ছয় বছর আগে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ছোট গ্রাম বারিশা রাতারাতি বিশ্ব সংবাদে উঠে এসেছিল। ২০১৯ সালের অক্টোবরে মার্কিন কমান্ডো অভিযানে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর নেতা আবু বকর আল-বাগদাদীকে এই গ্রামেই হত্যা করা হয়। আজ, সেই গ্রাম আবারও আলোচনায়— তবে এবার ভিন্ন কারণে।
বারিশার বাসিন্দা রশিদ মুহাম্মদ কাসির এখনও সেই রাতের স্মৃতিতে কেঁপে ওঠেন। “আমি ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো সিরিয়ান সেনা হেলিকপ্টার জরুরি অবতরণ করবে,” তিনি বলেন। “কিন্তু বুঝতে পারিনি, ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর নেতা আবু বকর আল-বাগদাদীকে আমেরিকানরা খুঁজে পেয়েছে।”
সেই রাতে আমেরিকান ডেল্টা ফোর্সের সদস্যরা আল-বাগদাদীর লুকিয়ে থাকা ঘাঁটি ঘিরে ফেলে। বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ আর চিৎকারে কেঁপে ওঠে গোটা গ্রাম। পরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন— “সে কুকুরের মতো মারা গেছে।” সেই অভিযানকে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের অন্যতম প্রতীকী সাফল্য হিসেবে ধরে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু ভাগ্যের চাকা অদ্ভুতভাবে ঘুরে গেছে। আজ সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন আহমেদ আল-শারা— যিনি একসময় আল-বাগদাদীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নামে পরিচিত ছিলেন।
২০১৩ সালের দিকে আল-বাগদাদীর সঙ্গে মতবিরোধের পর আল-শারা নিজের পথ বদলান। ধীরে ধীরে তিনি সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহী শক্তির অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করে তিনি রাষ্ট্রপতির আসনে বসেন, যা সিরিয়ার পাঁচ দশকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়।
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আল-শারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন চেহারায় হাজির হন— পরিচ্ছন্ন পোশাক, কূটনৈতিক ভাষা, মধ্যপন্থী ভাবমূর্তি। মে মাসে তিনি সৌদি আরবে ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। এ সপ্তাহে তিনিই হয়েছেন প্রথম সিরিয়ান নেতা যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো হয়েছে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রান্ডা স্লিম বলেন, “এটি এক ইতিহাসের মোড়— ট্রাম্প যিনি একসময় আল-শারার বস আল-বাগদাদীকে হত্যা করেছিলেন, আজ তিনিই আল-শারাকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।”
১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে সিরিয়ায় এখন আপাত শান্তি। বারিশার মতো গ্রামগুলোতে মানুষ নতুন আশার কথা বলছে। কাসির বলেন, “আল-শারা ভালো কাজ করছেন। আমরা অনেক স্বস্তি পাচ্ছি।” তবে রাজনৈতিক মন্তব্যে সাবধান তিনি। হেসে বলেন, “ভুল উত্তর দিলে ট্রাম্পই আটক করবে!”
যুদ্ধের দাগ অবশ্য এখনো মুছে যায়নি। আল-বাগদাদীর প্রাক্তন বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। কাসির আশা করেন, তাঁর বাড়ির ক্ষতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিছু ক্ষতিপূরণ দেবে। “হেলিকপ্টারটা আমার মাথার ওপরে ছিল, সেই শব্দ এখনো কানে বাজে,” তিনি বলেন।
ইদলিবে এখন আল-শারার দল হায়াত তাহরির আল-শামের সাদা পতাকা উড়ছে— যেটি একসময় মার্কিন তালিকায় সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল। আজ সেই পতাকাই নতুন সিরিয়ার প্রতীক।
দামেস্কে নিযুক্ত এক পশ্চিমা কূটনীতিক জানান, আল-শারা গত কয়েক বছর ধরে ইসলামিক স্টেট ও আল-কায়েদা নেতাদের অবস্থান জানাতে মার্কিন গোয়েন্দাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন বলে ধারণা করা হয়। এটি কি ২০১৯ সালের আল-বাগদাদী অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিনা, তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না।
এখন বারিশায় সন্ধ্যা নামে, আজানের ধ্বনি ভেসে আসে মসজিদ থেকে। একসময় যেখানে মৃত্যু ঘিরে ছিল, সেখানে আজ হাসি, জলপাই বাগান আর নতুন ভবিষ্যতের আভাস।
সেই রাতের ভয়াবহতা থেকে শুরু করে আজকের ওয়াশিংটন সফর— সিরিয়ার বারিশা থেকে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত এ যেন এক অবিশ্বাস্য যাত্রা।
সূত্র: নিউ ইর্য়ক টাইমস
এমইউ