২০২৪ সালের ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারা দেশে পালিত হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। ১৭ জুলাই রাত ৮টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন আন্দোলনের অনলাইন সমন্বয়কারীরা। ঘোষণা অনুযায়ী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকেনি, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া কোনো যানবাহন চলেনি। সারা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
ভোর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো। ঢাকাসহ ৪৭টি জেলায় রাস্তাঘাট ও রেলপথ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। উত্তরা, সাভার, যাত্রাবাড়ী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও অজ্ঞাত হামলাকারীরা গুলি চালালে অন্তত ৩১ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ২৬ শিক্ষার্থী নিহত হন।
নিহত অন্যরা ছিলেন পুলিশ সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষ। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে রাজধানীসহ দেশের ৪৭টি জেলার বহু এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
১৭ জুলাই আন্দোলনকারীদের অন্যতম এক সমন্বয়ক ফেসবুকে লিখেছিলেনÑ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিহিংসা ও খুনের বিচার, ক্যাম্পাস নিষ্ক্রিয় করার ষড়যন্ত্র এবং কোটার বিরুদ্ধে আমরা এ শাটডাউন আহ্বান করছি।’
১৮ জুলাই সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। একাধিক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার-সমর্থক সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও গুলিবর্ষণ, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও ইটপাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
ঢাকায় নিহত ১৯
সেদিন রাজধানীর উত্তরা, রামপুরা, আজিমপুর, তেজগাঁও, মালিবাগ, ধানমন্ডি, শান্তিনগর, যাত্রাবাড়ী, কাজলাসহ একাধিক স্থানে সংঘর্ষ হয়। উত্তরা এলাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যান ১১ জন। তাদের মধ্যে ছিলেন নর্দান ইউনিভার্সিটির ছাত্র আসিফ ও সাকিল। ধানমন্ডিতে নিহত হন রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ।
যাত্রাবাড়ীতে সাংবাদিক হাসান মেহেদীসহ মারা যান আরো পাঁচজন। মালিবাগ ও শান্তিনগরে সংঘর্ষে অনেকে আহত হন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন শতাধিক আহত ব্যক্তি।
এদিন রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন বিটিভি কার্যালয়ে একাধিকবার হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যার পর বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। মেরুল বাড্ডায় পুলিশের একটি দল কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আশ্রয় নিলে তাদের হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়।
উত্তরায় শিক্ষার্থীরা প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। এপিসি (সাঁজোয়া যান) এসে গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়লে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীরা অলিগলিতে অবস্থান নিলে পুলিশ বাড়িঘরে ঢুকে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। কাঁদানে গ্যাসে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয় অনেক শিক্ষার্থীর। কমপক্ষে তিনজন কোমায় চলে যান। শিশুরাও রক্তাক্ত হয়, একটি শিশুর মাথায় গুলি লাগে।
বিকালে শাহবাগে শিক্ষার্থীদের মিছিলে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। সাড়ে ৫টার দিকে কফিন মিছিল শুরু হতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা সূর্য সেন হলের আশপাশে অবস্থান নিলে সেখানে পুনরায় সংঘর্ষ শুরু হয়।
একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের বহিরাগত সদস্যরা হামলা চালায়। পরে সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং শিক্ষার্থীদের হলত্যাগে বাধ্য করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশাসনিক ভবনে ইটপাটকেল ছোড়েন। উপাচার্যসহ কর্মকর্তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বিকালে বিজিবি ও শতাধিক পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। পাঁচ-ছয়জনকে এনাম মেডিকেলে পাঠানো হয়।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দেওয়া হয়। অধিকাংশ হলের প্রাধ্যক্ষ রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। রোকেয়া, শামসুন নাহার, ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পাঁচটি নারী হল এবং সব ছাত্র হল থেকে ছাত্রলীগ বহিষ্কৃত হয়। অনেক হলেই ছাত্রলীগের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।
দিনভর সংঘর্ষে সারা দেশে আহত হন অন্তত এক হাজার ৫০০ জন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন ৮০ জন। এদিন থেকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার, মেট্রোরেল চলাচলও স্থগিত করা হয়।
১৮ জুলাই শনির আখড়া, শাহবাগ, পুরান ঢাকা এবং চানখাঁরপুল এলাকায় রাত পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। পুলিশের শটগানের গুলিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। কাজলার টোলপ্লাজায় আগুন দেওয়া হয়। আহতদের মধ্যে শিশুরাও ছিল।
চিকিৎসকরা জানান, অনেকেই মাথায়, বুকে ও চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে এসেছেন।
ঢাকার বাইরে ও ভয়াবহ পরিস্থিতি
এদিন চট্টগ্রাম ও নরসিংদীতে দুজন করে, মাদারীপুর, সিলেট, রংপুর, পাবনা ও সাভারে আরো ছয়জন নিহত হন। হবিগঞ্জে সংঘর্ষে আহত হন প্রায় ২০০ জন, ঝিনাইদহে সংসদ সদস্য নায়েব আলী জোয়ারদারের গাড়িতে হামলা হয়।
পুলিশ ও সরকারের তথ্যমতে, এদিন দেশব্যাপী সহিংসতায় এক হাজার ৫০০ জনের বেশি আহত হন এবং ২৪৭ জনকে আটক করা হয়। বহু সরকারি অফিস, থানা ও রাজনৈতিক দলের কার্যালয়েও হামলার ঘটনা ঘটে।
এভাবেই ১৮ জুলাইয়ের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পরিণত হয় গণবিক্ষোভের রক্তাক্ত অধ্যায়ে।
শেখ হাসিনার সান্ত্বনা ব্যর্থ হয় আন্দোলন থামাতে
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশজুড়ে চলমান ছাত্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি আন্দোলনের ওপর সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দেন এবং শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান। কিন্তু তার ভাষণের পরও সারা দেশে আন্দোলন থামেনি; বরং তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
হাসিনা নিহতদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করলেও ছাত্রলীগ ও সরকারি বাহিনীর হামলা এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। সরকার প্রশাসনিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালায়। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সহনশীলতার কথা বললেও একই দিনে সারা দেশে আটটি জেলায় সংঘর্ষ, ১০টি সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ এবং শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা, পুলিশের গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খালি করার নির্দেশ—সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয় সরকার ‘শান্তি’র নামে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চেয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ১৮ জুলাই দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতায় রূপ নেয়। ছাত্রলীগ ও সরকারি দলের কর্মীদের হামলা, পুলিশের গুলিবর্ষণ ও দমনমূলক ব্যবস্থায় আন্দোলন আরো বিস্তৃত ও তীব্র হয়ে ওঠে।