স্বৈরাচার পতন-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আবার এসেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বিজয় আল্লাহর বিশেষ দান। যখন কোনো জাতি বিজয় লাভ করে এবং পৃথিবীতে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তখন একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হওয়া উচিত, ইসলাম সে বিষয়ে স্পষ্ট পথ দেখায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো-
বিনম্রচিত্তে কৃতজ্ঞতা
বিজয়কে কখনো মানুষের নিছক কৌশল বা সামরিক শক্তির ফল মনে করা উচিত নয়। এটি সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহর বিশেষ দান, তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের ফসল। পবিত্র কোরআনে ‘ফাতহ’ বা বিজয় নামে আল্লাহতায়ালা একটি সুরাও অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।’ (সুরা ফাতহ : ১)
ঈমানদার ব্যক্তি বিজয়কে আল্লাহর ইচ্ছার প্রকাশ মনে করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, “যারা দৃঢ় বিশ্বাস করে যে আল্লাহর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে, তারা বলত—‘কত ক্ষুদ্র দল আল্লাহর হুকুমে বড় দলের ওপর জয়ী হয়েছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’” (সুরা বাকারা : ২৪৯)
তাই বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা না হয়ে, একজন মুমিনের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো—এই বিশাল নিয়ামতের জন্য আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায় করা এবং ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি লোকদের দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি স্বীয় রবের স্বপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করতে থাকবেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল।’ (সুরা নাসর : ১-৩)
এই আয়াত প্রমাণ করে, বিজয়ের উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে বিনয় ও আল্লাহর স্মরণই মুমিনের পরিচয়। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (সা.) শুকরিয়াস্বরূপ আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেছিলেন। (জাদুল মায়াদ, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম)
বিনয়ের প্রকাশ ও ঔদ্ধত্য পরিহার
বিজয় লাভের পর একজন মুমিনের জন্য অপরিহার্য হলো—বিনয়ী হওয়া এবং অহংকার ও ঔদ্ধত্য পরিহার করা। বিজয় যেন কোনোভাবেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা দম্ভ প্রদর্শনের উপলক্ষ না হয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ওই পরকালীন নিবাস আমি তাদের দেব, যারা জমিনের বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম আল্লাহভীরুদের জন্য।’ (সুরা কাসাস : ৮৩)
মক্কা বিজয়ের দিনে রাসুল (সা.)-এর আচরণ ছিল এই বিনয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। জীবনের এক চরম প্রতিকূলতার পর বিজয়ীর বেশে জন্মভূমিতে ফিরেও তিনি বিনয়ে এতটাই অবনত ছিলেন, তাঁর মাথা প্রায় হাওদার সঙ্গে লেগে যাচ্ছিল। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/২৯৩) নবীজি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ক্ষমতার আসনে বসলেও বিনীত থাকতে হয়।
সাম্য ও মানবিকতার অঙ্গীকার
বিজয় লাভের পর সমাজে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কোরআনে করিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি ও পরহেজগার।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)
বিদায় হজের ভাষণে প্রিয় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারি) এই শিক্ষা জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে। এই ভাষণে তিনি সব ধরনের বৈষম্য ও বেইনসাফ বিলোপের ঘোষণা দিয়েছেন।
কোরআনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা
বিজয়কে স্থায়ী করতে এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে আল্লাহর দেওয়া আইন ও বিধান সমাজে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। কর্তৃত্বের আমানত হলো—রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তাঁর অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তারা এমন যে, আমি তাদের পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকর্মের আদেশ দেবে ও অসৎকার্য থেকে নিষেধ করবে। আর সবকিছুর পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।’ (সুরা হজ : ৪১)
অন্যত্র আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা.)-কে পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি মহান আল্লাহ! যিনি তাঁর রাসুল (সা.)-কে পাঠিয়েছেন হিদায়াত সঠিক পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন পরিপূর্ণ জীবন-বিধানসহকারে, যাতে তিনি তা সব বিধানের ওপর বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন, সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা ফাতহ : ২৮) মহান আল্লাহর দেওয়া সঠিক পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন এবং বিধিবিধান বাস্তবায়ন করলেই শুধু সেই ভূখণ্ডে শান্তি ও বরকত নেমে আসে।
ক্ষমতাসীনদের প্রতি বার্তা
বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা বিজয়ের পর শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের করণীয় সুস্পষ্ট ছিল। বিশেষত জুলাই ২৪-পরবর্তী সময়ে, দেশের শান্তি, নিরাপত্তানৈতিকতার উন্নতিতে এবং শরিয়াহ প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করা আমাদের সবার জন্য অপরিহার্য ছিল। সিরিয়া ও আফগান থেকেও শেখার এবং নেওয়ার ছিল অনেক কিছু। কিন্তু এর পরিবর্তে দেখা দিল, সংকীর্ণতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নিঃসন্দেহে যা বিজয়ের বরকত নষ্ট করার শামিল।
স্বদেশপ্রেম ও স্থিতিশীলতা
মনে রাখতে হবে, বিজয় ধরে রাখা একটি চলমান সংগ্রাম। সমাজে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করা হলে বা আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠায় অবহেলা হলে বিজয় স্থায়ী হয় না, বরং তা ধ্বংস ডেকে আনে। আল্লাহ সতর্কবাণী দিয়েছেন, ‘আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন তার ঐশ্বর্যশালী লোকদের আদেশ করি। কিন্তু ওরা সেখানে অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়, ফলে সেই জনপদের ব্যাপারে (শাস্তির) কথা অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দিই।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ১৬)
আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু ক্ষমতা অর্জন নয়, বরং ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠাই হলো মুমিনের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। আল্লাহতায়ালা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করুন এবং আমাদের তাঁর বিধানের প্রতি অবিচল থাকার তৌফিক দিন—আমিন।
লেখক : সিনিয়র পেশ ইমাম, বুয়েট সেন্ট্রাল মসজিদ