প্রযুক্তির আড়ালে চলে গণহত্যা

রায়হান আহমেদ তামীম
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৫, ১০: ৫৯
ফিরে দেখা জুলাই ২৪

১৮ জুলাই, ২০২৪। হঠাৎ করেই যেন পুরো বাংলাদেশ অন্ধকারে তলিয়ে গেল। ইন্টারনেট কাজ করছে না, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, ব্রডব্যান্ডও অফ। কারো কাছে কোনো খবর নেই, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল গুজব, কান্না আর আতঙ্ক। কেউ জানে না—কোথায় কার ভাই গুলিবিদ্ধ, কার বন্ধু নিখোঁজ, কার সন্তান আর নেই। যে প্রযুক্তিকে আমরা উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখি, সেই প্রযুক্তিই তখন হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অন্যতম অস্ত্র! বুলেটের সামনে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা প্রজন্মকে থমকে দেওয়া হয়েছিল প্রযুক্তিকে কুক্ষিগত করে রাখার মাধ্যমে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই অধ্যায়টির নাম ‘জুলাই গণহত্যা’, যার নেপথ্যে থাকা অন্যতম অধ্যায়ের নাম ‘ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট’।

বিজ্ঞাপন
Police

ঘটনার পেছনের প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও রাজপথে নামে কোটা সংস্কারের দাবিতে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থায় বৈষম্য চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সূত্রপাত হওয়া এই আন্দোলন দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শান্তিপূর্ণ মিছিল, স্লোগান ও অবস্থান কর্মসূচিতে চাপ প্রয়োগ করে ও হামলা চালিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি, টিয়ারশেল ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে আন্দোলনকারীদের বারবার ছত্রভঙ্গ করে। তবুও দিন দিন আন্দোলনের মাত্রা বাড়তেই থাকে। শেষে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ইন্টারনেট বন্ধ : কার আদেশে, কেন?

১৮ জুলাই সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে মোবাইল ইন্টারনেট, ব্রডব্যান্ড, এমনকি কিছু জায়গায় ফোন কলও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এই ইন্টারনেট বিভ্রাট ১৮ জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২৮ জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং পরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আরো এক ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল। এর পেছনে প্রযুক্তিগত দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। কিন্তু আদেশ এসেছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। শেখ হাসিনার প্রশাসন ‘মৌখিক’ নির্দেশের মাধ্যমে ইন্টারনেট বন্ধের আদেশ দিয়েছিল। সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রথমে মহাখালীর একটি ডেটা সেন্টারে অগ্নিকাণ্ডের কারণে ইন্টারনেট বিভ্রাট ঘটেছিল বলে জানান। তবে পরে তদন্তে দেখা যায়, এই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সারা দেশের ইন্টারনেট বন্ধের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আসলে অনলাইন অ্যাক্টিভিজম বন্ধ করতে এবং বিক্ষোভকারীদের সংগঠিত হওয়া থামাতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড পরিষেবা আংশিকভাবে পুনরুদ্ধার করা হলেও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ ছিল।

প্রযুক্তি যখন নিপীড়নের হাতিয়ার

ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট একটি রাষ্ট্রের চরম দমননীতির নিদর্শন। সাধারণত যুদ্ধ চলাকালে বা চরম জাতীয় সংকটে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি ব্যবহার করা হয়েছিল আন্দোলন দমন ও তথ্য গোপন করার জন্য। এই ব্ল্যাকআউটের সময়ে সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ করতে পারেননি। চিকিৎসকরা জরুরি তথ্য পাননি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ প্রিয়জনের খোঁজ পাননি। আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানতে পারেননি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো হয়েছে নির্যাতনের স্টিমরোলার।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

তখন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন (ওএইচসিএইচআর), হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-সহ অনেক সংস্থা উদ্বেগ জানায়। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে তথ্যপ্রবাহ থামিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানো একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। এটি জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার প্রতি চরম আঘাত।’

নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা মৌলিক অধিকার

জুলাই ২০২৪ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—প্রযুক্তি শুধু প্রগতির বাহন নয়, সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তা হতে পারে নিপীড়নের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র। যে ডিজিটাল কানেক্টিভিটিকে আমরা আধুনিকতার মূল ভিত্তি মনে করি, সেটিই একটি রাষ্ট্র কীভাবে নিমিষেই বিচ্ছিন্নতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, তা এই ঘটনা দেখিয়ে দিল। এই ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট কেবল একটি আন্দোলন দমনের উদাহরণ নয়, এটি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে তথ্যের প্রবাহকে রুদ্ধ করে গণহত্যা আড়াল করা যায়, তার এক বাস্তব চিত্র। এই ঘটনা জোর দিয়ে প্রমাণ করে, নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং একটি মৌলিক অধিকারের অংশ। তথ্যপ্রবাহের এই ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট সংযোগ জীবনধারণ, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য। যখন রাষ্ট্র এই সেবা বিচ্ছিন্ন করে, তখন তা সরাসরি মানুষের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে এবং জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ধারণাকে বিলুপ্ত করে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত