দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায় চলতি মৌসুমে আগাম আলু চাষ করে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন কৃষকরা। মাঠজুড়ে ফলন ভালো হলেও বাজারে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ফলে লোকসানের শঙ্কা আর ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে উপজেলার শত শত কৃষক পরিবারের।
উপজেলার আলোকঝাড়ী, আঙ্গারপাড়া, ভাবকী, খামারপাড়া ও ভেড়ভেড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়—দলবেঁধে নারী-পুরুষ কৃষকরা ব্যস্তভাবে আলু তুলছেন। কেউ মাটি ঝেড়ে আলু পরিষ্কার করছেন, কেউ আবার ঝুড়িতে ভরে বাজারে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু এই কর্মব্যস্ততার মাঝেও কারও মুখে স্বস্তির হাসি নেই। বরং সবার চোখেমুখেই স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষে বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিক মজুরি মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অথচ বর্তমানে স্থানীয় বাজারে আগাম আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮ থেকে ১২ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচ ওঠার কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না তারা; বরং বাড়ছে ঋণ ও ধারদেনার চাপ।
আঙ্গারপাড়া ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘এ বছর ফলন ভালো হলেও আলুর দাম একেবারেই নেই। আলু তুললেই লোকসান হচ্ছে। ঋণ শোধ করা তো দূরের কথা, সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।’
একই হতাশার কথা জানালেন ভেড়ভেড়ি ইউনিয়নের কৃষক রওশন আলী। তিনি বলেন, ‘সব কৃষকের হিমাগারে আলু রাখার সামর্থ্য নেই। বাধ্য হয়ে ক্ষেত থেকেই কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা ছোট কৃষকরা।”
কৃষকদের অভিযোগ, বাজারে আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণেই তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। কৃষক পর্যায়ে আলুর দাম কম হলেও ভোক্তা পর্যায়ে সেই দামের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলেও দাবি তাদের। এ অবস্থায় লোকসানের আশঙ্কায় আগাম আলু চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেক কৃষক।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছর খানসামা উপজেলায় ১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে আগাম আলুর আবাদ হয়েছিল। চলতি মৌসুমে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯০ হেক্টরে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং আগের মৌসুমে ন্যায্য দাম না পাওয়াই আবাদ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষকদের মতে, শুধু পরামর্শ দিয়ে এই সংকট কাটানো সম্ভব নয়। তারা দাবি করেন, আগাম আলুর ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারি পর্যায়ে কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা, হিমাগার সুবিধা সহজ করা এবং প্রয়োজনে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আলু সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
কৃষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী মৌসুমে আগাম আলু চাষ আরও কমে যেতে পারে। এর প্রভাব শুধু কৃষকদের ওপরই নয়, সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ও স্থানীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচকভাবে পড়বে।
এ বিষয়ে খানসামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘চলতি মৌসুমে খানসামা উপজেলায় আগাম আলুর ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে একসঙ্গে বেশি আলু বাজারে আসায় সরবরাহ বেড়েছে, ফলে দাম কম রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আগের বছরের তুলনায় এ বছর আগাম আলুর আবাদ কিছুটা কমেছে। কৃষকদের ক্ষতি কমাতে মাঠপর্যায়ে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আলু সংরক্ষণ, বাছাই ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাজার পরিস্থিতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’