অপারেশনের আগে রোগীর সম্মতি

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ০৯: ০০

যেকোনো অপারেশনের আগে রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভয় বা দুশ্চিন্তা কাজ করে। এ ভয় অমূলকও নয়। কারণ সার্জারি মানেই কাটাছেঁড়া, অজ্ঞান থেকে জ্ঞান ফিরবে কি না, সেই চিন্তা মাথায় কাজ করে। তা ছাড়া অপারেশনের ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিয়া কী, কী কী ধরনের অ্যানেসথেসিয়া হতে পারে, কী সতর্কতা প্রয়োজন বা কোন সার্জারিতে এর গুরুত্ব কতটা, সেই সম্পর্কে ধারণা নেই অনেকেরই। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগী ও চিকিৎসকের সম্পর্ক শুধু তথ্যপ্রদান বা প্রেসক্রিপশননির্ভর নয়—বরং এটি একটি পারস্পরিক অংশীদারত্বের সম্পর্ক। এই অংশীদারত্বের অন্যতম ভিত্তি হলো রোগীর সম্মতি (Informed Consent), বিশেষ করে অপারেশনের আগে ও সম্মতি দেওয়ার আগে রোগীকে অবশ্যই অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি, অপারেশনকালে কী কী হতে পারে, অপারেশন-পরবর্তী ঝুঁকি, অপারেশনের সুবিধা/বেনিফিট, বিকল্প চিকিৎসা এবং সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে এবং অজ্ঞানবিদের সঙ্গে অবশ্যই পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। অনেকেই ভাবেন সম্মতি মানেই একটি ফরমে স্বাক্ষর—কিন্তু বাস্তবে এটি একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে রোগী তার চিকিৎসা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা অর্জন করে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটি চিকিৎসকের প্রতি আস্থা, রোগীর অধিকার এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি।

রোগীর সম্মতি বলতে কী বোঝায়?

বিজ্ঞাপন

রোগীর সম্মতি (Informed Consent) বলতে বোঝায়, চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের আগে একজন রোগীকে সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়।

  • চিকিৎসার ধরন ও উদ্দেশ্য।
  • সম্ভাব্য উপকারিতা ও ঝুঁকি।
  • বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি।
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা জটিলতা।
  • চিকিৎসা নিতে না চাওয়ার অধিকার।

সম্মতি গ্রহণের মূলভিত্তি তিনটি

  • তথ্য প্রদান প্রয়োজনীয় সব তথ্য স্পষ্টভাবে রোগীকে জানানো।
  • বোঝার সক্ষমতা রোগী তা বুঝেছে কি না, তা যাচাই করা।
  • স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি কোনো ধরনের চাপে নয়, নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

এটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রোগীর সম্মতি গ্রহণ চিকিৎসার নৈতিকতা ও পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণÑ

✅ এটি রোগীর অধিকার রক্ষা করে।

✅ চিকিৎসায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।

✅ চিকিৎসকের প্রতি রোগীর আস্থা তৈরি করে।

✅ আইনি জটিলতা প্রতিরোধে সহায়ক হয়।

✅ মানসিক প্রস্তুতির সুযোগ দেয়, যা সুস্থ হওয়ার পথে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সম্মতি না দিলে কী হতে পারে?

  • রোগী চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে।
  • কোনো জটিলতা হলে চিকিৎসক আইনি বিপদে পড়তে পারেন।
  • চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর রোগীর আস্থা নষ্ট হতে পারে।
  • নৈতিকতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা থাকে।

সম্মতি গ্রহণের সময় কী বিষয় নিশ্চিত করতে হবে?

✔ চিকিৎসার উদ্দেশ্য ও ধাপগুলো সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা। অ্যানেসথেসিয়া সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।

✔ সম্ভাব্য ঝুঁকি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করা।

✔ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি উল্লেখ করা।

✔ রোগীকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া।

✔ রোগী তা বুঝেছে কি না নিশ্চিত হওয়া।

✔ লিখিত সম্মতিপত্রে রোগী (বা অভিভাবকের) স্বাক্ষর রাখা।

বিশেষ পরিস্থিতিতে সম্মতি কেমন হওয়া উচিত?

  • শিশু রোগীর ক্ষেত্রে : বাবা-মা অভিভাবকের সম্মতি প্রয়োজন।
  • অজ্ঞান বা মানসিকভাবে অক্ষম রোগী : আইনগত অভিভাবকের মাধ্যমে সম্মতি নিতে হয়।

# জরুরি অবস্থা : জীবন রক্ষায় অবিলম্বে চিকিৎসা দেওয়া যায়, তবে পরবর্তী সময় তা ডকুমেন্ট করতে হয়।

রোগীর সম্মতি গ্রহণ শুধু নিয়ম রক্ষার বিষয় নয়—এটি রোগীর ওপর চিকিৎসকের সম্মানবোধ ও দায়বদ্ধতার প্রতীক। একজন সচেতন রোগী এবং আন্তরিক চিকিৎসকের যৌথ অংশগ্রহণেই চিকিৎসার সর্বোচ্চ মান অর্জন সম্ভব।

আমাদের চিকিৎসকরা সবসময় চেষ্টা করে থাকেন রোগীদের বুঝিয়ে বলার, সময় দেওয়ার এবং তাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গা তৈরি করার। সবশেষে বলি, শল্য চিকিৎসার সময় সম্মতির জন্য স্বাক্ষর দেওয়ার আগে রোগী এবং রোগীর স্বজনদের উচিত সবকিছু জেনে নেওয়া এবং বুঝে নেওয়া। সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন।

লেখক : আবাসিক সার্জন (ইএনটি), সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত