১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীর দুই পর্বের সাক্ষাৎকার আমার দেশ-এ প্রকাশিত হয়েছে। এই সাক্ষাৎকার পড়ে অনেকেই জানতে চেয়েছেন জিয়া হত্যায় ভারত ও শেখ হাসিনা জড়িত থাকার কথা সেখানে নেই কেন? পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, জিয়াউদ্দিন তার লেখা বই এবং আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি। তবে তিনি বলেছেন, জিয়া হত্যাকাণ্ড একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল এবং এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পক্ষ এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল জড়িত। তার মতে, জিয়া হত্যার বিচার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের জন্য দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। একটি সামরিক তদন্ত কমিটি এবং অন্যটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। সামরিক তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ৩৩ জন সেনা অফিসার এবং দুজন জুনিয়র কমিশন অফিসারকে (সুবেদার পদের) অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে তিনজন অফিসার পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে কোর্ট মার্শালে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ২০ জনের মধ্যে ৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড (৬ থেকে ১০ বছর) এবং বাকিদের চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এ বিচার নিয়ে বিতর্কও আছে।
অন্যদিকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন জিয়া হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যে রিপোর্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের কাছে জমা দিয়েছিলেন, সেই রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। এ সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ রিপোর্টটি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে দেননি এবং এটি তিনি বঙ্গভবন থেকে গায়েব করে দেন।
সাবেক জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী আমাকে বলেন, সরকারগুলোর বিশেষ করে বিএনপি সরকারের উচিত ছিল বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুর হত্যা দুটির গভীরে গিয়ে আসল ষড়যন্ত্র উদঘাটন করে একটি প্রতিবেদন দেওয়া। এর উদ্দেশ্য প্রকৃত সত্য সাধারণের সামনে তুলে ধরা। এ প্রসঙ্গে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। কেনেডি হত্যার পর গঠিত হয়েছিল ওয়ারেন কমিশন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হত্যাকারীদের সঙ্গে আর কেউ জড়িত ছিল কি না। আর্ল ওয়ারেন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি। কেনেডি হত্যার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না, সেই সত্য উদঘাটন করাও ছিল ওয়ারেন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে। সত্য উদঘাটন করার জন্যই এটি করা হয়েছিল। জিয়াউদ্দিনের মতে, জিয়া হত্যার ক্ষেত্রেও বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন সঠিকভাবে তদন্ত করে থাকলে আমরা জানতে পারতাম বাইরের দেশ ভারত কিংবা শেখ হাসিনা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন কি না।
জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী সঠিক বলেছেন, জিয়া হত্যাকাণ্ড যে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল এবং এটি যে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, তা সে সময়কার ঘটনাবলি থেকে প্রমাণিত হয়েছে। জিয়াউদ্দিন না বললেও এর সঙ্গে যে ভারত এবং শেখ হাসিনারও যোগসাজশ থাকতে পারে, তা বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্যে এসেছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার শিকার হন। তিনি যেদিন নিহত হন, সেদিন শেখ হাসিনা বোরকা পরে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠেছে, তার যদি সামান্য সংশ্লিষ্টতাও না থাকবে, তাহলে তিনি পালাতে গিয়েছিলেন কেন? আর এরশাদ যে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত এ কথা চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী যেমন বলেছেন, তেমনি খালেদা জিয়া এবং কর্নেল অলিসহ অনেকে বলেছেন। জেনারেল এরশাদ পাকিস্তানফেরত একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন।
বাংলাদেশে আসার পর তাকে ভারতের দেরাদুনে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। তার সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সংস্পর্শে তাদের অনুগত চরে পরিণত হয়েছিলেন। জিয়া হত্যার পর সেনাপ্রধান এরশাদ মাত্র এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। তখন বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন—‘আই অ্যাম নট আন হ্যাপি’। এরশাদের ক্ষমতা দখলে ভারতও খুশি হয়েছিল। বিএনপি সরকারকে তখন ক্ষমতা থেকে হটানোই ছিল ভারত ও শেখ হাসিনার লক্ষ্য। সামরিক ও বেসামরিক অনেক বিশ্লেষকেরই পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এরশাদ ভারতের ক্রীড়নক হয়েই কাজ করেছেন। জিয়া হত্যা এবং বিএনপি সরকারকে হটিয়ে এরশাদের ক্ষমতা দখল ভারতীয় এবং শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল।
পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষ লক্ষ করেছে শেখ হাসিনা, এরশাদ ও ভারতের মধ্যে সখ্য কতটা। ১৯৮৬ সালে এরশাদের নির্বাচনে বিএনপিসহ সাত দল ও পাঁচ দল অংশ না নিলেও শেখ হাসিনা অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল এবং এরশাদ শেখ হাসিনার সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেন। জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলায় এরশাদ প্রধান আসামি ছিলেন। শেখ হাসিনা এ মামলার ভয় দেখিয়ে এরশাদকে জিম্মি করে রাখেন। শেখ হাসিনার ইশারায় চলেছেন এরশাদ। শেখ হাসিনা যা বলেছেন তাই করেছেন। এরশাদ মারা যাওয়ার পর মঞ্জুর হত্যা মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পান।
শেখ হাসিনার অপরাধ ও ট্রাইব্যুনালের বিচার
ভারতে পলাতক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় কবে ঘোষণা করা হবে, তা ১৩ নভেম্বর ২০২৫ জানা যাবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল গত ২৩ অক্টোবর এই বিচারকাজ শেষ করে এবং রায়ের তারিখ জানানোর জন্য ১৩ নভেম্বর দিন ধার্য করে। এই রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে এই রায়কে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। এই নাশকতার পরিকল্পনার সমন্বয় করা হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত থেকে। এ জন্য নয়াদিল্লিতে অফিসও ব্যবহার করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে ঘন ঘন সভা হচ্ছে। ভারতে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা, আওয়ামী সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশের লোকেরা নাশকতা সমন্বয় করছেন বলে গণমাধ্যমের রিপোর্টে এসেছে। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন গণহত্যা মামলার রায় ঘোষণা ভন্ডুল করে দেওয়ার জন্য ১০ নভেম্বরের পর থেকে বড় ধরনের নাশকতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিকল্পনা মোকাবিলার জন্য দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে আরো কঠোর এবং সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।
শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের সর্বনাশ করে ছেড়েছিলেন। ১৯৮১ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবসনের পর থেকে এদেশের জনগণ ও বিরুদ্ধ মতের ওপর তার অপরাধ ছিল সীমাহীন এবং নিষ্ঠুর। ১৯৯১ সালের পর থেকে তিনি যেমন নানা অপরাধে জড়িত, তেমনি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেও বড় বড় অপরাধ করেছেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় তিনি যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তার কোনো নজির নেই। ট্রাইব্যুনালে এই মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে যুক্তি উপস্থাপন করে তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী এবং প্রধান স্থপতি’ ছিলেন শেখ হাসিনা। সমগ্র অপরাধের প্রাণভোমরা ছিলেন তিনি। তার ভাষায়, ‘একটি হত্যার জন্য যদি একটি মৃত্যুদণ্ড হয়, তবে ১৪০০ হত্যার জন্য শেখ হাসিনাকে ১৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। কিন্তু যেহেতু এটি মানবিক দিক থেকে সম্ভব নয়, তাই আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’ তবে শেখ হাসিনার প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি না দেখানোরও অনুরোধ জানান তিনি। গত জুলাই-আগস্ট ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নির্দেশে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালিয়ে ১৪০০ মানুষকে হত্যা এবং ২৫ হাজারকে আহত করে। শেখ হাসিনা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং সামরিক বাহিনীকে আন্দোলন দমন করতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালাতে সরাসরি নির্দেশ দেন। তিনি হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালাতেও নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনা এত বড় অপরাধ এবং গণহত্যা চালালেও এখন পর্যন্ত অপরাধ স্বীকার করেননি এবং দেশের মানুষের কাছে এর জন্য সামান্য অনুশোচনাও করেননি। সম্প্রতি তিনি রয়টার্স, এএফপিসহ কিছু মিডিয়ায় লিখিত সাক্ষাৎকারে অপরাধের দায় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপান। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন সামলাতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য ভুল করেছিলেন। তবে তিনি নির্দেশদাতা ছিলেন না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, শেখ হাসিনার নির্দেশের অডিও-ভিডিও প্রমাণ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর তিনি বাহিনীগুলোর যেসব অনুগত কর্মকর্তাকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারাও পলাতক এবং ভারতে তার সঙ্গেই রয়েছেন। এরা এখনো নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ জন্যই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘অপরাধের প্রাণভোমরা’ (নিউক্লিয়াস বা মাস্টারমাইন্ড) এবং প্রধান স্থপতি হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রসিকিউশনের যুক্তি হলো, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান দমনে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সব রাষ্ট্রীয় বাহিনী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং দলীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ব্যবহার করেন। যেহেতু শেখ হাসিনা এসব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তার সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন তিনি।
আইসিটিতে শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ হিসেবে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এই অভিযোগপত্রে তার বিরুদ্ধে পাঁচটি প্রধান অভিযোগ আনা হয়। শেখ হাসিনার কমান্ড রেসপনসিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় প্রমাণ করার জন্য যেসব প্রমাণ জমা দেওয়া হয়, তার মধ্যে রয়েছে, শেখ হাসিনা এবং তার ভাতিজা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মধ্যে কথোপকথনের প্রতিলিপি (ট্রান্সক্রিপ্ট) এবং অডিও রেকর্ডিং জমা দেওয়া হয়েছে। এই কথোপকথনে শেখ হাসিনাকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিতে শোনা যায়। দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থান থেকে মোবাইল ফোনে ধারণ করা গুলি চালানো, হত্যাকাণ্ড এবং মৃতদেহ গুমের ভিডিও ক্লিপ জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রনেতা আবু সাঈদ হত্যা এবং যাত্রাবাড়ী ও রামপুরায় সংঘটিত অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ফুটেজও রয়েছে। সরকারি নথির মধ্যে পুলিশ ওয়্যারলেস বার্তায় আক্রমণের নির্দেশনা, হেলিকপ্টার এবং ড্রোন চলাচলের লগ বা রেকর্ড, হাসপাতালের রেকর্ড, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের কার্যকলাপের প্রমাণ, ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি, বিবৃতি, আশুলিয়ায় মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার প্রমাণ, আলামত ইত্যাদি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী কর্মকর্তার জমা দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান দমনে তিন লাখেরও বেশি রাউন্ড গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে হালকা মেশিন গান (এলএমজি), সাবমেশিন গান (এসএমজি), চায়নিজ রাইফেল এবং অন্যান্য প্রাণঘাতী অস্ত্র। কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটের চেয়ে প্রাণঘাতী অস্ত্র বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ১২টি পুলিশ স্টেশনে করা ১০০টি মামলা বিশ্লেষণ করে জানা যায়, শুধু এসব এলাকায় ৪ হাজার ৬৩৪ রাউন্ড গুলি এবং ১৬টি হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। র্যাব কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, হেলিকপ্টার থেকে ৭৩৮টি কাঁদানে গ্যাসের শেল, ১৯০টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮টি পুলিশ স্টেশন থেকে ৮২ হাজার ২৫৮ রাউন্ড গোলাবারুদ লুণ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে রাইফেল, এসএমজি এবং এলএমজি রয়েছে। এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ক্যাডাররা থানা থেকে নিয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে লাগিয়েছে।
অফিস অব দ্য হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) দ্বারা প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার রিপোর্টে ২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সময় শেখ হাসিনার সরকার ব্যবস্থাগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং এই ঘটনাগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য। রিপোর্টে বলা হয়, ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ১৪০০ মানুষ নিহত হয়। এদের বেশির ভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। এর ১২ থেকে ১৩ শতাংশই শিশু। রিপোর্টে বলা হয়, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তাকর্মীদের সমন্বয়ে ও নির্দেশে এই দমন কার্যক্রম চলে। নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগের সশস্ত্র সদস্যরা মিলেমিশে বিক্ষোভ দমন করেছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা পুলিশের আড়ালে লুকিয়ে বা পাশে দাঁড়িয়ে আক্রমণ করেছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলার শুনানি ট্রাইবুন্যালে দীর্ঘদিন চলেছে। আগামী ১৩ নভেম্বর বিচারিক প্যানেল রায়ের তারিখ ঘোষণা করবে। এ সময় নাশকতা ও অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা সংশ্লিষ্টরা করবে। দোসরদের নাশকতার প্রচেষ্টা ঐক্যবদ্ধভাবে নস্যাৎ করা এখন জরুরি। এ ক্ষেত্রে জুলাই বিপ্লবের সবার মধ্যে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ থাকতে হবে—এটাই দেশপ্রেমিক মানুষ আশা করে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ
Abdal62@gmail.com