১৪ ডিসেম্বর, রোববার। প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের উদ্বোধন।
১৫ ডিসেম্বর, সোমবার। এদিনও খেলা হলো। তবে মোটে একটি ম্যাচ মাঠে গড়াল। অথচ এদিন সূচি অনুযায়ী পাঁচটি ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। সোমবার রাতেই জানিয়ে দেওয়া হলো এই লিগ স্থগিত করা হয়েছে। পরের রাউন্ডের খেলা আপাতত আর হচ্ছে না।
এই দুদিনের লিগে কোনো দলের হারজিত বা কোনো ক্রিকেটারের হাফ সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরি বা উইকেট শিকারের খবরের চেয়ে বড় অংশজুড়ে থাকল লিগ বয়কট, ওয়াকওভার এবং ক্রিকেটারদের একরাশ হতাশা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে কথা, বাক্যবান, গোষ্ঠীবদ্ধ পেশিশক্তি এবং আদর্শহীন ইগোর লড়াইয়ে লড়ছেন এখন ক্লাব সংগঠক ও বিসিবির পরিচালকরা। একসময় একই টেবিলে বসে রাতদিন যারা ক্রিকেট আড্ডায় দিন গুজরান করতেন, এমনকি ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতেন, সেই তারাই এখন একে অন্যের চেহারা দেখা তো দূরের কথা, নামটি পর্যন্ত শুনতে চান না!
কী আশ্চর্য এই রূপান্তর! ক্ষমতার চেয়ার-গদি এমনই লোভনীয় যে, এটা শুধু সম্পর্কই নষ্ট করে- তা নয়; খুব সাধারণ পর্যায়ের নীতি-নৈতিকতার অবস্থান পর্যন্ত গিলে খেয়ে ফেলে!
৬ অক্টোবর বিসিবির বিতর্কিত, অস্বচ্ছ, ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রভাবে আচ্ছন্ন এবং ই-ভোটিং জালিয়াতির ভোট প্রক্রিয়া দেশের ক্রিকেট সংগঠকদের বিশ্বাস, ভালোবাসা ও মর্যাদার সম্পর্ককে নষ্ট করে দিয়েছে। আর এ অভিযোগে ৪৪টি ক্লাব সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এমন জোচ্চুরির ভোট তারা মানে না। এ প্রক্রিয়ায় যারা নিজেদের নির্বাচিত দাবি করছেন, তারা অবৈধ। আর অবৈধ বোর্ডের অধীন কোনো ক্রিকেটে এই ক্লাবগুলো কোনো ধরনের অংশগ্রহণ করবে না। প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের ২০টি ক্লাবের মধ্যে আটটি এই লিগ বর্জন করে সেই ক্ষমতার প্রদর্শনও দেখিয়েছে। বিসিবিও এমন অভিযোগ সয়ে নিয়ে ১২ দলকে নিয়ে লিগ আয়োজন করে। কিন্তু ১০ ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিনটি আয়োজনে তাদের ‘কৃতিত্ব’ (!) জানিয়ে দিল-এভাবে ক্রিকেট চলে না। দুই পক্ষের এমন দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী এখন দেশের ক্রিকেট আর ক্রিকেটাররা।
দিন কয়েক আগে ক্লাব ক্রিকেটের সংগঠকরা জোর গলায় বলেছিলেন, ‘বিসিবি নয়, ক্লাব চাইলে লিগ হবে।’
ক্ষমতা প্রদর্শনে জোরাজুরি করে বিসিবি একতরফা জেদে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে লিগ শুরু করল। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই সেটা স্থগিত করতে বাধ্য হলো। বিধিবিধান জানাচ্ছে, যে ক্লাবগুলো এই লিগ বয়কট করেছে তাদের অবনমন হবে, তারা দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যাবে।
সেটাও যে এ সমস্যার আদর্শিক সমাধান নয়, বরং সংকট আরো বাড়াবে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দ্বন্দ্ব আর ক্ষমতার টানাপোড়েনে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট আজ লাইফ সাপোর্টে ধুঁকছে! সংগঠকদের দাবি, তারাই ক্রিকেটার তৈরি করেন। তারাই ক্রিকেটের বড় স্টেকহোল্ডার। তারা চাইলে লিগ হবে, নয়তো নয়। বিসিবির চেয়ারে বসা কিছু পরিচালক কদিন আগেও এসব ক্লাব সংগঠকের বন্ধু ছিলেন; এখন তারা ক্ষমতা ও চেয়ারের গরমে গলায়ও উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। উভয় পক্ষের এই লড়াইয়ে দেশের ক্রিকেট কাঠামোর মূল শিকড় আজ ঝুঁকির মুখে। প্রথম বিভাগের ২০ দলের মধ্যে ৮টি লিগ বয়কট করেছে। এই সংখ্যা আরো বহুগুণ বাড়বে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ লিগে। ঘরোয়া ক্রিকেটের এই কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সার্বিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। তখন শুধু লাইফ সাপোর্ট দিয়েও ক্রিকেট বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ক্লাব সংগঠক বনাম বিসিবির পরিচালকদের এই দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছেন ক্রিকেটাররা। লিগ না হলে তাদের আয়ের পথ সংকুচিত হবে। তখন তারা খেলবেন কোথায়? নিজের পারফরম্যান্স দেখানোর উপায়ই-বা কী?
তৃণমূলের মূল কেটে ক্রিকেট বনায়নের বোকা চেষ্টায় নেমেছে বিসিবি!
প্রশ্ন হলো, কার এবং কাদের স্বার্থে বলি হচ্ছে দেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটাররা? ‘ক্রিকেট ভালোবাসি’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলছে উভয় পক্ষ। কিন্তু সেই ‘সম্পদশালী ভালোবাসাকে’ বগলদাবা করতে বোর্ডের নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চেয়ার আঁকড়ে রাখার জমিদারি, জালিয়াতি ও প্রভাবী আচরণ এমন সব অসততাকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে উত্তর একটাই- ক্রিকেট প্রেম এখানে নেহাৎ একটা স্লোগান এবং ধাপ্পাবাজি। ব্যক্তিগত ক্ষমতার স্বার্থসিদ্ধির পথ পরিষ্কার করতে ক্রিকেট এখন অনেকের কাছে কেবল মুখোশ মাত্র! আর এখানে নিত্যদিন প্রতারিত হচ্ছেন ক্রিকেটাররা।
‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’-এই শব্দটি সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বাংলায় এর আভিধানিক অর্থ হলো ‘আনুষঙ্গিক ক্ষতি’। কোনো দেশে বা স্থানে সামরিক অভিযানে বেসামরিক বা সাধারণ মানুষ এবং তাদের সহায়-সম্পত্তির অনিচ্ছাকৃত ক্ষতিকে বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে। আরেকটু সহজ ভাষায় বললে- সামরিক অভিযানের সময় ভুলবশত কোনো বেসামরিক বাড়ি বা নিরীহ মানুষের মৃত্যু হলে তাকে ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ বলা হয়ে থাকে।
বিসিবি বনাম ক্লাবের দ্বন্দ্ব আর ক্ষমতার লড়াইয়ে সেই কোলাটেরাল ড্যামেজ হচ্ছেন ক্রিকেটাররা। যেসব ক্রিকেটারের কেবল একটাই নিরীহ ইচ্ছেÑক্রিকেট খেলা। কিন্তু তারা আজ অযাচিত যুদ্ধের ফল ভোগ করছেন!
বিসিবি কি জানে না, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অধঃপতনও ডেকে আনে!