হোম > সারা দেশ > রাজশাহী

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভয়াবহ পানি সংকট কৃষি ও শিল্পে অশনিসংকেত

সাইফুল ইসলাম, গোদাগাড়ী (রাজশাহী)

রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চার হাজার ৯১১টি মৌজায় ভূগর্ভস্থ পানি নেই বললেই চলে। এ কারণে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন করা যাচ্ছে না। এসব এলাকায় সুপেয় পানি ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা যাবে না। সরকার এ সংক্রান্ত একটি গেজেটও প্রকাশ করেছে। তা হাতে পেয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তারা চাষাবাদের জন্য গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তোলে। এখন কী করণীয়, সে বিষয়ে বিএমডিএ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের ভয়াবহ এ পানি সংকট সেখানকার কৃষি ও শিল্প খাতের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এ বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও কৃষকরা উদ্বিগ্ন।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলকে মরূকরণের হাত থেকে বাঁচাতে হলে নিষেধাজ্ঞা মানতে হবে। পাশাপাশি ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপরও জোর দিচ্ছেন তারা।

গত শনিবার প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়েছে, জাতীয় পানিসম্পদ পরিষদের নির্বাহী কমিটির ১৮তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক চার হাজার ৯১১টি মৌজাকে আগামী ১০ বছরের জন্য ‘পানি সংকটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব মৌজা পড়েছে ২৫টি উপজেলার ২১৫টি ইউনিয়নে। এর মধ্যে ৪৭টি ইউনিয়নের এক হাজার ৪৬৯ মৌজাকে অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন, ৪০টি ইউনিয়নের ৮৮৪ মৌজাকে উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এবং ৬৬ ইউনিয়নের এক হাজার ২৪০ মৌজাকে মধ্যম মাত্রার পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির গড় স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় ২০১০ সালে পানির স্তর নেমে যায় ৫০ ফুট নিচে। ২০২১ সালে এ স্তর আরো নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। এখন বরেন্দ্র অঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় পানি নেমে গেছে ১১৩ ফুটেরও নিচে।

অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া, পাকড়ি ও রিশিকুল ইউনিয়ন; মোহনপুর উপজেলার ঘাসিগ্রাম, পবার দর্শনপাড়া, দামকুড়া ও হুজরিপাড়া; তানোরের বাঁধাইড়, কলমা, পাঁচন্দর, সরনজাই, তালন্দ ও চান্দুড়িয়া ইউনিয়ন। রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ঝিলিম, গোমস্তাপুরের আলিনগর, চৌডালা, পার্বতীপুর, রহনপুর ও রাধানগর, নাচোলের ফতেপুর, কসবা, নাচোল ও নেজামপুর, নওগাঁর ভাবিচা, হাজিনগর ও নিয়ামতপুর ইউনিয়ন; নিয়ামতপুর উপজেলার পাড়ইল, রসুলপুর ও শ্রীমন্তপুর; পত্নীতলার আকবরপুর, দিবর, কৃষ্ণপুর, মাটিন্দর, নির্মইল, শিহাড়া ও পত্নীতলা; পোরশার ছাওড়, গাঙ্গুরিয়া, ঘাটনগর, মশিদপুর, নিতপুর ও তেঁতুলিয়া; সাপাহারের আইহাই, গোয়ালা, সাপাহার, শিরন্টী ও তিলনা।

উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গড়গড়ি ও পাকুড়িয়া ইউনিয়ন; বাগমারার গণিপুর, চারঘাট সদর ইউনিয়ন, দুর্গাপুরের ঝালুকা, জয়নগর ও কিসমত গণকৈড়; গোদাগাড়ী সদর ইউনিয়ন, মোহনপুর ও গোগ্রাম; মোহনপুরের বাকশিমইল, ধুরইল, রায়ঘাটি ও মৌগাছি; পবার হড়গ্রাম ও তানোরের কামারগাঁ। নওগাঁর আত্রাইয়ের হাটকালুপাড়া, মহাদেবপুরের হাতুর, মান্দার গণেশপুর, মৈনম ও তেঁতুলিয়া; নওগাঁ সদরের বোয়ালিয়া ও শেখেরপুর; নিয়ামতপুরের বাহাদুরপুর, পত্নীতলার আমাইড় ও পাটিচরা; রানীনগরের গোণা, কাশিমপুর ও রানীনগর ও সাপাহারের পাতাড়ী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের গোবরাতলা, মহারাজপুর ও রানীহাটি; গোমস্তাপুরের আলিনগর, বাঙ্গাবাড়ী, বোয়ালিয়া ও গোমস্তাপুর; শিবগঞ্জের নয়ালাভাঙ্গা, সত্রাজিতপুর, শ্যামপুর ও উজিরপুর।

মধ্যম পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে এসেছে রাজশাহীর বাঘার আড়ানী, বাজুবাঘা, বাউসা ও মনিগ্রাম; বাগমারার আউচপাড়া, বাসুপাড়া, গোয়ালকান্দি, গোবিন্দপাড়া, মাড়িয়া, সোনাডাঙ্গা, শ্রীপুর ও শুভডাঙ্গা; চারঘাটের ভায়ালক্ষ্মীপুর, নিমপাড়া, সরদহ ও ইউসুফপুর; দুর্গাপুরের দেলুয়াবাড়ি ও নওপাড়া; গোদাগাড়ীর বাসুদেবপুর, চরআষাড়িয়াদহ ও মাটিকাটা; মোহনপুরের জাহানাবাদ; পবার পারিলা, বড়গাছি, হরিপুর ও হরিয়ান; পুঠিয়ার বানেশ্বর, ভালুকগাছি ও শিলমাড়িয়া। রয়েছে নওগাঁর আত্রাইয়ের কলিকাপুর ও সাহাগোলা; ধামইরহাটের খেলনা, মান্দার বিষ্ণুপুর, কাঁশোপাড়া, কশব, পরানপুর ও প্রসাদপুর; নওগাঁ সদরের বক্তারপুর, চণ্ডিপুর, দুবলহাটি, হাঁপানিয়া, হাঁসাইগাড়ি, শৈলগাছি ও তিলকপুর; নিয়ামতপুরের চন্দননগর; পত্নীতলার ঘোষনগর, নজিপুর, রানীনগরের বড়গাছা, কালীগ্রাম, মিরাট ও পারইল; চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের বালিয়াডাঙ্গা ও বারঘরিয়া; ভোলাহাটের সদর, দলদলী, গোহালবাড়ী ও জামবাড়িয়া; শিবগঞ্জের চককীর্তি, দাইপুকুরিয়া, ধাইনগর, দুর্লভপুর, ঘোড়াপাখিয়া, কানসাট, মোবারকপুর ও পাঁকা ইউনিয়ন।

এসব পানি সংকটাপন্ন এলাকায় বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩-এর ধারা-৩ ও ১৮ অনুযায়ী পানিসম্পদের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবহার যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে বলে গেজেটে বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই বলা হয়েছে, খাবার পানি ব্যতীত অন্য কোনো কারণে নতুন করে নলকূপ স্থাপন ও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ থাকবে।

এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। খাল, বিল, পুকুর, নদী তথা কোনো জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না এবং জলাশয়গুলো জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। জনগণের ব্যবহারযোগ্য খাস জলাশয় ও জলমহালগুলোর ইজারা প্রদান নিরুৎসাহিত করতে হবে; জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত করা যাবে না; কোনো জলাধারের সমগ্র পানি আহরণ করে নিঃশেষ করা যাবে না; ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারেÑএমন কাজ করা যাবে না; অধিক পানিনির্ভর ফসল উৎপাদন নিরুৎসাহিত বা সীমিত করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে পানিসাশ্রয়ী ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। তবে সুপেয় পানি ও গৃহস্থালি কাজে পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা যাবে। এসব বিধিনিষেধ প্রতিপালন করা বাধ্যতামূলক; বিধিনিষেধের লঙ্ঘন দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।

এই গেজেটে সংকট মোকাবিলায় বেশকিছু সরকারি সংস্থার কিছু কার্যক্রমও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এতে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।

বিএমডিএ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে প্রায় ১৮ হাজার গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে কৃষকদের সরবরাহ করে থাকে। সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় তাদের কয়েক হাজার গভীর নলকূপ আছে। একইভাবে ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা আরো কয়েক হাজার সেমি-ডিপ পানি উত্তোলন করে। এগুলো কৃষিকাজের জন্য বন্ধ করতে হবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে।

এ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষক, ব্যবসায়ী ও সেচ-সংশ্লিষ্টরা। কৃষকরা বলছেন, খাবার পানি ছাড়া অন্য কোনো পানি উত্তোলন না হলে তারা ফসল ফলাতে পারবেন না। তবে বিশেষজ্ঞরা সেচ লাগে না বা ভূউপরিস্থ কিংবা বৃষ্টির পানিনির্ভর ফসল চাষাবাদ শুরুর ব্যাপারে মত দিচ্ছেন।

বিএমডিএর সেচ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ জিল্লুল বারী বলেন, ‘আমরা দুদিন আগেই গেজেটটি পেয়েছি। আসলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এভাবে কৃষিকাজ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। এখন এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিষয়। তারা বসে এ ব্যাপারে সিদ্ধাস্ত নেবে।’

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক মো. তরিকুল আলম বলেন, ‘আমরা গেজেটটি দেখেছি। এখন থেকে গভীর নলকূপ দিয়ে শুধু খাবার পানি তোলা যাবে, কৃষিতে এ পানি ব্যবহার করা যাবে না। আমরা মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য নিচ্ছি। এসব এলাকায় গভীর নলকূপের সংখ্যা কত, কি পরিমাণ জমি আছে এবং ফসলের উৎপাদন কেমন হয়Ñএগুলো নিয়ে উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হবে। তারপরই বিষয়গুলো নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।’

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর মৌজাকে অতি উচ্চ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে জমি চাষাবাদ করছেন কৃষক মনিরুজ্জামান মনির। একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও।

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘কৃষিকাজ বন্ধ করে বসে থাকা কোনো সমাধান নয়। সমস্যা সমাধানের বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির যে গঠন, তাতে খুব সহজেই ভূউপরিস্থ পানির আধার তৈরি করা যাবে। নীতিনির্ধারকদের সে পথেই হাঁটতে হবে।’

নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চল এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়া জনপদ। এখানকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হুমকিতে আছে, এটা আরো হুমকিতে পড়ল পানি সংকটের কারণে। এখান থেকে উত্তরণে সরকারকেই পথ বের করতে হবে।’

বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সংকট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘শুধু খাবার পানি তোলা যাবে। এতে দেখা যাবে বাড়িতে সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েই পাইপের মাধ্যমে সেচের পানি দেওয়া হবে। এ অবস্থায় সংকট মোকাবিলায় ভূউপরিস্থ পানি নিশ্চিত করতেই কাজ করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে। এ জন্য কোনো সরকারি পুকুর, খাল-বিল ইজারা দেওয়া যাবে না। এগুলোর পানি কৃষিকাজের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। পাশাপাশি পানি কম লাগে বা বৃষ্টির পানিতেই চাষাবাদ সম্ভব-এমন ফসল চাষাবাদের দিকেই যেতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনায় বিএনপির দুই প্রার্থী আহত

চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ নিহত ৪

সিংড়ায় বিএনপির মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ

পিস্তলসহ আটক বহিস্কৃত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার বিরুদ্ধে অবশেষে মামলা

এনায়েতপুরে শাড়ি প্রিন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৬ লাখ টাকার ক্ষতি

মোহাম্মদপুরে গৃহকর্মীর ছুরিকাঘাতে নিহত মা-মেয়েকে নাটোরে দাফন

পিস্তলসহ আটক বহিষ্কৃত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা, মামলা নিতে অস্বীকৃতি ওসির

মার্চ থেকেই পাবনা-ঢাকা রেল চালু

বিজিবির মানবিকতায় শূন্যরেখায় লাশ দেখার সুযোগ পেলেন ভারতীয় স্বজনরা

রাতের আঁধারে জামায়াত প্রার্থীর গাড়িবহরে হামলা