জহির জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। নিউজ ইমেইল করা ছাড়াও সহকর্মীদের সঙ্গে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় আলোচনা করতে করতে কখন যে রাত ৯টা বেজে যায় টেরই পায় না। আজকেও রাত ১০টা বেজে গেছে। আকাশে হালকা মেঘের আস্তরণ, জোছনার আলো অনেকটা ফিকে হয়ে আছে।
নদীর ওপাশ থেকে খেয়া পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে জহির ইশকুলের মাঠে গেল। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস, বাড়ি ফেরার আগে এখানে কিছুক্ষণ বসে। এই নিস্তব্ধতা আর নদীর কুলকুল স্রোত তার খুব ভালো লাগে। কখনো একা বসে থাকে; আবার কখনো রতন শেখ এসে সঙ্গ দেয়।
ইশকুলের মাঠের এক কোনায় পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসে আছে রতন শেখ। আলো-আঁধারির মধ্যে তার মুখ কিছুটা বিবর্ণ দেখাচ্ছে। জহির কাছে যেতেই রতন মাথা তুলে তাকায়।
– এসেছ জহির?
– হ্যাঁ। ভাবলাম একটু বাতাস খেয়ে যাই।
– বসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
জহির ঘাসের উপর বসে পড়ে। রতন শেখও চেয়ার থেকে এসে ঘাসেই তার পাশে বসে। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। রতন শেখ গভীর শ্বাস নেয়। তারপর বলে, ‘তোমাকে একটা কথা বলব, জহির। বহুদিন ধরে বুকের ভেতর রয়ে গেছে।’
– বলুন, চাচা। শুনি।
রতন শুরু করে—‘তখন আমার বয়স বিশ কিংবা একুশ হবে। অভাবের সংসার। নদীভাঙনে জমিজমা সব খুইয়েছি। কোনো রকম দোচালা একটা ঘরে মা, তোমার চাচির পেটে বাচ্চা। আবার ছোট এক ভাই সংসারে। কামলার কাজ নেই তখন। এক দুপুরে ঘরে ফিরে দেখি খালি পাতিল নিয়ে মা বসে আছে। তার চোখ ভেজা। রোকেয়া মাথা নিচু করে মায়ের পাশে বসে আছে। আমার এসব সহ্য হয় না। কিন্তু কোনো উপায় নেই। পাকবাহিনীর ভয়ে তটস্থ গ্রামবাসী। যেকোনো সময় আক্রমণ চালাতে পারে । কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’
দম নিয়ে রতন শেখ বলতে থাকে, ‘বিকালে বাজারে গেলাম। বিশ্বাসের হাটের করিম ফার্মেসিতে বসেছিল আকবর চৌধুরী। সে গ্রামের মাতব্বর। গ্রামের সবাই জানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। সে চায় পাকিস্তান টিকে থাকুক। আমাকে দেখে ডাক দেয়, কি রে? কই যাস? কাজকর্ম করিস কিছু?’
– না চাচা, অবস্থা ভালো না। কাজকর্ম নেই। খালার বাড়িতে যাচ্ছিলাম, যদি কিছু চাল আনতে পারি।
– বুঝেছি। এক কাজ কর। আর্মি ক্যাম্পে কিছু সদাইপত্র আনা-নেওয়ার কাজ করার জন্য একজন লোক দরকার। ভয় নাই, শুধু বাজার-সদাই করে দিবি। কি পারবি?
আমি ভয় পেয়ে যাই। উশখুশ করতে থাকি। চৌধুরী ধমক দেয়, কি পারবি না? আমি আছি তো।
আমি তটস্থ হয়ে বলি, টাকা দেবে?
– হ্যাঁ দেবে। চাইলে চাল-ডালও পাবি।
আমি আর কিছুই ভাবি না। সে মুহূর্তে ক্ষুধাই আমার সবচেয়ে বড় বিপদ!
সেদিন সন্ধ্যায় প্রথমবার আকবর চৌধুরীর সঙ্গে আর্মির ক্যাম্পে গেলাম। কী করতে হবে আর্মিদের সামনে—আবার আকবর চাচা বুঝিয়ে দিল। তার পর থেকে প্রতিদিন সকালে বাজারের ফর্দ নিয়ে বিশ্বাসের হাট যাই। রাজাকারের খাতায় নাম উঠে যায় আমার। প্রতি সপ্তাহে একবার সই দিতে হয় খাতায়। সই দেওয়ার পর চাল-ডালের সঙ্গে টাকাও দেয়। আশেপাশে খুন হতে থাকে। একদিন পাশের গ্রামের একজনকে ক্যাম্পে ধরে আনে আর্মি। কয়েক দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় নদীর পাশে। হাত-পা বাঁধা।
জহির চুপ করে থাকে।
ঢোক গিলে রতন আবার শুরু করে, সে রাতে ঘুমানোর সময় তোমার চাচিকে বলি, ‘আমি আর ক্যাম্পে যাব না। এই কাম আমার নয়। আমার ভয় লাগে।
সে কিছু জিজ্ঞেস করে না। কাঁদে। সে জানে, তাদের জন্যই আমি এই ঝুঁকি নিচ্ছি। অন্যদের মতো আমারও মৃত্যু হতে পারে। পাকবাহিনী কিছু না করলেও মুক্তিবাহিনী আমাকে পেলে হয়তো ছাড়বে না।
শেষ দিকে পাকবাহিনীর অত্যাচার আরো বাড়তে থাকে। আশপাশের গ্রাম থেকে প্রায় দিনই ছেলেদের মুক্তিবাহিনী সন্দেহে ধরে আনতে থাকে। আর ক্যাম্পে বেঁধে অত্যাচার করতে থাকে। তার দু-এক দিন পর তাদের লাশ ফেলে রাখে নদীর পাড়ে।
তারপর একদিন যুদ্ধ শেষ হয়। যারা ক্যাম্পে কাজ করত, তাদের অনেকেই পালায়। ক্যাম্প ছেড়ে পালায় পাকিস্তানি আর্মি। কিছু ধরাও পড়ে। তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে মুক্তিবাহিনী আর গ্রামের লোকজন।
– আপনি পালাননি?
– আমি পালাইনি। পালানোর মতো সাহস ছিল না আমার। নিজের ভিটেমাটি, আত্মীয়-স্বজন রেখে পালাব কোথায়! থেকে গেছি গ্রামের সেই ভাঙা ঘরে।
– আকবর চৌধুরীকে কেউ কিছু বলেনি?
রতনের নিস্পৃহ জবাব—‘না, না, তার কিছুই হয়নি। তার ছোট ভাই মুক্তিবাহিনীর লোক হওয়ায় বেঁচে গেছে। তারপর তাড়াতাড়ি পক্ষ পাল্টে ফেলেছে। কিন্তু আমার কিছুই পাল্টায়নি। আবার সেই ক্ষুধার জ্বালা। কী আর করব—আবার কাজ খুঁজতে শুরু করি। এবারও সেই আকবর চাচা। তার সুপারিশেই এই ইশকুলের দপ্তরির চাকরি পেয়েছি। প্রথম দিন কাজে যোগ দেওয়ার পর মৌলভী স্যার বললেন, ‘এখন থেকে প্রতিদিন সকালে তুমি পতাকা উত্তোলন করবে।’
আমি চুপচাপ মাথা নেড়েছি। সেই থেকে শুরু। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দ্রুত ইশকুলে যাই। লাল-সবুজ পতাকাটা মাঠে ডান পাশের স্ট্যান্ডে বেঁধে তুলি। দাঁড়িয়ে থাকি। এই নিয়মে বছরের পর বছর।
রতন শেখ চুপ হয়ে যায়। মাথা নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ।
জহির ধীরে জিজ্ঞেস করে, এই কথা আগে কাউকে বলেছেন?
রতন শান্ত গলায় বলতে থাকে, ‘গ্রামের অনেকেই তো জানে। তবে মুক্তিবাহিনীকে গোপনে সংবাদ দেওয়ার কথা তেমন কেউ জানে না। যারা জানত এখন তারা কেউ বেঁচে নেই। তবে মুক্তিবাহিনীর লোক—এ কারণে আমাকে মারেনি।’
রতন হঠাৎ পতাকার দিকে তাকায়। আস্তে করে বলে, ‘এখন তো আমি পতাকা টানাই। তারপরও কি এই পাপ মাফ হবে না?’ তার গলা কেঁপে ওঠে। সে বলে যায়, ‘৪১ বছর ধরে রোজ সকালে পতাকা টানিয়েছি, নামিয়ে যত্ন করে রেখেছি।’
জহির কৌতূহলী চোখ নিয়ে তার মুখে তাকিয়ে থাকে। নদীর তীরে আছড়ে পড়ছে ক্লান্ত ঢেউ। তাদের শরীরেও যেন অভাবের তৃষ্ণা। তারাও রতনের মতো উদ্বিগ্ন, উদ্বাস্তু মন নিয়ে ভেতরে ভেতরে হাউমাউ করছে।
জহির অনেকক্ষণ কিছু বলে না। তার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে—পতাকা টানানোর মধ্যে কি পাপমোচনের চেষ্টা ছিল রতন শেখের? শুধু দেশপ্রেম আর গ্লানির ভারে এই পতাকা টানানো?
২.
ইশকুলে পুলিশের গাড়ি এসে ঢুকেছে। সঙ্গে গ্রামের চৌকিদার। রতন শেখ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। একজন শিক্ষক তাকে ইশারা করল—‘রতন ভাই, আপনাকে ডাকছে।’ প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকতেই ভরাট গলায় পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আপনার নাম রতন শেখ?’
– জ্বি... রতন শেখ।
– বাবার নাম হাশেম শেখ, গ্রাম হরিরচর?
– জ্বি...স্যার।
কাগজে চোখ রেখে তদন্ত কর্মকর্তা বললেন, ‘আপনি তো ১৯৭১ সালে রেজাকার বাহিনীতে ছিলেন। আমরা তখনকার রেজাকারদের তালিকায় আপনার নাম খুঁজে পেয়েছি।’
রতনের ঠোঁট শুকিয়ে যায়। গলার স্বর বের হলো ক্ষীণভাবে—‘স্যার, আমি শুধু বাজার-সদাই করতাম। কাউকে মারিনি। তখন বুঝতেও পারিনি কী করছি।’
তদন্ত কর্মকর্তা তার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা হয়নি। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। আপনি সামনের রোববার থানায় দেখা করবেন। বিস্তারিত কথা হবে।’
রতন মাথা নিচু করে রুম থেকে বের হয়ে আসে। মাঠে এসে এক কোনায় দাঁড়ায়। তার কানে বাতাসে দুলতে থাকা পতাকার শব্দটা যেন কান্নার মতো লাগছে।
৩.
এ পর্যন্ত গিয়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারে স্বপ্ন দেখছিল। পুরো শরীর ঘেমে গেছে। উঠে পানি খায়। পুরো রাতে তার আর ঘুম হয় না।
সকালে যথারীতি নিজ হাতে জাতীয় পতাকা তোলে রতন শেখ। পতাকা তোলার মুহূর্তে তার চোখে পানির রেখা চিকচিক করে ওঠে। সে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। পতাকা তোলার সময় রতনের বুক কাঁপে।
জহিরও সারা রাত ঘুমাতে পারল না। তার মনের ভেতরে দুই বিপরীত স্রোত। সে জানে রেজাকারের তালিকায় রতন শেখের নাম রয়েছে কেবল সহযোগী বা সাপ্লাই-সহায়ক হিসেবে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তা জানে না, তাকে নিয়ে ফিসফিস করে।
প্রেস ক্লাব থেকে ফিরতে জহিরের একটু দেরি হয়ে যায়। মাঠে এসে দেখল এক কোণে মন খারাপ করে বসে আছে রতন শেখ। জহির গিয়ে তার পাশে বসল। তার মাথায় গতকালের আলোচনার রেশ। সে অনুভব করল, রতনের অপরাধ যতটা না ইচ্ছাকৃত, তার চেয়ে বেশি ছিল দারিদ্র্য আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ফল।
জহির বলে, আচ্ছা চাচা, আপনি এখন যে কাজ করেন, সেটাকে কি ওই কাজের শাস্তি মনে করেন? আর আপনি যদি নিজেকে নির্দোষ মনে করেন, তাহলে ভয় পাবেন কেন?
রতনের কণ্ঠ ভারী, ভয় তো মন থেকে আসে। তুমি জানো না, আমি কত রাত ঘুমাতে পারি না। মনে হয় কেউ আমার পেছনে গোয়েন্দার মতো লেগে আছে। আমি মানুষ খুন করিনি, এইটা কি কেউ বুঝবে?
যুদ্ধের নৃশংসতা, বিচার আর অনুশোচনার এই জটিল ছায়াপথে জহির বুঝতে পারে, সত্যিকারের অনুশোচনা কতখানি গভীর হতে পারে। কেউ কেউ আজীবন নিজেদের ভেতরে সাজা ভোগ করে।
কথা বলতে বলতে রাত গভীর হয়ে যায়। বাতাসে হালকা ঠান্ডা। জহির উঠে দাঁড়ায়। রতনও উঠে দাঁড়ায়, তার মাথা নিচু।
জহির চিন্তা করে, পতাকা তুলতে তুলতে একজন মানুষ হয়তো নিজেকে প্রতিদিন সাজা দিয়ে এসেছে; এই সাজা হয়তো কোনো আদালত থেকে দেওয়া শাস্তির চেয়ে কম নয়। কিন্তু এটা তো বিচার নয়।
জহির আস্তে করে বলে, ‘চাচা যা-ই বলেন, পতাকা টানানো তো কোনো বিচার নয়। বিচার তো বাকি।’
রতন শেখ কিছু বলে না। তার চোখে কেবল ঝাপসা চাউনি। জহির সাইকেলের দিকে হাঁটা দেয়। পেছনে পড়ে থাকে ইশকুলের মাঠ, পতাকার খুঁটি আর একটি অনুতপ্ত মুখের বটবৃক্ষ।