ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ফেনী সরকারি কলেজে চলেছে লুটপাট ও অনিয়মের মহোৎসব। সাবেক অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেট কলেজের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। নামে-বেনামে বিল-ভাউচার করে হাতিয়ে নেওয়া হয় এসব টাকা। ইতোমধ্যে কয়েকজন সাবেক অধ্যক্ষ অডিট আপত্তির পর টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছেন । আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, শুধু কলেজের প্রশাসনিক ভবনের জন্য প্রিন্টারের টোনার কেনার নামে কয়েক বছরে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে টোনার ও অফিস সামগ্রীর ব্যয় দেখানো হয় ২৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা; ২০২২-২৩ সালে ২১ লাখ ২৭ হাজার টাকা; ২০২৩-২৪ সালে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত খরচ দেখানো হয়েছে ছয় লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাস্টাররোল কর্মচারী মনতোষ চন্দ্র দাস এই ক্রয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা প্রাণহরি দেবনাথের মাধ্যমে বিল-ভাউচার অনুমোদিত হতো। অবসরের বয়স পেরিয়ে গেলেও তাকে এই পদে বহাল রাখা হয়। সম্প্রতি অনিয়ম ধরা পড়ার পর চাকরিচ্যুত হন প্রাণহরি।
অন্যদিকে ২০২৩ সালে একাডেমিক ভবনের পেছনে ড্রেন নির্মাণের জন্য ব্যয় দেখানো হয় ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৪৩৩ টাকা। দুই দফায় এই টাকা নেওয়া হয়। অথচ কলেজ প্রাঙ্গণে ওই ড্রেনের কোনো অস্তিত্বই নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, কলেজে কখনো কোনো ড্রেন হয়নি। একটি হয়েছে বধ্যভূমির পেছনে, যা কলেজের অর্থ থেকে করা হয়নি।
২০১৯ সালে নির্বাচিত ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের (ফেকসু) মেয়াদ ২০২০ সালে শেষ হয়। কিন্তু ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৭৩ হাজার ৮০০ টাকা এবং একই বছরের ১০ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৯৭ হাজার টাকা ফেকুসর নামে খরচ দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়।
এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কলেজ সীমানায় ২০০ ফুট কাঁটাতার স্থাপনের ব্যয় দেখানো হয় পাঁচ লাখ ৪২ হাজার টাকা। অথচ একই পরিমাণ কাঁটাতারের বেষ্টনী পরের বছর অন্য স্থানে দিতে খরচ হয় মাত্র এক লাখ ২৮ হাজার টাকা।
২০১৭ সালে কলেজের কলা ভবনের সামনে বিপন্ন উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্নার নামে একটি বাগান তৈরি করেন তৎকালীন অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। সেখানে ব্যয় দেখানো হয় সাড়ে সাত লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে কেবল নামফলক লাগানো ছাড়া বাগান তৈরির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ২০২২ সালে উদ্বোধন হওয়া ‘চাইল্ড কেয়ার সেন্টার’-এ তিন লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও এটি কখনো চালু হয়নি। তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল এটির উদ্বোধন করেন।
বিভিন্ন দিবস উদযাপনের নামে প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে খরচ দেখানো হয় দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। এভাবে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই দেড় থেকে দুই লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকৃতপক্ষে এসব অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়।
মিলাদ মাহফিলের নামেও চলে লুটপাট। ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের খরচ দেখানো হয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা করে। অথচ বাস্তব ব্যয় সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকার মধ্যে হওয়া সম্ভব বলে দাবি শিক্ষার্থীদের ।
এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠান বাবদ তিন লাখ ২৩ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। অথচ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, এমন কোনো অনুষ্ঠান কলেজে হয়নি। তবে ফেনী পৌরসভার অনুষ্ঠানে গুটিকয়েক শিক্ষকসহ বেশকিছু শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন তহবিলে ব্যয় দেখানো হয় ৫৩ লাখ টাকা; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৪ লাখ টাকারও বেশি। এ বিষয়ে অডিট আপত্তির পর তিনজন অধ্যক্ষ প্রায় ৩০ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন।
একইভাবে নিরাপত্তা তহবিলেও বিপুল অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় ছিল ৫৭ লাখ টাকা, যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে একই খাতে খরচ দেখানো হয়েছে মাত্র ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মোট ব্যয়ের পার্থক্য প্রায় ৪৮ লাখ টাকা।
এছাড়া বিবিধ তহবিল নামেও টাকা লোপাট করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ব্যয় দেখানো হয়েছে ছয় লাখ ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে একই খাতে ব্যয় হয়েছে চার লাখ ৩৯ হাজার টাকা।
সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী একাধিক শিক্ষার্থী জানান, পুরস্কারে বেশিরভাগ সময় বই ও সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী বিভিন্ন ইভেন্টে প্রতিবছর ১২০-১৩০ জনকে পুরস্কৃত করলে জনপ্রতি ৪০০ টাকা করে ধরলেও পুরস্কার আসার কথা ৫২ হাজার টাকা এবং সাউন্ড সিস্টেম, অনুষ্ঠান আয়োজনসহ অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা এক থেকে দেড় লাখ টাকার মতো; অথচ সেখানে ব্যয় দেখানো হয়েছে চার-পাঁচ গুণ বেশি।
ফেনী সরকারি কলেজে ২২ হাজারের অধিক ছাত্রছাত্রী রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছ থেকে প্রতিবছর নিরাপত্তা খাতে ৬৫০ টাকা করে আদায় করা হলেও সেশন ফির সঙ্গে নতুন করে ১০০ টাকা বাড়িয়েছে কলেজ প্রশাসন। সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের একাডেমিক কাউন্সিলে ৬৫০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা করে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সরকারি ছয়জন ও বেসরকারি কর্মচারী ৪০ জন মিলে নিরাপত্তা, নৈশপ্রহরী ও মাস্টাররোল কর্মচারী বাবদ প্রতিবছর খরচ হয় ৫০ লাখ টাকার মতো। এর মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের সেমিনার থেকে ১৫ জনের বেতন দেওয়া হয়। বিভিন্ন উৎসবের নামে বাকি টাকা ব্যয় করা হতো।
ফেনী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল তার দায়িত্বকালীন সময়ে আর্থিক অনিয়ম-লুটপাটের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, জাতীয় দিবস উদযাপনসহ দৈনন্দিন কার্যক্রম শিক্ষকদের দিয়ে কমিটির মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে কারো কলেজ ফান্ড থেকে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। অডিটেও কোনোরকম আপত্তি না হওয়ায় অবসর-উত্তর পেনশন সুবিধা পেয়েছি। টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে অপর সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ মোক্তার হোসেইনকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।