নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলায় প্রশাসনের চোখের সামনেই রাতের আঁধারে চলছে অবৈধ মাটি কাটার মহোৎসব। কোনো অনুমোদন ছাড়াই তিন ফসলি কৃষিজমিতে গভীর পুকুর খনন করে সেই মাটি বিক্রি হচ্ছে । স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে প্রশাসন কার্যত নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন রাত ১০টার পর ভারী যন্ত্রপাতি (এসকেভেটর) দিয়ে মাটি কাটা শুরু হয়। দিনের বেলায় কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও রাতের অন্ধকার নামলেই জমিতে নামে মেশিন। এতে প্রশাসনের নজরদারি এড়িয়ে নির্বিঘ্নে মাটি কাটার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
উপজেলার ২নং জামনগর ইউনিয়নের দেবনগর এলাকার রহিমানপুর মেদ্দাপাড়ায় আজিজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি তার তিন ফসলি কৃষিজমিতে পুকুর খনন করছেন। নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে পুকুর খননের জন্য প্রশাসনের অনুমতি ও নির্দিষ্ট নীতিমালা মানার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখানে তার কোনো বালাই নেই। পুকুরের গভীরতা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় পাশের জমি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হলে এই ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষকরা। এতে শুধু একটি জমি নয়, পুরো এলাকার কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে।
পুকুরের মাটি বহনের জন্য ভারী ট্রলি ও ট্রাক চলাচলের কারণে এলাকার কাঁচা ও পাকা সড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভ্যানচালক সারোয়ার হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাটির রাস্তা দিয়ে উঠেই পাকা রাস্তায় যেতে হয়। ভারী গাড়ির চাপে রাস্তা ভেঙে গর্ত হয়ে গেছে। একটু বৃষ্টি হলেই চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
স্থানীয় কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন মানে কৃষিকে ধ্বংস করা। রাত হলেই মাটি কাটে, ধুলাবালিতে রসুন, পেঁয়াজ, মসুরসহ নানা ফসল নষ্ট হচ্ছে। আমরা বারবার অভিযোগ করেছি, কিন্তু কেউ শুনছে না।
পুকুরসংলগ্ন জমির মালিক আব্দুল মোত্তালেব জানান, নিয়ম অনুযায়ী নিরাপদ দূরত্ব না রেখে মাত্র ৩-৪ ফুট পাড় রেখে পুকুর কাটা হচ্ছে। বর্ষা শুরু হলে পাড় ভেঙে আমার জমি পুকুরে চলে যাবে। প্রশাসনের কাছে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—অভিযুক্ত মাটি কাটা সিন্ডিকেটের সদস্যদের প্রকাশ্য দম্ভ। থানা যুবদলের নেতা পরিচয়ধারী উপজেলার চাঁদপুর এলাকার বাবু ফকির নিজেকে এই পুকুর খননের মূলহোতা দাবি করে সাংবাদিকের কাছে বলেন, প্রশাসনের অনুমতি আছে আবার নাই। রাস্তার কাজ চলছে, তাই ইউএনও ও ওসি স্যার বসে আমাকে মৌখিক অনুমতি দিয়েছে। আমি ৪৫টা পুকুর কেটেছি, আমি জানি কিভাবে কাটতে হয়। রাস্তার ক্ষতি বা পাড় ভাঙার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উল্টো হুমকির সুরে বলেন, কোন ক্ষতি হলে আপনি ক্ষতিপূরণ দিবেন? মাটি কি বিমানে করে দেব?
তিনি আরো বলেন, এনসিপির বাগাতিপাড়া কমিটির নেতা মুনজুর হোসেন, সাংবাদিক সাজেদুর, বিএনপির যুবদল নেতা দুলাল, মতিন, মাজেদুর রহমান দুখু, হাফিজসহ সকলেই মিলে মাটি কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই বক্তব্য প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
পুকুর খননের অনুমতি আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জমির মালিক আজিজুল ইসলামের ছেলে হামিম বলেন, আমাদের পুকুর দরকার, তাই বিএনপির নেতারাই পুকুর কেটে দিচ্ছে। আমরা কোনো টাকা দিচ্ছি না। তারা মাটি বিক্রি করবে—এমন চুক্তি হয়েছে।
এ বিষয়ে বাগাতিপাড়া মডেল থানার ওসি মনজুরুল আলম বলেন, পুকুর খননকারীদের সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। উপজেলা প্রশাসন চাইলে পুলিশ সহায়তা দেওয়া হবে।
কৃষিবিদ ড. ভবসিন্ধু রায় বলেন, যেকোনো জমিতে পুকুর কাটতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি বাধ্যতামূলক। বিষয়টি জানার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আলাউদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মিটিংয়ে মৌখিক অনুমতি দেওয়ার দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। লোক পাঠানো হয়েছিল, তখন কাউকে পাওয়া যায়নি। এরপরও মাটি কাটলে মামলা দেওয়া হবে।