কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। তবে এ শিল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে একাধিক সরকারি ও আন্তর্জাতিক লাইসেন্স, অনুমোদন এবং সার্টিফিকেট থাকতে হয়। একই কাগজপত্র একাধিক সংস্থায় বারবার জমা দিতে হচ্ছে। সাত সংস্থা থেকেই ব্যবসায়ীদের প্রায় ২১টি সনদ নিতে হয়। এসব সনদের বেড়াজালে পড়তে হয় এ খাতের উদ্যোক্তাদের। এ প্রক্রিয়া প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং কার্য সম্পাদনেও বিলম্ব ঘটায়। বর্তমানে এ খাতে বিপুল সম্ভবনা থাকলেও সনদ জটিলতাসহ বেশকিছু কারণে পিছিয়ে রয়েছে। তাই এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনা গেলে এ খাতের প্রসার বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প : দেশের সার্বিক উন্নয়নে গণমাধ্যমকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রাণ গ্রুপের উদ্যোগে আয়োজিত এ কর্মশালায় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা অংশ নেন। কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মূল প্রবন্ধে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছে অ্যাগ্রো প্রসেসিং খাত। তবে সাপ্লাই চেইনের দুর্বলতা ও শিল্প কাঠামোর কেন্দ্রীভূত চিত্র এখন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অ্যাগ্রো প্রসেসিং খাত কৃষি ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মধ্যবর্তী একটি সেক্টর। এটি প্রতি বছর প্রায় ৭০ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে। দেশের জিডিপিতে খাতটির অবদান প্রায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ম্যানুফ্যাকচারিং মূল সংযোজন মাত্র ১৩ শতাংশ। বর্তমান বাজারের আকার প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩০ সালে ছয় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে। দেশের প্রায় এক হাজার প্রসেসিং ইউনিটের মধ্যে প্রায় ২৫০টি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত।
এ খাতের অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে তিনি বলেন, কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের কার্যক্রম চালানোর জন্য উদ্যোক্তাদের সাত মন্ত্রণালয় থেকে ২১টি সনদ নিতে হয়। এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে চারটি, রপ্তানি উন্নয় ব্যুারো থেকে ছয়টি, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ থেকে পাঁচটি, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে তিনটি এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একটি করে সার্টিফিকেট নিতে হয়। তাও সবগুলো একই কাগজপত্র দিয়ে। তাই খাতটির অগ্রগতির এ বাধা দূর করতে হবে।
তিনি বলেন, খাতের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো রপ্তানি মাত্র কয়েকটি দেশে কেন্দ্রীভূত। মোট পণ্যের ৬০ শতাংশ মাত্র পাঁচটি গন্তব্যে যায়, যার মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত বড় গন্তব্য। অধিকাংশ পণ্য বিদেশে থাকা বাংলাদেশি শ্রমিক বা নির্দিষ্ট কারো কাছে বিক্রি হয়। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে বিস্কুট, নুডলস, ফ্রুট ককটেল ড্রিংক, পরোটা এবং চানাচুর প্রধান। তবে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য এক মিলিয়ন ডলারের নিচে, যা খাতকে লো-ভ্যালু এক্সপোর্ট হিসেবে চিহ্নিত করে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান এ শিল্প বড় কোম্পানি ও সীমিত পণ্যের ওপর কেন্দ্রীভূত। এর মধ্যে প্রাণ ও স্কয়ারের মতো বড় প্রতিষ্ঠান প্রধান বিনিয়োগকারী। বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, তবে মাত্র দুয়েকটি দেশ থেকে। তাই এ খাতকে এগিয়ে নিতে হলে আরো কোম্পানি আসতে হবে। তবে তা হতে হবে মানসম্মত। তাহলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং পণ্যের মানও বৃদ্ধি পাবে। অল্পকিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাজার একীভূত হলে তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে না।
সাপ্লাই চেইনের দুর্বলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, খাতের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানসম্পন্ন কাঁচামালের অভাব। কৃষকরা যা উৎপাদন করেন, তা প্রায়ই শিল্পে ব্যবহারের উপযোগী নয়। দেশে উৎপাদিত কাঁচামালের মাত্র ১৩ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করা যায়। মান নিয়ন্ত্রণ ও গ্রেডিং যথাযথভাবে না হওয়ায় পণ্যের মানে পার্থক্য দেখা যায় এবং বিদেশি বাজারে স্বাদ ও গুণগতমানে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এছাড়া কোল্ড চেইন, কোল্ড স্টোরেজ এবং ফ্রোজেন ভ্যানের অভাব বিদ্যমান। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, প্রাণ গ্রুপ শুরু থেকেই বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছে। বর্তমানে আমরা যেসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন করি, তার অধিকাংশ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকি এবং ১৪৮টি দেশে রপ্তানি করছি।
ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক রিয়াজ আহমদ তার উপস্থাপনায় কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প সমৃদ্ধকরণে গণমাধ্যমের প্রভাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গণমাধ্যম শুধু সংবাদ প্রচার করে না; বরং সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত খাতের সাফল্য, কৃষকদের গল্প, উদ্ভাবন ও বাজার সম্ভাবনা নিয়ে ধারাবাহিক ইতিবাচক প্রচার দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।