ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে বড় ভাই রবিউল
রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাজলায় গতবছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে শহীদ ইমাম হাসান তাইমকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে রাস্তায় ফেলে তার মৃত্যু যেন উপভোগ করছিল যাত্রাবাড়ী পুলিশ।
সোমবার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার সময় ভয়াবহ এ ঘটনার বর্ণনা দেন শহীদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই।
তাইমের বড় ভাই রবিউল ট্রাইবুনালে জানান, তাদের বাবাও একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি পুলিশের সিনিয়র এস আই।
এ ঘটনায় তাইমুরের বাবা পুলিশের এসআই মো. ময়নাল হোসেন ভুঁইয়া তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘একজন মানুষকে মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার’। আমার ছেলের কি দোষ ছিল, কেন তাকে এত কষ্ট দিয়ে মারা হলো? কেন তার শরীরে দুইশ গুলি মারা হলো।
রবিউল জানান—আমার ছোট ভাই ইমাম হাসান তাইম ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুরু হতেই অংশগ্রহণ করত। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছর ১৬ থেকে ১৯ জুলাই সে সারা দিন যাত্রাবাড়ি এলাকায় আন্দোলনে ছিল। ঘটনার দিন ২০ জুলাই ইমাম হাসান দুপুর ১২টায় কারফিউ শিথিল হলে চা খাওয়ার কথা বলে বাসা হতে বের হয়ে যায়। তারপর বন্ধুদের নিয়ে কাজলা এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আমি সিলেট হতে দুপুর ১২টায় তাকে কয়েকবার ফোন দিচ্ছিলাম। কিন্তু সে তখন আর আমার ফোন রিসিভ করেনি। পরে আবার সাড়ে ১২টার দিকে ফোন দিলে তার ফোন বন্ধ পাই। এর কিছুক্ষণ পর বেলা প্রায় ১২টা ৫০ মিনিটের সময় আমাদের বাড়িওয়ালা হঠাৎ এসে জানায় ইমাম হাসানকে গুলি করার খবর পাওয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার আম্মা কাজলা ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখতে পায় রাস্তায় প্রচুর রক্ত। ইমাম হাসান তাইমের জুতাগুলো রাস্তায় তখনো পড়ে আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়—তাইমকে একটি রিকশা ভ্যানে করে কিছু পুলিশ যাত্রাবাড়ি থানার দিকে নিয়ে গেছে। তার আগে কাজলা ব্রিজের নিকট ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে পুলিশ যাত্রাবাড়ি থানা থেকে বের হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। এতে ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে তাইমসহ কয়েকজন বন্ধু কাজলা ব্রিজের পাশে লিটন চা স্টলে আত্মগোপনের চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েকজন পুলিশ তাদের টেনে-হিঁচড়ে বাইরে আনে। এরপর চরম গালিগালাজ ও সাথে প্রচণ্ড লাঠিপেটা করে। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাদের দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বললে সরল বিশ্বাসে তাইম দৌড় দিলে পুলিশ তার পায়ে গুলি করে। এরপরই তার পেটের নিচে আবারো গুলি করা হয় যা তলপেট ছিদ্র হয়ে অপর দিকে বের হয়ে যায়। হতচকিত এ ঘটনায় তাইম একটু পেছন ফিরলে আরেক পুলিশ সদস্য তাকে কাছ হতে শর্ট গানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। এ সময় তার বন্ধু রাহাত তাইমকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে উন্মুক্ত পুলিশ সদস্যরা তাকেও গুলি করে। এ অবস্থায় তাইম প্রায় আধা ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে থাকে। এ সময় ঘটনার সময় উপস্থিত এক সাংবাদিকসহ কয়েকজন তাকে হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করা হলে পুলিশ সদস্যরা এতে বাধা দেয়। যেন এ সব পুলিশ সদস্য তার যন্ত্রণাময় মৃত্যু উপভোগ করছিল।
তাইমের ভাই রবিউল জানান—ঘটনাস্থল হতে ২০০ গজের মধ্যে রাস্তার দুপাশে দুটি হাসপাতাল থাকলেও পুলিশ তাকে কোনো হাসপাতালে নিতে দেয়নি। পরবর্তীতে তার আধামৃত দেহটি রিকশা ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ি থানার সামনে নিয়ে আসে। এরপর গুলিতে ঝাঁঝরা তার দেহটি রাস্তায় ফেলে কিছু পুলিশ সদস্য বুট-জুতা দিয়ে তার চেহারা ও শরীর থেঁতলে দেয়। এরপর তাইমের শরীর যখন পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যায় তখন তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কতর্ব্যরত চিকিৎসকগণ তাইমকে মৃত ঘোষণা করেন। তাইমকে মারার ভয়াবহ ভিডিও পরবর্তীতে ঘটনার পর ২৬ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তাইমের ভাই রবিউল জানান, বিভিন্ন ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শী মারফত আমরা জেনেছি নৃশংস এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন পুলিশের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ও প্রলয় কুমার। ছাত্রজনতা ও তাইমকে তখন প্রথম পায়ে গুলি করে যাত্রাবাড়ি থানার এসআই সাজ্জাদুজ্জামান। এরপর ঘটনাস্থলে উপস্থিত এডিসি শামীম অন্য পুলিশ হতে দ্রুত একটি অস্ত্র নিয়ে তাইমকে দ্বিতীয়বার গুলি করেছিল যা তার তলপেট ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। আর পরবর্তীতে যাত্রাবাড়ি থানার ওসি তদন্ত জাকির হোসেন তাইমের শরীর লক্ষ্য করে শর্টগানের গুলিতে পুরো শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। পরবর্তীতে দেখা যায় প্রায় ২০০ স্প্রিন্টার তার শরীরে রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া যাত্রাবাড়ির সে সময়ের কয়েকটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয় যাতে তাইম ও ছাত্র-জনতার ওপর মুহু মুহু গুলি করতে দেখা যায়।
রবিউল জানান—পরবর্তীতে আমরা তৎকালীন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি আমাদের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান। যাত্রাবাড়ি থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ কোনো মামলা নেয়নি। এমনকি পুলিশের ডিসি ইকবালের সাথে দেখা করে মামলা দিতে চাইলে তিনি আমাদের মামলা না নিয়ে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে বলে জানান। এতে আমরা রাজী হয়নি, মামলা না করতে পেরে চলে আসি। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আমরা আমাদের ১৫ বছরের পুরোনো এলাকায় সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি ও জালাতনে থাকতে পারিনি। আমরা পালিয়ে অন্য এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হই।
শহীদ ইমাম নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী নগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।