নিউমোনিয়া এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) মারা গেছেন ৮৪ বছর বয়সী সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। তার মারা যাওয়ার খবরে রাজনৈতিক মহলসহ গণমাধ্যমের বিভিন্ন স্তর থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলির ঝড় উঠেছে। বিল ক্লিনটন এবং কমলা হ্যারিসের মতো ডেমোক্র্যাটরাও চেনির জীবনের প্রশংসা করেছেন। ক্লিনটন চেনির অটল কর্তব্যবোধের প্রশংসা করেছেন, অন্যদিকে হ্যারিস তাকে ‘জনগণের সেবায় একজন নিবেদিতপ্রাণ’ বলে অভিহিত করেছেন।
মূলধারার আমেরিকান সংবাদমাধ্যমগুলোও চেনিকে সম্মান জানিয়েছে, যিনি ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি ১৯৭০-এর দশকে হোয়াইট হাউসের চিফ অফ স্টাফ এবং ১৯৮০-এর দশকে প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এমএসএনবিসি-এর জো স্কারবোরো বলেছেন, ‘চেনি, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তার নীতিমালা বজায় রেখেছিলেন... তিনি সঠিক পক্ষে ছিলেন... আমাদের সকলেরই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।’
অন্যদিকে, নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে ‘ওয়াশিংটনের একজন পরিপূর্ণ অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করেছেন, যিনি ‘বিদেশে গণতন্ত্র পৌঁছানোকে’ এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।
এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে, চেনিকে একজন ভালো মানুষ ভেবে কেউ তাকে ক্ষমা করতে পারে, অথবা কেউ করতে পারে-না জানার কারণে, যে চেনি হচ্ছেন আধুনিক বিশ্বে ভয়াবহ নৃশংসতা চালানোর দায়ে একজন কঠোর যুদ্ধাপরাধী।
যুদ্ধের স্থপতি
সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট চেনি মূলত ছিলেন একজন যুদ্ধের স্থপতি। বুশের সময় মার্কিন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল স্থপতি হয়ে ওঠেন তিনি। যার মধ্যে ছিল ২০০২ সালের আফগানিস্তানে আক্রমণ, ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ব্যাপক গোয়েন্দা, নজরদারি এবং নির্যাতন কর্মসূচি। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত বিষয় ছিল- ইরাক আক্রমণের অজুহাত হিসেবে চেনি, বুশ প্রশাসনকে নির্জলা মিথ্যা তৈরি করতে সহায়তা করেছেন।
প্রথমত, চেনি এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, যা তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন। আক্রমণের আগে চেনি বলেছিলেন: ‘কোনো সন্দেহ নেই যে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে এখন গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে...আর এগুলো যে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য সংগ্রহ করছেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই ।"
দ্বিতীয়ত, এছাড়া চেনি প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের সঙ্গে আল-কায়েদার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে বলে মত দিয়েছিলেন। যেখানে, আল-কায়দাকে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে হামলার জন্য দায়ী মনে করা হয়। এমনকি চেনি ইরাক আক্রমণের পূর্বেই এই সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি এর ওপর আরো জোর দেন। ২০০৪ সালে, চেনি বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার মনে হয় আল-কায়েদার সঙ্গে ইরাকি সরকারের সম্পর্ক রয়েছে এবং এর প্রচুর প্রমাণও রয়েছে।’
অবশেষে, সেই প্রচুর প্রমাণ প্রকাশ হয়েছে যে, সাদ্দাম হুসেনের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না, এমনকি এই তথ্যও তৎকালীন প্রশাসনের জানা ছিল। একইভাবে, সাদ্দাম এবং আল-কায়েদার মধ্যেও কোনো যোগসূত্র ছিল না।
অথচ চেনির সমর্থকরা জোর দিয়ে বলছেন, ইরাক আক্রমণে গোয়েন্দা সিদ্ধান্তের ব্যর্থতার ফল। কিন্তু ডেভিড কর্ন, জুয়ান কোল, স্কট রিটার কিংবা হাওয়ার্ড জিনসহ অসংখ্য সাংবাদিক এবং বিশেষজ্ঞরা দৃঢ়ভাবে দেখিয়েছেন, প্রমাণের বিরুদ্ধে অনুমান টিকে না।
চেনি যে মিথ্যা বলছিলেন, সেটির আরও বিশ্বাসযোগ্য উপসংহার হলো- প্রতিরক্ষা সচিব থাকাকালীন সময় থেকেই চেনি ইরাক আক্রমণ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
তার অবস্থান ছিল নব্য রক্ষণশীলতার প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত। এটি এমন এক বিশ্বাস, যেখানে ধারণা করা হয় যে, আমেরিকা যদি অন্য দেশগুলোতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাদের আমেরিকার মতো বানিয়ে ফেলে, তাহলে পৃথিবী আরও ভালো হবে।
এক নিরন্তর যুদ্ধ
ইরাক আক্রমণে চেনির ভূমিকা সবচেয়ে অপরাধমূলক। বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি এ যুদ্ধের ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘এটি শতাব্দীর আক্রমণাত্মক যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক, আর একজন শক্তিশালী প্রার্থী দ্বারা ৩০ বছরের মধ্যে সংঘটিত সবচেয়ে খারাপ অপরাধের একটি’।
২০১৩ সালে পিয়ার-রিভিউ জার্নাল PLOS মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ইরাকে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ বলে অনুমান করেছিল।
পরবর্তীতে ২০২৩ সালে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, ইরাক আক্রমণ এবং এর সাথে সম্পর্কিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ অভিযানে ৪৫ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। যেখানে তথ্য-উপাত্ত হিসেবে জাতিসংঘের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এর পরিসংখ্যানে প্রায় দশ লাখ সরাসরি মৃত্যু এবং ৩৫ লাখের পরোক্ষ মৃত্যু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও গবেষণায়, যুদ্ধগুলিতে ৭,০০০ মার্কিন সেনা এবং ৮,০০০ ঠিকাদারও নিহত হওয়ার তথ্য রয়েছে।
আক্রমণের পরবর্তী সময় ইরাকে গৃহযুদ্ধও শুরু হয়েছিল। যেখানে ইসলামিক স্টেট নামে একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, বলা হয় এটি আল-কায়েদার চেয়েও বেশি উগ্রপন্থি গোষ্ঠী।
ইরাক যুদ্ধে চেনির ভূমিকা, অন্ধকার এবং ভয়াবহ ভাবমূর্তি জন্য তাকে ‘ডার্থ ভাডার’ নামে পরিচিত করে তুলেছিল।
নজরদারি এবং নির্যাতন
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, চেনি ছিলেন রিপাবলিকান প্রশাসনের প্যাট্রিয়ট আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) অনুসারে, ৯/১১-পরবর্তী সময়ে এই আইন, দেশের নাগরিকদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।
এসিএলইউ, প্রতিনিয়ত নাগরিকদের সন্দেহভাজনে পরিণত করার জন্য প্যাট্রিয়ট আইনের নিন্দা করেছে। এই আইনটি, অন্যান্য অসাংবিধানিক বিধানগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে সরকারি প্রতিনিধিদের বিচারিক অনুমোদন ছাড়াই ব্যক্তিগত ফোন এবং কম্পিউটার রেকর্ড পেতে অনুমতি দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি, চেনি ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালের হামলার পর আমেরিকার নির্যাতন কর্মসূচি তৈরিতেও সহায়তা করেছিলেন। এর প্রেক্ষিতে, চেনি বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে "অন্ধকার দিক" নিয়ে কাজ করতে হবে। আর এই মন্তব্যটি প্রশাসনের নির্যাতন এবং জোরপূর্বক গুম কর্মসূচির একটি নির্দেশ হিসাবে বোঝানো হয়েছিল।
চেনি এবং অন্যরা স্বীকার করেছেন, কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে এর মতো কারাগারগুলোতে নির্যাতনের ভয়াবহ কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল। এগুলোকে গোপন ব্ল্যাক সাইট বলা হতো। এর মধ্যে ওয়াটারবোর্ডিংও ছিল, যেখানে বন্দিদের মুখে রুমাল দিয়ে পানি ঢেলে দেওয়া হতো, যা ডুবে যাওয়ার মতো কষ্টদায়ক ছিল। প্রশাসন সন্দেহভাজনদের আঘাত করত, তাদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখত, তাদের ঘুম ও খাবার থেকে বঞ্চিত করত এবং তাদেরকে তীব্র গরম ও ঠান্ডার মধ্যে রাখা হতো।
বেশিরভাগ বন্দিকেই কোনও অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই আটক রাখা হয়েছিল। এমনকি চেনি হেবিয়াস কর্পাসও স্থগিত করতে সহায়তা করেছিলেন। এটি এমন একটি আদেশ যার মাধ্যমে আটককারী কর্তৃপক্ষকে আদালতের সামনে ওই ব্যক্তিকে হাজির করতে বাধ্য করা হয়, যেন আদালত আটকের বৈধতা যাচাই করতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, চেনিসহ বুশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যে নৃশংস অপরাধের জন্য দোষী তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। ২০১১ সালে, ওয়াচডগ গ্রুপটি ভ্যাঙ্কুভার সফরের সময় চেনির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনতে কানাডিয়ান সরকারকে উৎসাহিত করেছিল। চেনি আইনি কাঠামোর সংস্কৃতি এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার সরাসরি দৃষ্টান্ত আবু গারিব কারাগার। যেখানে ইরাকি বন্দিদের নগ্ন এবং নির্যাতিত করার মর্মান্তিক চিত্র উঠে এসেছিল।
অনুশোচনাহীন লিগ্যাসি
এত কিছুর পরও চেনি ছিলেন ভাবলেশহীন। ইরাক আক্রমণের জন্য কখনো কোনও অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। যদিও এর ফলে ইরাকের নাগরিক, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল। বুশ প্রশাসন যদিও এই যুদ্ধকে পরবর্তীতে একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে স্বীকৃত দিয়েছিল, তদুপরি চেনি তখনো সেই আক্রমণকে নির্জলা সমর্থন করেন।
২০১৫ সালের ফক্স নিউজের এক সাক্ষাৎকারে, তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি "ইরাক সম্পর্কে সঠিক" ছিলেন।
একইভাবে, চেনি যে নির্যাতন কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে বিষয়েও তিনি কোনো রকম অনুতপ্ত ছিলেন না।
২০১৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে, তিনি ওয়াটারবোর্ডিং ছাড়াও তার অনুমোদিত জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতিগুলিকে গর্বের সাথে সমর্থন করেন। তিনি বলেছিলেন, "তিনি এক মিনিটের মধ্যেই তা আবার করতে পারেন।
এমনকি তিনি "ডার্থ ভাডার" ডাকনামটিও খুব সহজেই গ্রহণ করে বলেছিলেন, এই তুলনাতে তিনি সম্মানিত। অথচ ডার্থ ভাডার মন্দের প্রতিনিধিত্ব করে।
গত কয়েক বছর ধরেই চেনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছিলেন। তার যুক্তি ট্রাম্প আমেরিকান গণতন্ত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছেন। অথচ চেনিই সেই স্বৈরাচারী রাজনৈতিক কাঠামোর স্থপতি যার উপর ভর করে চলছে বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসন।
যেখানে অভিবাসী এবং সন্দেহভাজনদের প্রতি ট্রাম্পের নিষ্ঠুরতার মধ্যে রয়েছে (ইমিগ্রেন্টস কাস্টম এফোর্সমেন্ট) আইসিই অভিযান, গণহারে আটক এবং সমুদ্রে তথাকথিত মাদক নৌকায় বোমা হামলা। এগুলো সবই সেই কর্তৃত্ববাদী শাসন যা স্বাভাবিক করতে সাহায্য করেছিলেন চেনি।
বুশ-যুগের নির্যাতন শিবির এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ড্রোন হত্যা অভিযানের মতোই, ট্রাম্পের নীতিগুলোও একই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু লোকের অধিকার কেড়ে নেওয়া যেতে পারে, যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদের লক্ষ্যবস্তু করা যেতে পারে এবং এমনকি তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণও করা যেতে পারে।
তাহলে চেনির আসল লিগ্যাসি কেবল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তৈরিতে মিথ্যার মধ্যেই নয়, বরং তিনি যে রাজনৈতিক ও নৈতিক অবকাঠামো রেখে গেছেন তাতেও নিহিত।
দুই দশকেরও বেশি সময় পরে, ৯/১১-পরবর্তী সময়ে তার পরিচালিত বিশ্বব্যবস্থা এখনো টিকে আছে। যেখানে তার দেখানো বিরামহীন যুদ্ধ, সরকারি আগ্রাসন এবং দায়মুক্তির পথে হাঁটছে আজকের যুদ্ধাপরাধীরা আর ঠিক মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মতোই।
মিডল ইস্ট আই-এর নিবন্ধ। অনুবাদ করেছেন মাহফুজ রহমান।