রাজশাহীতে চলতি আলু মৌসুমের শুরুতেই কৃষকদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তীব্র সার সংকটের। জেলার ৯টি উপজেলার ১৬ হাজারের বেশি চাষি এখন চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। সরকারি দামে ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সার না পাওয়ায় অনেক কৃষকের আলু আবাদ শুরুই করতে হচ্ছে দেরিতে। ডিলারদের দোকানে সার কিনতে ভিড় করলেও অধিকাংশ কৃষককে বাড়তি দামে সার কিনতে হচ্ছে, যা চাষাবাদের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং উৎপাদন ঝুঁকিতে ফেলছে।
পবা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, চারঘাট, বাঘা, তানোর, মোহনপুর, বাগমারা ও গোদাগাড়ী উপজেলায় টিএসপি সারের তীব্র অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ডিএপি সার কিছু কিছু এলাকায় পাওয়া গেলেও তা বিক্রি হচ্ছে সরকারি দামের চেয়ে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা বেশি দরে। তানোর উপজেলার কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারি দামে সার পাওয়া যাচ্ছে না। ৩০০-৪০০ টাকা বেশি দিলে দিচ্ছে। নইলে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
তবে অতিরিক্ত মূল্য রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে একই উপজেলার ডিলার মাইনুল ইসলাম দাবি করেন, বরাদ্দ কম, বেশি দামে বিক্রি করার প্রশ্নই আসে না।
বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের আলু চাষে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব
বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলু চাষ হয় রাজশাহীতে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, প্রতি আলু মৌসুমে সার সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হয় জেলার চাষিদের। সরকার নির্ধারিত ন্যায্য দামে ন্যূনতম সার বিতরণ দেখা গেলেও প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত সার পান না চাষিরা। এবারও আলু চাষের শুরুতেই সার সংকটে পড়েছেন জেলার কৃষকরা। অধিকাংশক্ষেত্রে অতিরিক্ত দামেও সার পাচ্ছেন না অনেকে। প্রতি বস্তা ১ হাজার ৫০ টাকা দামের ডিএপি সার মিলছে এক হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। টিএসপি সার নভেম্বর মাসের বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় ডিলাররা দিতে পারছেন না, তবে ১৬৫০ থেকে ১৮০০ টাকা দিলে এই সারও মিলছে বলে অভিযোগ আছে। এতে আলু চাষে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বেশি সংকটে পড়েছেন জেলার পুঠিয়া, তানোর, মোহনপুর, গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার চাষিরা, যেখানে তুলনামূলকভাবে বেশি আলু চাষ হয়।
কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক মোজাম্মেল বলেন, এই সংকটের পেছনে তিনটি প্রধান কারণ কাজ করছে। প্রথমত, আলু মৌসুমে সারের চাহিদা বেড়ে গেলেও বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। দ্বিতীয়ত, ডিলার পর্যায়ে অনিয়ম ও গোপনে বাড়তি দামে বিক্রির প্রবণতা বিদ্যমান। তৃতীয়ত, কিছু এলাকায় পুকুরে সার প্রয়োগ এবং মজুতদারির কারণে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হচ্ছে। সংকটের দ্রুত সমাধানের জন্য ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু, হঠাৎ পরিদর্শন বাড়ানো এবং কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা পারভিন লাবনী বলেন, আলু চাষ এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি, তবে পুকুরে সার প্রয়োগের কারণে সংকট দেখা দিতে পারে। আমরা মাঠ পর্যায়ে নজরদারি করছি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বরাদ্দ অনুযায়ী সার সরবরাহ করা হলেও কিছু এলাকায় চাহিদা বেশি থাকায় স্থানীয়ভাবে সংকট দেখা দিয়েছে, যা দ্রুত সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তানোর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সুভাষ কুমার মণ্ডল জানান, সরকারি নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত বরাদ্দ পাইনি। সারা বছরের বরাদ্দ দিয়েও আলুচাষে সারের চাহিদা মিটবে না, কারণ অনেক কৃষক জৈব সার ব্যবহার করেন না এবং টেন্ডারের জমিতে বেশি ফলনের জন্য অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করেন। কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নভেম্বর মাসে জেলার ২২০ জন ডিলারের মধ্যে সাত হাজার ৩০৭ টন ইউরিয়া, তিন হাজার ১৮৬ টন টিএসপি, সাত হাজার ৮৩৯ টন ডিএপি ও পাঁচ হাজার ৬৩৭ টন এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডিসেম্বর মাসের জন্য ৯ হাজার ২৭৯ টন ইউরিয়া, দুই হাজার ৫৫৬ টন টিএসপি, সাত হাজার ৯৫১ টন ডিএপি ও চার হাজার ৪৪৫ টন এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ আছে, বরাদ্দ সত্ত্বেও ডিলার পর্যায়ে সঠিক বিতরণ নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
সার সংকটের কারণে আলু আবাদ ২০-৩০ শতাংশ পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং প্রতি বিঘায় চাষাবাদের খরচ এক ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা বেড়েছে। গত মৌসুমে আলুচাষ করে লোকসানের মুখে পড়া হাজারো চাষি এবার পুনরায় আলুচাষে নামলেও সার না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্লেষকরা হঠাৎ পরিদর্শন ও বরাদ্দ বাড়ানো, ডিজিটাল সার বিতরণ মনিটরিং সিস্টেম চালু এবং গোপন বিক্রি বন্ধে অভিযোগ পেতে হটলাইন চালুর সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি পুকুরে সার ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপেরও আহ্বান জানানো হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাসির উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বরাদ্দ অনুযায়ী আলুচাষিদের জন্য সারের সংকট থাকার কথা নয়। কিন্তু যারা বোরো মৌসুমে ধান চাষ করবেন, তারাও পরে সার পাবেন না ভেবে এখন সার উত্তোলন করে রেখে দিচ্ছেন। অথচ এখন মূলত আলুচাষের জন্যই সার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে আলুচাষের কৃষকরা সার সংকটে পড়েছেন হয়তো। তবে সার সংকট বেশি বলে জানা নেই।