শান্তিরক্ষী মিশনে নিহত মাসুদের বাড়িতে শোকের মাতম
মাসুদের ৮ বছরের একমাত্র শিশু কন্যা আমেনা মায়ের কোলে মাথা রেখে কখনো চোখ বুজে, কখনো অশ্রুসিক্ত নয়নে অপলক দৃষ্টিতে হাজারো স্মৃতি নিয়ে এদিক সেদিক দেখছে। মা স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করছে। পাশেই নিহত মাসুদের বৃদ্ধ মা বিলাপের পাশাপাশি ছেলের বউ ও নাতনি কে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। সেই সাথে পাড়া-প্রতিবেশীরাও।
সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে সন্ত্রাসীদের হামলায় শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্পোরাল মাসুদ রানা। পরিবার ছেড়ে মাত্র ১ মাস ৭ দিনের মাথায় শান্তি রক্ষা মিশনে গিয়ে প্রাণ হারানো এই বীর সেনার মৃত্যুতে লালপুর উপজেলার বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) সুদানের আবে এলাকায় অবস্থিত জাতিসংঘের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে বোমা ও সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ জন শান্তিরক্ষী শহীদ হন এবং আরো ৮জন গুরুতর আহত হন। আন্তঃ-বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে এ-তথ্য জানাজায় ।
শহীদ কর্পোরার মাসুদ রানা বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের মৃত সাহার মালিদার ছেলে। মাত্র এক মাস সাত দিন আগে তিনি জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে যোগ দিতে সুদানে পাড়ি জমান। যাওয়ার সময় পরিবারের কাছে বলেছিলেন, দেশের জন্য যাচ্ছি- সবাই দোয়া করো, কিন্তু কে জানত সেটাই হবে পরিবারের সঙ্গে তার শেষ বিদায়।
দুঃসংবাদটি পৌঁছানোর পর থেকেই মাসুদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। স্ত্রী কন্যা ও বৃদ্ধ মা ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বারবার মোর্চা যাচ্ছেন। মা বিলাপ করে বলেন-‘আমার ছেলেটা খুব ভালো ছিল, কারো সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি, আল্লাহ আমার বুক খালি করে নিল’
দুঃসংবাদ শুনে স্ত্রী আসমাউল হুসনা আঁখি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ও বলেছিল মিশন শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবে। আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো, আমার মেয়ে আর বাবা ডাকতে পারবে না। মেয়েটাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল।
শহীদ মাসুদ রানার চাচা সাবেদ আলী জানান, মাসুদ ছিল গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে। আমরা তার জন্য গর্ববোধ করতাম। আজ সেই ছেলেটায় লাশ হয়ে ফিরবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) বিকেলে নাটোর ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা তার বাড়িতে আসেন। তারা শোকাহত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে সান্তনা দেন এবং সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
তার স্বজনরা জানান, তাদের দুই পরিবারে ভাই বোনের সংখ্যা ১২ জন। মাসুদ দ্বিতীয় পক্ষের পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। তাদের আরো দুই ভাই মনিরুল ইসলাম জনি ও রনি আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য।
মরহুম বাবা সাহার ফরাজী সম্পদ বিক্রি করে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছেন। তিন সন্তানের চাকরির সুবাদে তাদের পরিবার সচ্ছলতার আলো দেখছিলেন। কিন্তু নিয়তি তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।
ফুটফুটে সুন্দর মাসুদের কন্যা আমেনা যশোর ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের ইংলিশ মিডিয়ামের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। সবেমাত্র পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু ভাল ফলাফলে বাবা তার আদরের কন্যা সন্তানকে বুকে নিতে পারলেন না।
বগুড়া সেনা ক্যাম্পের বরাত দিয়ে মাসুদের চাচা সাবেদ আলী জানান, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে মাসুদের লাশ দেশে ফিরবে। তিনি আরো জানান, একমাস সাত দিন আগে মাসুদ সপরিবারে ২/৩দিনের জন্য নিজ গ্রাম বোয়ালিয়াপাড়া আসে। পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে সে মিশনে যায়।
শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা এই দুঃসংবাদ শুনতে পান।