বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন দিগন্ত
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এতদিন তা কাজে লাগাতে পারেনি কোনো সরকার। একতরফা ভারতের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি বামপন্থি গণমাধ্যমের তৈরি করা ন্যারেটিভ ভেঙে জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড শক্ত করার উদ্যোগও নেয়নি কেউ। বরং ১৮ কোটি মানুষের বিশাল বাজারের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছিল আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী দেশটির হাতে।
ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মাঝে মধ্যেই সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিত নিত্যপণ্যের। যদিও জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের বাজারের ওপর দেশটির আধিপত্য কমতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চায় দুই দেশ। এই লক্ষ্যে এক বছর ধরেই কাজ চলছে, যা এখন একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। দুই দেশের বাজারের চাহিদা, বন্দরের সক্ষমতা, দাপ্তরিক কাজের সহজলভ্যতাÑ সবকিছুই পর্যালোচনা করছে উভয়পক্ষ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি ফ্লাইট চালু, করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি জাহাজ চলাচল, ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ বেশকিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দুই দেশ। বিপুল এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে শিগগির যৌথ রোডম্যাপ আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় এসেছেন। কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরসহ বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চষে বেড়াচ্ছেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের নেতৃত্বে একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিদল। শুক্রবার চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বসে প্রতিনিধি দলটি। তারা জানান, গত এক বছরে পাকিস্তান থেকে ১০টির বেশি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছে। চার থেকে পাঁচ মাস আগেই নির্দিষ্ট বেশ কিছু খাত চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্টভাবে তার ওপর কাজ করেছে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফরের উদ্যোগ নিচ্ছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া বেশ কয়েক ব্যবসায়ী নেতা জানান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে বেশ কিছু খাতে সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই প্রতিবন্ধকতা কাটাতে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করার ব্যাপারে পর্যালোচনা হয়েছে। এছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে আকাশপথে সরাসরি প্রথমে ঢাকা ও পড়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে ফ্লাইট চালুর ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে গত নভেম্বরে ট্রায়াল হিসেবে পাকিস্তানের করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি একটি জাহাজ এসেছে। কিন্তু জাহাজটি আসতে সময় লেগেছে প্রায় ১০ দিন। এ সময় আরো কমিয়ে আনার ব্যাপারে কাজ চলছে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য চালু হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের বাজারে। কারণ, পাকিস্তান থেকে চাল, ড্রাই ফুড, ফ্রুটস, সিমেন্ট ক্লিংকার, টেক্সটাইল পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিক্যাল, র-কটন ও পাকিস্তানি ফেব্রিকসে বেশ চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে চা, পান, কাঁচা পাট, পাটজাতীয় পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির বড় সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। এর মধ্য দিয়ে এক সময়ের সম্ভাবনাময় পাট ও চামড়া শিল্প ফের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য ছিল না বললেই চলে। তাই রুটটি সম্পূর্ণ নতুন। দুই দেশের বাজার পর্যালোচনা করে যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তা এখন পর্যন্ত শুধু খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ। আমরা যদি ভারতের বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানকে দেখতে চাই তবে এই মুহূর্তে তা হয়তো সম্ভব নয়। কারণ, জাহাজ ভাড়া ও সময় দুই ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে বেশি থাকবে। তবে দুই দেশের সরকার ও উদ্যোক্তারা আন্তরিক হলে এই দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে দুই দেশই লাভবান হবে। পাশাপাশি আগে যেখানে অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাজার শুধু একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল ছিল সেটা কমে আসবে।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নসরুল কদির বলেন, রাজনৈতিক নানা কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে বৈরিতা তৈরি হয়েছে। এ মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। এতদিন ভারতপন্থি সরকার ও গণমাধ্যমের প্রভাবে বাংলাদেশ ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে স্বাধীনভাবে ডিল করতে পারেনি। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর সেই ভীতি ভেঙে গেছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হলে নিশ্চিতভাবেই তা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।