বাবা শেখ খালেদ ব্রেন স্ট্রোক করে চার বছর ধরে বিছানায়। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। পরিবারে দুই বোন, এক ভাই ও বাবা-মা। পাঁচজনের সংসারে আশার আলো বন্যা আক্তার, বর্তমানে পরিবারের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। কাঁধে পরিবারের ভার তুলে নেওয়া ফরিদপুরের মেয়ে বন্যা এবার তুললেন দেশের পতাকার ভার। এই তরুণীর ধনুক থেকে ছোড়া তীরেই এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে কম্পাউন্ড ইভেন্টে প্রথমবার রৌপ্য পদক লক্ষ্যভেদ করল বাংলাদেশ। বন্যার সঙ্গে জুটিতে ছিলেন আরেক আর্চার হিমু বাছাড়।
সাধারণ পরিবার থেকে বন্যায় উঠে আসা। ছোটকাল থেকেই আর্চারির দিকে ঝোঁক ছিল তার। তীর-ধনুকের খেলায় ৯ বছরের ক্যারিয়ার বন্যার। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রথমবার এশিয়ান পদক মঞ্চে উঠেই তীর ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করেছেন রুপা। বড় মঞ্চে ক্যারিয়ারের সেরা স্কোর করে প্রথম রুপা জেতার পর বন্যা নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, ‘শুরুর দিকে চাপ ছিল। কারণ এমন বড় মঞ্চে খেলছি। একটু নার্ভাস ছিলাম।’
একই সঙ্গে আফসোস ঝরেছে তার কণ্ঠে। দেশের আর্চারিতে কম্পাউন্ড ইভেন্ট অবহেলিত বলেই এই আর্চারের যত আক্ষেপ। তবে কিছু করার প্রতিজ্ঞা ছিল। জেদ থেকেই সাফল্যের আনন্দ জানিয়ে বন্যা আরো বলেন, ‘আমাদের ইভেন্ট (কম্পাউন্ড) সব সময় অবহেলিত। এটা গতকালও বলছিলাম যে আমরা অবহেলিত, এবার দেখিয়ে দেব। সেটা করতে পেরেছি। এটাই আমার সেরা রেজাল্ট।’
পরিবারের আশার আলো বন্যা। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পরিবার থেকে সব সময় সমর্থন পেয়েছেন বলেই তাই এত দূর আসতে পেরেছেন তিনি। পরিবারকে সহযোগিতা করতে পেরে গর্বিত এই আর্চার। এই পথে বন্যার পাশে থেকেছে বাংলাদেশ আনসার ও বিমানবাহিনী। আগে আনসারে চাকরি করলেও সম্প্রতি চুক্তিভিত্তিক হিসেবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে খেলছেন। একসময় বাবা তাকে পথচলায় সহযোগিতা করেছেন আর এখন তিনি নিজেই পরিবারের ভার কাঁধে তুলে গর্বিত, ‘আমার খারাপ লাগে না। বরং মেয়ে হয়ে বাবাকে আর্থিক সাহায্য করতে পেরে আমার ভালো লাগে। আমি গর্বিত।’
লড়াকু এই আর্চারের চোখ দেশের গণ্ডি ছড়িয়ে বিশ্বমঞ্চে। ২০২৮ সালে অলিম্পিকে কম্পাউন্ড মিশ্র ইভেন্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বন্যার আশা বাংলাদেশ সরাসরি অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করবে, ‘আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন আমরা সরাসরি অলিম্পিকে খেলব।’
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের দিকে তাকালে লড়াইয়ের অসংখ্য গল্পের দেখা মেলে। নারীদের ক্ষেত্রে এই পথ আরো কণ্টকাকীর্ণ। যে পথ ধরে আগানো বন্যাদের একটি পদক জয় স্রেফ অর্জনেই সীমাবদ্ধ করা যাবে না। এ যেন লড়াকু নারী যোদ্ধার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। সংসারের ভার, বাবার অসুস্থতা, পেশার অনিশ্চয়তার মাঝেও বন্যা দেখিয়েছেন দৃঢ়তা আর দেশের জন্য কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। বন্যার এই সাফল্য নতুন প্রজন্মের নারী খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা জোগাবে বলেই বিশ্বাস। তীর-ধনুকে সাফল্যের সীমান্ত ছুঁয়ে ফেলুক হিমালয়, এই তো আশা।