হোম > বিশ্ব

হিন্দুত্ববাদী ভারতের কপট মাইনরিটি কার্ড

আবু সুফিয়ান

ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম, খ্রিষ্টান ও দলিতদের ওপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী হামলায় এক মুসলিম শিক্ষকসহ দুই মুসলিম এবং একজন দলিত নিহত হয়েছেন। একই সময় বড়দিনের আগে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপরও একাধিক স্থানে সহিংসতা চালানো হয়। কর্ণাটকের একটি চার্চে ঢুকে যাজককে হেনস্তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব ঘটনার ভয়াবহতাকে আরো স্পষ্ট করেছে।

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গত এক দশকে ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন বহুগুণ বেড়েছে। অথচ নিজেদের দেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন উপেক্ষা করে ভারতের রাজনীতিবিদ ও গদি মিডিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতিমাত্রায় সক্রিয়। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের রাজনৈতিক ও মিডিয়া আক্রমণ আরো তীব্র হয়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য, হুমকি ও অপপ্রচার নিয়মিত দৃশ্যমান হচ্ছে।

মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এখন ‘মাইনরিটি কার্ড’ ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের আগ্রাসী ভাষা সরাসরি সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করছে।

এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কাশ্মীরি রাজনৈতিক কর্মী, ওয়ার্ল্ড কাশ্মীর ফ্রিডম মুভমেন্টের সভাপতি এবং দ্য জাস্টিস ফাউন্ডেশন কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ডা. মুজ্জাম্মিল আইয়ুব ঠাকুর আমার দেশকে বলেন, ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুসলমানরাই সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত। কাশ্মীরের অবৈধ দখল ও পরবর্তী অবৈধ সংযুক্তির মাধ্যমে এ শত্রুতা আরো দৃঢ় হয়েছে। কাশ্মীরকে ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে এক ধরনের পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফল পরে ভারতের মূল ভূখণ্ড ও এর বাইরেও প্রয়োগ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ভারত নিজ সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রতিবেশী দেশগুলোয়ও তাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুসলমানরা এখনো ভারতের এ কূটচাল পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। তা সম্ভব হলে সীমান্ত পেরিয়ে মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য গড়ে উঠতে পারত। সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাম্প্রতিক চিত্র বড়দিন উপলক্ষে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব ঘিরে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। একাধিক স্থানে উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বড়দিনের অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত করে এবং তাদের হেনস্তা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। ভারতের ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স জানায়, বড়দিনের মৌসুমকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে এসব হামলা চালানো হয়েছে এবং তারা এর নিন্দা জানায়। সংগঠনটির বিবৃতিতে ‘ক্রিস্টমাস ক্যারল’ গাওয়া শিল্পীদের ওপর হামলা, চার্চে ধর্মীয় সমাবেশে বাধা ও উৎসব অনুষ্ঠানে হেনস্তার কথা উল্লেখ করা হয়।

নির্যাতিত খ্রিষ্টানদের সহায়তায় কাজ করা আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ওপেন ডোরস জানিয়েছে, শুধু বড়দিনের সময়ই ভারতজুড়ে খ্রিষ্টানদের ওপর ৬০টির বেশি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা মধ্যপ্রদেশের জাবালপুরে, যেখানে বড়দিনের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এক দৃষ্টিশক্তিহীন খ্রিষ্টান নারীকে প্রকাশ্যে হেনস্তা ও মারধর করতে দেখা যায় বিজেপির স্থানীয় নেত্রী আঞ্জু ভারঘাভাকে। এছাড়া ওড়িশা ও দিল্লিতে সান্তা ক্লজের ক্যাপ বিক্রেতা ও বড়দিনের সাজে থাকা নারীদের হেনস্তার ভিডিও সামনে আসে। এসব ঘটনায় ‘হিন্দু রাষ্ট্রে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের’ অভিযোগ তুলে বড়দিন উদযাপনে বাধা দেওয়া হয়। ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতে খ্রিষ্টানদের ওপর অন্তত ৬০০ সহিংস হামলার ঘটনা ঘটে।

খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি মুসলিম ও দলিতদের বিরুদ্ধেও সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। উত্তর প্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২৫ ডিসেম্বর রাতে স্কুলশিক্ষক রাও দানিশ আলিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিহারে এক মুসলিম ফেরিওয়ালা নিহত হন। কেরালার পালাক্কাডে কাজের সন্ধানে যাওয়া ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা ৩১ বছর বয়সি দলিত যুবক রামনারায়ণ বাঘেলও হিন্দুত্ববাদী হামলায় নিহত হন। ওড়িশার সম্বলপুরে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম নির্মাণশ্রমিক জুয়েল রানাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার দুই সহকর্মী গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম জানিয়েছে, ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বিশেষভাবে মারাত্মক’ নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। এক স্বাধীন প্রতিবেদনে ২০২৪-২৫ সময়ে প্রায় এক হাজার ঘৃণাভিত্তিক অপরাধের তথ্য উঠে এসেছে; যেখানে মুসলিম, দলিত, আদিবাসী ও খ্রিষ্টানরা লক্ষ্যবস্তু।

অপপ্রচার, উসকানি ও মাইনরিটি কার্ড

নিজ দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বাড়লেও বাংলাদেশে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেই ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও তথাকথিত গদি মিডিয়া তাতে সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বিজেপির নেতৃত্বে গঠিত সনাতনী ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রতীকী অবরোধ পালন করে। এর আগের দিন কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ বড় ধরনের বিক্ষোভের আয়োজন করে।

এ সময় বিজেপির এমপি করণ ভূষণ সিং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যুতে উসকানিমূলক মন্তব্য করে বলেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আমাদের রক্ত গরম করে দেয়।’ কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও বাংলাদেশে হিন্দু যুবক দিপু চন্দ্র দাস হত্যার প্রসঙ্গ টেনে দিল্লির কূটনৈতিক তৎপরতার দাবি জানান।

এ অপপ্রচারের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী অমৃত মণ্ডলের মৃত্যুকে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে উপস্থাপনের চেষ্টা দেখা যায় ভারতের কিছু রাজনৈতিক মহল ও সংবাদমাধ্যমে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর আমার দেশকে বলেন, ভারতের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগকে ‘হিউম্যান রাইটস ইস্যু’ হিসেবে তুলে ধরছে। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অসত্য, অতিরঞ্জিত ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপন করছে। বাংলাদেশের কিছু বিচ্ছিন্ন ও আকস্মিক ঘটনাকে যেমন বিকৃতভাবে প্রচার করা হয়, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও ক্লিপ ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া ও কিছু বিশেষ শ্রেণির সংবাদমাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রচারণায় ভারতীয় রাজনীতিবিদদের নিজস্ব দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টিকেই কেন্দ্রীয় আলোচনায় পরিণত করা হচ্ছে।

শেখ ওমর আরো বলেন, তথাকথিত এ ‘মাইনরিটি কার্ড’ ভারতের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনি রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রচারণায় ক্রমেই একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থান নিয়ে মানবিক উদ্বেগের কথা বলা হলেও একই সময়ে ভারতের ভেতরে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতন, সহিংসতা ও বৈষম্যের প্রশ্নে সে উদ্বেগ অনুপস্থিতÑএ নিয়ে সমালোচনাও বাড়ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারতের কিছু রাজনীতিবিদ ও সংগঠন সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ইস্যু সামনে এলেই সেটি ভারতে রাজনৈতিক প্রচারণার অংশে পরিণত হয়। কিছু নেতা প্রতিবেশী দেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছেÑএমন বক্তব্যকে ভারতের জনমত গঠন ও ভোটের রাজনীতিতে কাজে লাগাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিজেপির এক সংসদ সদস্যের ‘শুধু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই ভারতের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে পারেন’Ñএমন মন্তব্যও রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিন কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির সমালোচনা করে বলেন, (ভারতে) যখন উগ্র গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, তখন প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) বড় উৎসবে অংশ নিচ্ছেনÑএটি একটি বিপজ্জনক বার্তা দিচ্ছে।

জামায়াত ও সমমনাদের নির্বাচনি জোট অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা

সাজানো চার্জশিটে বছরের পর বছর জেলে ধুঁকছেন বহু আলেম

কামালের দাপটে ছেলে জ্যোতিরও বিপুল অবৈধ সম্পদ

মেট্রোস্টেশনে মেলে প্রাথমিক চিকিৎসা, জানেন না যাত্রীরা

পাঠ্যবই পরিমার্জনে গুরুত্ব পেল জুলাই বিপ্লব

চালু হচ্ছে বহু প্রতীক্ষিত বাণিজ্যিক আদালত, প্রস্তুতি সম্পন্ন

বিশাল সংবর্ধনায় আজ ফিরছেন তারেক রহমান

জামায়াতকে হাতে রেখে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় এনসিপি

বাংলাদেশ মিশন ঘিরে হিন্দু জঙ্গিদের তাণ্ডব

কৃষক লীগ ক্যাডারের কারবার চালান স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা