বাংলাদেশের মানুষ কি কখনো কল্পনা করেছে, যাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হবে, তার গলাতেই পড়াতে হবে ফাঁসির দড়ি। ১৯৮১ সালে নির্বাসন ভেঙে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফিরে আসা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্থান–পতনের এই দীর্ঘ পথচলা শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এক ভয়াল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে। যার ছায়া ছড়িয়ে পড়ে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবন পর্যন্ত। দুই দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে ছিলেন তিনি। কিন্তু সর্বশেষ টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের তার শাসনামলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, গুম-খুন, অর্থপাচার, ভোটহীন নির্বাচন আর ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দাঁড়ানো শাসন—সব মিলিয়ে এক অন্ধকার অধ্যায়ের জন্ম দেয়। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জনবিস্ফোরণ আর অসহায় প্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনার পতন ঘটে, আর ইতিহাসে যুক্ত হয় এক দুঃসহ সমাপ্তি—ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায়টি সিলমোহর পায়।
১৯৮১ সালের ১৭ মে, দলের হাজার হাজার কর্মীদের ফুলেল শুভেচ্ছায় শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার বাংলাদেশের জীবন। তবে হাসিনা ফেরার মাত্র ১২ দিন পরই, ৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এরপর কিছু দিন ক্ষমতায় থাকেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকার। তবে আরেকটি অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন হয় এরশাদের এবং ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান বিচারক শাহাবুদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর পরও নির্বাচনে ভরাডুবি হয় শেখ হাসিনার। তবে তারপর তত্ত্বাবধায়কের উপর ভর করে আওয়ামী লীগ প্রথম রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০৯ সাল থেকে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাছে লজ্জাজনক পরাজয় হয় হাসিনার। তার দল মাত্র ৬২টি আসন পায়। তারপরের ২০০৮ সালে ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ব্যাপক ভোটে জয় লাভ করেন। আর এই সময়ই ফ্যাসিস্ট হওয়ার পথ শুরু হয় হাসিনার।
নির্যাতনের নয়া অধ্যায়
মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম ‘শেখ হাসিনার দুঃশাসন’ গ্রন্থে ডেইলি স্টারের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, ১৯৯৬-১৯৯৮ এ তিন বছরে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০ জনের বেশি ছাত্রীকে বলৎকার করা হয়েছে এবং ৩০০ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের একটি সিরিজ। আন্দোলনের সূচনার ঘটনাটি ছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন তাদের নেতা সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন মানিকের ১০০তম ধর্ষণের উদযাপন করেন। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাস হতে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ২১ মাসে ১৭৪৩ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিথেকে ১৯৯৮ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ৪০৮৯টি খুন, ২৩১০টি ধর্ষণ, ২৪৮৪টি রাহাজানি এবং ১৩৭টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৭ সালের ধর্ষিতদের মধ্যে ৩৯১ জন ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালিকা। খোদ পুলিশের দ্বারা ৬ বছরের তানিয়া ধর্ষিত হয়েছে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে! প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া তার ‘ধর্ষিতা বাংলাদেশ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ১৯৯৭ সালের ফেব্রয়ারিতে ১১১টি ধর্ষণের অভিযোগ থানায় নথিভুক্ত করা হয়েছিল। পরের মাসে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৬৫টি।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি
১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজার তথা শেয়ার বাজারে ডেকে এনেছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। যার কষাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে ছিল হাজার হাজার পরিবার। শত শত যুবক হয়েছিল সর্বস্বান্ত, দিশেহারা। ২১ বছরের জঞ্জাল দূর করার নামে দেশকে আরো জঞ্জালময় করে তুলে ছিল আওয়ামী বাকশালীরা। ১৯৯৬ সালের পরও হাসিনা সরকার থাকাকালে অসংখ্যবার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ঘটেছিল ২০১১ সালে। পুঁজিবাজারে গুজব, আতঙ্ক আর অস্থিরতার সঙ্গে বিক্ষোভ, অবরোধ, ভাঙচুর, অব্যাহত ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে ২০১১ সাল। সেবার লোকশানের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে অনেক বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত, লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা পিলখানা হত্যাকান্ড। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির এ ঘটনা বাংলাদেশকে বিদীর্ণ করে। কী নৃশংসভাবে ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছিল, তা ভাবলে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই গা শিউরে ওঠার কথা। বিদেশি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে সারা সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের জন্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে শেখ হাসিনা।
ইসলাম বিদ্বেষী রাজনীতি
ইসলাম বিদ্বেষী হাসিনা সরকারের আমলে আলেম-উলামাদের বিরুদ্ধে বহুরকম নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছিল। আলেম-উলামাদের জন্য সে সময়টি ছিল সাক্ষাৎ জাহান্নাম। একের পর এক আলেম-উলামাদের ওপর চালানো হয়েছে নিপীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন এবং হত্যার ষড়যন্ত্র। ক্ষমতার লোভে, ভারতের দালালি করতে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার প্রশাসনকে ব্যবহার করেছে ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলো দমন করার জন্য। জঙ্গি তকমা দিয়ে মেরেছে নিরপরাধ সাধারণ মুসলিমদের। দাঁড়ি, টুপি কিংবা সালাম দেওয়াকে জঙ্গি হওয়ার বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে হাসিনা আমলে।
শাপলা চত্বরে ছাত্র-জনতাকে দমন
২০১৩ সালে ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে রাতের আঁধারে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্রাশফায়ার ও পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। রাষ্ট্রীয় মদতে তাদের হত্যা করা হয়। এসময় আওয়ামী শাসনের আসল রূপ উন্মোচিত হয়। বহু তাওহিদী জনতা শাহাদাত বরণ করেন, অসংখ্য আহত ও নিখোঁজ হন। শেখ হাসিনার প্রশাসন রাতের অন্ধকারে শত শত আলেমকে হত্যা করে, যার প্রকৃত সংখ্যা আজও গোপন করা হয়।
ভোটবিহীন চারটি নির্বাচন
২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত, শেখ হাসিনা দেশে চারটি ভোটহীন নির্বাচন করে ক্ষমতা দখল করে ক্রমে স্বৈরাচার হয়ে ওঠে। এসময়ের নির্বাচনগুলোর আগে গণআটক, নির্বাচনের আগের রাত্রে ব্যালট বাক্সে ভোট ভরে রাখার মতো ঘটনারও স্বাক্ষী হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বালুর ট্রাক ছিল হিরো। বালুর ট্রাক দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনকে আটকে রাখা হয় গুলশান অফিসে। সেবার বিনাভোটে ১৫৪ জন সংসদে গিয়েছেন। এর পরে ঐতিহাসিক ২০১৮ সালের নির্বাচন। কিন্তু এর আগেই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। আর ২০২৪ সালের নির্বাচন তো তারা নিজেরাই নিজেরাই করল। যেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বনাম আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র।
সাগর-রুণি হত্য ও গণমাধ্যম
দেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ড। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সময় গণমাধ্যম ছিলো পরাধীন। হাসিনার বিপক্ষে কিছু বললে বা লিখলেই সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসতো অত্যাচার, করা হতো গুম-খুন। সেসময় হাতেগোনা কিছু গণমাধ্যম ছাড়া সকলই পা চাটতো হাসিনার। তবে গণমাধ্যমের উপরও স্টিম রোলার চালিয়েছে হাসিনা। আমার দেশ, দিগন্ত, চ্যানেল ওয়ানের মতো জনপ্রিয় গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরেছিল হাসিনা। গত ১৫ বছরে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভিন্নমতের সাংবাদিকদের দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে কালো আইন তৈরি করে। এ আইনের কয়েকটি ধারা ব্যবহার করে মানুষের বাকস্বাধীনতাকে হরণ করেন শেখ হাসিনা। বহু বছরে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপ, হত্যা, গুম করা হয়।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ
হাসিনার আমলে যারাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করত তাদের সকলেরই টুটি চেপে ধরা হত। ২০১৮ সালে আনা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশে কুলুপ দেওয়া হয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললেই মানহানি, স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, মিথ্যা তথ্য প্রচার সহ আরো বিভিন্ন অভিযোগে শাস্তি পেত হত তাকে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার হরণই সাধারণ জনগনকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলে।
গুম ও হত্যা
হাসিনার শাসনামলে গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যা যেন প্রতিদিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল। যারা সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতির বিরোধিতা করত তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল আয়নাঘর। হাসিনা আমলে মাত্র ১ ব্যক্তি নিজের হাতে গুম হওয়া ১০৩০ জন মানুষকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটসের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৬২৩ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে, ১৫ বছরের শাসনামলে গুমের শিকার হয়েছেন ৭৩০ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ৮৩ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ফেরত না আসা ব্যক্তির সংখ্যা ১৬২। তবে এখনো অনেক গুম এবং খুনের কথা আসে নি। ভিন্ন মতের কেউ হলে খুন করে লাশ গুম করা হতো। আয়নাঘর তৈরি করে সেখানে বছরের পর বছর মানুষকে আটক রাখা হতো। পরিবার লাশের অপেক্ষা করেও কোনো হদিস পেত না। এছাড়া অনেক পরিবার বছরের পর অপেক্ষা শেষে সংসার পেতেছিল।
দুর্নীতি ও অর্থপাচার
দুর্নীতিই ছিল আওয়ামী লীগের মুলনীতি। সিন্ডিকেট, ঘুষ বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, মাদক চোরাকারবার, জমি দখল, ব্যাংক দখল, চাঁদাবাজি, অর্থপাচারসহ দুর্নীতির সকল সেক্টরই ফুলেফেঁপে উঠেছিল হাসিনার আমলে।
ব্যাংক দখল ও কেলেঙ্কারি
হাসিনার আমলে নানা কায়দায় ব্যাংক হতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। ঋণের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়েছে আওয়ামী ফেবারিট ব্যবসায়ী ও ব্যাংক মালিকরা। আর ব্যাংক দখলের মতো নতুন ঘটনার জন্ম হয়েছে এই হাসিনা আমলেই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০২৪ সাল অব্দি যা বেড়ে দাড়ায় এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়।
বিচারহীনতা
একতরফা শাসনামলে বিচারব্যবস্থার নাজেহাল অবস্থা করে ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা। যেসব বিচার দ্রুত করলে তার দলের সুবিধা হত সেসব বিচারই প্রাধান্য পেত আদালতে। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। পাশাপাশি রানা প্লাজা ভবন ধ্বস কিংবা তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ডের মতো তোলপাড় করা ঘটনার বিচার না হলেও নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতাদের বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য রাতের বেলায়ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বিচারের নামে প্রহসন করে দেশের সাধারণ জনগনের ক্ষোভ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
ধনী- বৈষম্য বৃদ্ধি
শেখ হাসিনার পতনের অন্যতম বড় কারণ ছিল বৈষম্য। তার আমলে ধনীরা আরো বেশি ধনী হয়েছে এবং গরীবদের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে নেমেছে। অর্থনৈতিক উন্নতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার নামে বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জিভূত করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের একটি রিপোর্ট অনুসারে, দেশের সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশ মানুষের হাতেই দেশের মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ পুঞ্জিভূত রয়েছে। অন্যদিকে গরীবদের কাঁধের ওপর অতিরিক্ত কর, নিম্ন মজুরি ইত্যাদি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার পরিণত হয়েছিল ভিলেনে।
নির্লজ্জ দলীয়করণ এবং নামকরণের রাজনীতি শুরু হয়েছিল এই আমলেই। শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের শেষের দিকে, তার গঠিত সরকার প্রণীত একটি আইনের অধীনে ১ টাকা টোকেন মূল্যে তাকে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন বরাদ্দ দেন। যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং তিনি নির্বাচনের আগে গণভবন ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ফুলেল বরণে শুরু হওয়া যাত্রা শেষ পর্যন্ত রূপ নিলো এক দুঃস্বপ্নের ইতিহাসে। যেখানে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হত্যা, গুম, দমন-পীড়ন আর ভোটবিহীন নির্বাচন ছিল নিত্যকার অস্ত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয়করণ, গণমাধ্যমকে স্তব্ধ করে দেওয়া, ছাত্র-জনতার বুক তছনছ করা গুলিবৃষ্টি, আর বিরোধী কণ্ঠকে আয়নাঘরে বন্দী করে রাখার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার শাসন পরিণত হয়েছিল এক অনবরত ভয়ের যুগে।
অবশেষে সেই অন্ধকারের জাল ছিঁড়ে যখন মানুষ রাস্তায় নেমে দাঁড়াল, ইতিহাসও তার বিচার করল। ৫ আগস্টের পতন ও ভারতে পলায়ন ছিল সেই দীর্ঘ দুঃশাসনের শেষ দৃশ্য আর ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ পৃষ্ঠা।