‘যে সাপ আপনার জন্য গান গাইতে চায় সে মূলত আপনাকে পরিমাপ করে যে, এটি আপনার কতটা কাছ থেকে ছোবল মারতে পারে।’ এটি একটি প্রাচীন আফ্রিকান প্রবাদ, যেখানে বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে। কারণ যখন কোনো দেশের জনগণ বিশ্বাস করে বিদেশিদের গল্পের ফাঁদে পা দেয়, তখন তারা তাদের বিচারবোধ এবং সার্বভৌমত্ব উভয়ই হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে।
এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ ঘোষণার প্রেক্ষিতে নাইজেরিয়াও সেই একই পথে হাঁটছে। যেখানে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ ছাড়াই নাইজেরিয়াকে একটি উদ্বেগের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর অলিক অভিযোগ করা হয়েছে, নাইজেরিয়ার খ্রিস্টানরা একটি গণহত্যার অভিযানের শিকার। ট্রাম্পের এই ভিত্তিহীন অভিযোগ, আবেগপূর্ণ বক্তৃতা মূলত হস্তক্ষেপের হুমকি দ্বারা সমর্থিত। যা ইতোমধ্যে নাইজেরিয়ার ভঙ্গুর কাঠামোকে আরো উস্কে দিতে পারে।
ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, নাইজেরিয়ার সরকার যদি খ্রিস্টানদের হত্যার অনুমতি দিতে থাকে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে নাইজেরিয়াকে দেওয়া তাদের সমস্ত সাহায্য এবং সহায়তা বন্ধ করে দেবে। প্রয়োজন হলে সরাসরি সৈন্য পাঠিয়ে ওই ইসলামি সন্ত্রাসীদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
তার কথাগুলি সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর মধ্যকার অবিশ্বাসকে আরও গভীর করে তুলে। কেননা এই মানুষগুলোই বছরের পর বছর ধরে জাতিগত-ধর্মীয় ক্ষত থেকে নিরাময়ের জন্য লড়াই করছে।
ইরাক থেকে লিবিয়া, আফগানিস্তান থেকে সোমালিয়া, আমেরিকার আক্রমণ জাতিগুলিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। যার ফলাফল হয়েছে আগের চেয়েও খারাপ। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা কিংবা মানবিক উদ্বেগের নামে প্রতিটিকে আক্রমণকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ধুলো যখন স্থির হয়ে যায়, তথাকথিত মুক্তির মধ্যে জন্ম নেয় বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু এবং দশকের অস্থিতিশীলতা।
আবার এই ধরনের তথাকথিত উদ্বেগেকে উপেক্ষা করে ভিন্নভাবে চলা মূলত চলমান ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করা।
স্বার্থসিদ্ধির জন্য তথ্য বিকৃতি
নাইজেরিয়ায় ‘খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা’ সম্পর্কে ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বাস্তবতার আলোকে চরম বিকৃতিপূর্ণ। বাস্তব তথ্যে বরং অন্যরকম ইঙ্গিত দেয়। তথ্যগত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নাইজেরিয়ায় চলমান সহিংসতার মধ্যে রয়েছে - বোকো হারাম, ডাকাতি, পশুপালক-কৃষক সংঘাত বা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। যেখানে- অনেক মুসলিমের প্রাণহানি ঘটেছে, যার সংখ্যা প্রায়শই খ্রিস্টানদের চেয়েও বেশি। উত্তর-পূর্বের সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। মুসলিম পণ্ডিতদের হত্যা করা হয়েছে। এমনকি মুসলিম প্রধান এলাকার কৃষকরা বছরের পর বছর ধরে তাদের জমিতে প্রবেশ করতে পারেনি।
নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনী অসংখ্য চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে এবং পুরো শহর খালি করে ফেলেছে। তবুও তখন কেউ- বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তিগুলো - কখনও এটিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা বলেনি।
নাইজেরিয়া এক জটিল নিরাপত্তা সংকটে ভুগছে। এটিকে একতরফাভাবে ধর্মীয় নির্মূল হিসেবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা মূলত নির্বাচনি ধারণা এবং মিডিয়ার কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং বলা যায়, এটি আরো বেশি খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করবে। কেননা, এটি নাইজেরিয়ানদের একে অপরের বিরুদ্ধে, বিশ্বাসকে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, নাগরিককে নাগরিকের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবে। অথচ এই সময়ে ঐক্য এবং বোঝাপড়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।
নাইজেরিয়ার সীমানার বাইরে তাকালে এসব ভণ্ডামি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
গাজার ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ৩ নভেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত, গাজায় নিহত মানুষের ৬৮,৮৫৮ জনেরও বেশি এবং ১,৭০,৬৬৪ জনেরও বেশি আহত হয়েছে, অথচ গাজায় জনসংখ্যা মাত্র ২২ লক্ষ।
তবুও ট্রাম্প গাজাকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে ঘোষণা করেননি। তিনি সেখানে কোনে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাননি। কেন? কারণ ক্ষতিগ্রস্তরা মূলত মুসলিম। তাদের দ্বিচারিতা এবং নৈতিক অসঙ্গতি স্পষ্ট, তারা যেন এ ব্যাপারে বধির।
সত্যিকারার্থে বলা যায়, আমেরিকা নিজেই দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ছদ্মবেশে মুসলিম প্রধান দেশগুলির বিরুদ্ধে এক ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে আসছে। এসব অভিযানের সুন্দর নামও দিয়েছে - সন্ত্রাসবাদ দমন, শান্তিরক্ষা, মানবিক উদ্ধার।
নাইজেরিয়াকে এখন সেই খেলার পরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে, এটি উচিত নয়। নাইজেরিয়াবাসীকে চলমান সংঘাতের অর্থ নিজেদেরই খুঁজে বের করা উচিত। এটি কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণ করার জন্য কোনোভাবেই অন্য কোনও পরাশক্তির আখ্যানকে অনুমতি দিতে পারে না।
নাইজেরিয়া একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর সরকার বরাবরই খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার দাবি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখান করেছে। কোনও বিদেশি নেতা, যতই শক্তিশালী বা উচ্চকণ্ঠা হোক না কেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নাইজেরিয়ার আঞ্চলিক সীমানার মধ্যে সামরিক অভিযান চালানোর অধিকার রাখেন না। এটা করা হবে আগ্রাসনের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
এই সময়ে, নাইজেরিয়ানদের আবেগী না হয়ে বরং সমালোচনা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চিন্তা করতে হবে। আসল বিপদ কেবল ট্রাম্পের বাগ্মীতা নয় বরং এটি হচ্ছে নিজেদেরকে প্রকৃতঅর্থে বিশ্বাস করার ইচ্ছা। কারণ জ্ঞানীরা বলেন, ‘বাইরের কেউ যখন তোমাকে বলে, তোমার মায়ের স্যুপ তোমার চেয়ে সুস্বাদু, তখন সে কেবল তোমার চামচের জন্যই হাত বাড়ায়।’
তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের নিবন্ধ। অনুবাদ করেছেন মাহফুজ রহমান।