরোধের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৮৩ সালে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি হলেও তা সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর হয়নি, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পানির ৮০ শতাংশ সমানভাবে ভাগ করার প্রস্তাব দিলেও অনুমোদন দেয়নি ভারত। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে তিস্তাচুক্তি সম্পন্ন হয়নি, ২০১৪ সাল থেকে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করলে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও রংপুরের গঙ্গাচড়ায় বন্যা, খরা ও ভাঙনের ত্রিমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর উত্তরাঞ্চলের মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের অধীনে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মডেলে তিস্তার দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। চীনের প্রস্তাবিত ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে—১. নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে, ২. বন্যার পানি গ্রামাঞ্চল প্লাবিত করবে না, ৩. সারা বছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণ করা যাবে। এছাড়া প্রকল্পে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, ২২০ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর, কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ সংরক্ষণ, প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন এবং নৌবন্দর, থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, ১৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, ইপিজেড, ইকোনমিক জোন, বনায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে ৭-১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও থাকবে।
৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই তিস্তার গল্প ভারত-বাংলাদেশের জলবণ্টন রাজনীতির গল্প, সরকার ২০২১ সালে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ তৈরি করে, যাতে নদী পুনরুদ্ধার, বাঁধ মেরামত, ড্রেজিং এবং কৃষি উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা ছিল। কিন্তু চার বছর কেটে গেলেও কাজ শুরু হয়নি। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, বিদেশি অর্থায়নের জট আর আমলাতান্ত্রিক ধীরগতিতে প্রকল্পটি এখন কাগজেই আটকে আছে। তিস্তা বাঁচানো শুধু নদী পুনরুদ্ধার নয়, এটি আমাদের ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। প্রথমত, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল কৃষিনির্ভর। সেখানে পানির ন্যায্য ভাগ না পেলে খাদ্য নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে। দ্বিতীয়ত, তিস্তা অববাহিকার ৩০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদী মারা গেলে, তারা বাস্তুচ্যুত হবে, যেমনটা ইতোমধ্যে অনেকে হয়েছে। তৃতীয়ত, এটি আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও বটে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মানে এই নয় যে, জনগণের জীবনবিষয়ক অধিকার বিসর্জন দিতে হবে।
সমাধান একটাই, রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার বদলাতে হবে। তাই বিদেশি সহায়তার অপেক্ষা না করে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ অবিলম্বে শুরু করতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিস্তা নদী ঘিরে পানির অভাব ও ভাঙনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে, পাশাপাশি নদীর অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক গুরুত্ব পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা যাবে। স্থানীয় পর্যায়ে নদীর তীর সংরক্ষণ, বিকল্প সেচব্যবস্থা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন, এই তিনটি উদ্যোগ একসঙ্গে চালাতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে; পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একটি নদী যখন শুকিয়ে যায়, তখন শুধু পানি হারায় না, হারায় ইতিহাস, হারায় ভাষা, হারায় তার প্রাণ, তিস্তা আজ সেই সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। তাই আজকের ডাক, ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’। এই ডাক নদীর জন্য নয়, আমাদের তিস্তাপাড়ের মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, কারণ, নদী হারালে আমরা নিজেরাই হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাবে এই অঞ্চলের মানুষের গৌরবময় অতীত, ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
লেখক : কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী
rafsanraj.cu@gmail.com