আজকের নারীরা শুধু গৃহস্থালির কাজেই সীমাবদ্ধ থাকেন না; তারা পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, উদ্যোক্তা বা অফিসকর্মী হিসেবে প্রতিদিন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। কর্মব্যস্ত জীবনের চাপ, সময়ের অভাব এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অনুপস্থিতি নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। দীর্ঘ সময় কাজের ব্যস্ততার কারণে ছোট ছোট স্বাস্থ্য সমস্যা অবহেলিত থেকে বড় জটিলতায় রূপ নিতে পারে। এই লেখায় কর্মজীবী নারীদের জন্য সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, ঝুঁকি এবং প্রতিকারের পরামর্শ তুলে ধরা হলো।
শারীরিক সমস্যা
* মেরুদণ্ড ও কাঁধের ব্যথা : দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা, ভারী ব্যাগ বহন করা বা অনিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম না করা মেরুদণ্ড, কোমর ও কাঁধে ব্যথার প্রধান কারণ। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি সময় বসে কাজ করা নারীদের প্রায় ৬০ শতাংশ মেরুদণ্ডের ব্যথার শিকার হন। সঠিক বসার ভঙ্গি, সমর্থনযুক্ত চেয়ার ব্যবহার, নিয়মিত স্ট্রেচ এবং পাঁচ-দশ মিনিট বিরতি নেওয়া ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। হালকা যোগব্যায়াম ও পিঠ শক্ত করার ব্যায়ামও জরুরি।
* চোখ ও দৃষ্টিশক্তি : কম্পিউটার, মোবাইল বা অন্যান্য স্ক্রিনে দীর্ঘ সময় কাজ করলে চোখ ক্লান্ত, লাল ও ঝাপসা হতে পারে। ‘২০–২০–২০ নিয়ম’ অনুসরণ করা জরুরি—প্রতি ২০ মিনিট পর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কোনো জিনিস দেখুন। পর্যাপ্ত আলো, স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত চোখের পরীক্ষা চোখের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
* ওজন ও হজম সমস্যা : ব্যস্ত জীবনে অনেক নারী নিয়মিত খাবার খেতে পারেন না। এতে ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস, হজম সমস্যা এবং পাকস্থলির জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচবার ছোট পরিমাণে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, প্রচুর পানি পান এবং সবজি, ফল ও প্রোটিন খাওয়া হজমশক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
* হৃদরোগ ও রক্তচাপ : চাকরি বা ব্যবসায় চাপ রক্তচাপ বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব এবং অনিয়মিত জীবনধারা হৃদরোগের কারণ হতে পারে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ কমানো এবং পর্যাপ্ত ঘুম হার্ট সুস্থ রাখতে অপরিহার্য।
* হাড় ও জয়েন্টের সমস্যা : দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করা, ভারী ব্যাগ বহন বা অনিয়মিত চলাফেরা হাঁটু, কোমর ও অন্যান্য জয়েন্টে সমস্যা সৃষ্টি করে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, যোগব্যায়াম এবং ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার হাড় ও জয়েন্টের সুস্থতা বজায় রাখে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
* স্ট্রেস ও উদ্বেগ : কর্মস্থলের চাপ, ডেডলাইন, পরিবার ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব নারীদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে। দীর্ঘ সময় উদ্বেগ, মনোযোগের সমস্যা, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। নিয়মিত মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং মানসিক বিশ্রাম স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
* ডিপ্রেশন ও ক্লান্তি : কর্মচাপের কারণে বিশ্রাম ও সামাজিক মেলামেশার অভাব নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশন বা মানসিক ক্লান্তি সৃষ্টি করতে পারে। বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, পছন্দের কাজ বা শৌখিন কাজ মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সহায়ক।
* ঘুমের সমস্যা : রাত্রিকালীন অতিরিক্ত কাজ বা মানসিক চাপ ঘুমের মান কমিয়ে দেয়। ঘুমের অভাব মনোযোগ, সৃষ্টিশীলতা এবং সার্বিক শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঘুমের আগে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার কমানো, নিয়মিত ঘুমের সময় ঠিক রাখা এবং শান্ত পরিবেশে বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রজনন ও হরমোনজনিত সমস্যা
* পিরিয়ডের অস্বাভাবিকতা : স্ট্রেস, অনিয়মিত খাবার এবং ওজন পরিবর্তনের কারণে মাসিক চক্রে সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ কমানো মাসিক চক্রের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে সহায়ক।
* হরমোন ভারসাম্য হ্রাস : কর্মব্যস্ততার কারণে হরমোনের ভারসাম্য ভেঙে যেতে পারে। এতে ওজন বৃদ্ধি, মানসিক চাপ এবং চুল ও ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, যোগব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম হরমোন ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
* প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি : দীর্ঘ সময় স্বাস্থ্যকর অভ্যাস না মানলে গর্ভধারণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টিকর খাদ্য এবং মানসিক শান্তি প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
জীবনধারা ও স্বাস্থ্য অভ্যাস
* অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস : ব্যস্ত জীবনে স্বাস্থ্যকর খাবারের পরিবর্তে ফাস্টফুড বা অস্বাস্থ্যকর খাবার বেশি খাওয়া ডায়াবেটিস, হজম সমস্যা ও ওজনজনিত সমস্যার কারণ হতে পারে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে সবজি, ফল, প্রোটিন, ডাল ও কম চর্বিযুক্ত খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
* শারীরিক ব্যায়ামের অভাব : দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারণে হাড়ের ঘনত্ব কমে, ওজন বৃদ্ধি পায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন অন্তত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা এবং যোগব্যায়াম বা হালকা শরীরচর্চা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত হালকা ব্যায়াম নারীর ওজন, মানসিক স্বাস্থ্য ও হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য উন্নত করে।
* পানি কম খাওয়া ও ডিহাইড্রেশন : পর্যাপ্ত পানি না খাওয়ার ফলে ক্লান্তি, ত্বকের সমস্যা এবং ডিহাইড্রেশন হতে পারে। দিনে অন্তত দু-তিন লিটার পানি পান করা উচিত। চা-কফি বেশি পান করলে ডিহাইড্রেশন বাড়তে পারে, তাই পানি বা হালকা জুস বেছে নেওয়া উত্তম।
* সময় ব্যবস্থাপনা ও বিশ্রাম : কর্মব্যস্ত নারীদের জন্য সময় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। দৈনন্দিন কাজগুলোকে অগ্রাধিকার অনুযায়ী ভাগ করা, অবসর সময়ে হালকা ব্যায়াম, মেডিটেশন বা প্রিয় কাজ করা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্য সচেতনতার গুরুত্ব
কর্মময় নারীরা যদি নিজের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার না দেন, তাহলে ছোট সমস্যা বড় জটিলতায় রূপ নিতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি, ব্যায়াম এবং মানসিক বিশ্রাম অপরিহার্য।
পরামর্শ
* প্রতি ছয় মাসে বা বছরে একবার সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন।
* প্রতিদিন অন্তত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা, যোগব্যায়াম বা হালকা শরীরচর্চা করুন।
* পর্যাপ্ত ঘুম এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান।
* স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন; পর্যাপ্ত সবজি, ফল, প্রোটিন ও কম চর্বিযুক্ত খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন।
* পর্যাপ্ত পানি পান করুন; দিনে দু-তিন লিটার পান করা প্রয়োজন।
* স্ট্রেস কমাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, মেডিটেশন ও হবি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করুন।
কর্মময় নারীরা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তবে কর্মব্যস্ত জীবন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে এই সমস্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। নিজের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার না দিলে ছোট সমস্যা বড় জটিলতায় রূপ নিতে পারে। তাই নারীদের জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সঠিক জীবনধারা অপরিহার্য।
লেখক : নারীর স্বাস্থ্য ও জীবনধারা পরামর্শক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
drmazed96@gmail.com