গভীর মনোযোগের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মালা গেঁথে চলেছেন ৩৫ বছর বয়সি আয়শা। নববধূর চুলের খোঁপায় পরবে বলে গাজরা মালা গাঁথছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তার গাঁথা মালায় সাজে অনেক মেয়ের বাসরঘর এবং নববধূকে বহনকারী বরের গাড়ি। এভাবেই প্রতিদিন অনেকের নতুন জীবন শুরু হয় তারই হাতের গাঁথা মালায়।
বলছিলাম রাজধানীর শাহবাগের একটি ফুলের দোকানের কর্মী আয়েশার কথা। সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয় আমার দেশ-এর এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, ৩০ পেরোলেও নিজের বিয়ের মালাই এখনো গাঁথা হয়ে ওঠেনি তার। সারা বেলা ফুলের স্নিগ্ধতা আর সৌন্দর্যের মধ্যে কাটলেও ফুলের মতো কোমল আর মসৃণ নয় তার জীবন। নিজেদের দুঃখ-কষ্ট হৃদয়ে গোপন রেখে বহু মানুষের মনের আনন্দের খোরাক আর স্বপ্নের অংশীদার হয়ে থাকেন তিনি।
শাহারা বেগম (৫০) নামের আরেক নারী জানান, ২০ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। সংসার চালাতে এখন মালা গাঁথার কাজ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই ট্যাকা আমি ছেলেমেয়েদের পেছনে খরচ করি।’
আয়শা বা শাহারার মতো যুথি, মাইমুনা, মনি, রুবিদের প্রতিটি সুইয়ের ফোঁড়ে লুকিয়ে থাকে একেকটি জীবনের ব্যথাময় গল্প। তাদের কৈশোর, যৌবন আর বৃদ্ধকাল গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের মতো সুতার বাঁধনে আটকা। ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও অন্যান্য বিশেষ দিনগুলোতে এই শ্রমিকরা থাকেন ভীষণ ব্যস্ত।
আরো বেশ কয়েকজন মালা গাঁথার কারিগরের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মহিমা, আফরোজা, আরিফা, আকলিমা, মেহেরা, রহিলা ও শাহিদা—তাদের সবার গল্প প্রায় একইরকম। তারা জানান, আগে একটি মালা গেঁথে পেতেন ৫০ পয়সা। এখন পান এক টাকা। পারিশ্রমিক আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো বলে জানান তারা।
শাহবাগের ফুল দোকানের সামনের অংশটুকুতে ফুল ছড়িয়ে মালা গাঁথতে গাঁথতেই কথা হয় আরেক ফুলমালার কারিগর পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার হালিমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, ‘আমাদের মতো গরিবের কথা কে ভাবে বলেন আপা। কাজের তো কোনো নিশ্চয়তা নেই, আজ এইহানে তো কাল ওইহানে। ভালো কোনো জায়গায় বসে কাজ করার সুযোগ নাই।’
রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে ঝামেলায় বেশি পড়েন বলে জানান হালিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘সন্তানডারে কোথায় রাইখ্যা আসমু। কারো কাছে রাইখ্যা কাজে আইলেও চিন্তা হয়। সেই চিন্তায় কাজ করতে পারি না। তার থেকে সাথে নিয়ে আসা ভালো। ওর আর আমার দুজনেরই একটু কষ্ট হয়। তবু চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা যায় বলেই সাথে আনি। মাইয়াডারে চোখের সামনে না রাখলে আমার কোনো কাজেই মন বয় না।’
আসলে মা মানে ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানের প্রতি দায়িত্ব। সন্তানের কাছেও মা মানে আস্থা। কোনো না কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেও সন্তানের প্রতি কোনো ধরনের অযত্ন রাখেন না মা। সব কাজের মধ্যেও মাই পারেন তার সন্তানের সব প্রয়োজন মেটাতে।
শাহবাগ ফুলের দোকানে কর্মরত মাইমুনা আমার দেশকে জানান, বাসরঘরের জন্য একটা লম্বা চিকন মালা দুই টাকা, গায়েহলুদের গহনা কিংবা বিয়ের মালা বানালে ২০ থেকে ২০০ টাকা পেয়ে থাকেন তারা। ফুলের দোকানের মালিক সুই, সুতা, ফুল দিয়ে থাকেন। তাদের শুধু মালা গাঁথার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। বিক্রির কাজটি দোকান মালিকই করে থাকেন। তাই যে যত বেশি ফুল গাঁথার সুযোগ পাবে, সে তত বেশি টাকা পায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) উপপরিচালক (তথ্য) ইউসুফ আল-মামুন আমার দেশকে বলেন, দেশে ঠিক কতজন নারী শ্রমিক ফুল দিয়ে মালা গাঁথেন, তার কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে এটি একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং ঐতিহ্যবাহী কাজÑযা মূলত গ্রামীণ বা স্থানীয় পর্যায়ে হয়ে থাকে এবং এদের সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। তাই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন; কারণ এটি সাধারণত ছোট আকারে এবং স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী হয়, যা সামগ্রিক শ্রমশক্তি জরিপে অন্তর্ভুক্ত হয় না।
প্রায় তিন যুগ ধরেই ফুলের মালা গাঁথার কাজ করছেন আছিয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘বেশি কাজ পাইলে টেহা বেশি আহে। দিনে ২০০ টেহা, আবার ফাগুন-বৈশাখ আহে যহন, তখন ৩০০ টেহাও আহে। কোনো কোনোদিন কোনো কাজই থাহে না।’
ফুলের কারিগর আছিয়ার ছেলেও ফুলের কাজ করেন। এভাবে ফুলের ওপর নির্ভর করেই চলছে আছিয়ার পরিবারের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় অভিযোগ করে আছিয়া জানান, কষ্ট-সংগ্রামের এ জীবনে বাড়তি বিড়ম্বনা হিসেবে যোগ হয় টয়লেট সারা। নারী হওয়ায় প্রতিদিনই টয়লেটের অসুবিধায় পড়েন তারা। আশপাশে পাবলিক টয়লেট থাকলেও অর্থসংকটে সেই সুবিধা নিতে কষ্ট হয় সবার। আছিয়া আক্তার বলেন, ‘প্রতিদিন তিন-চারবার গেলে সব মিলায়ে ৩০ টাকা করে চলে যায়। আবার যাওয়া-আসার ভাড়া তো আছেই। এজন্য মাঝেমধ্যে টয়লেট চাপায়ে রাখি।’
নিউ লাভ লাইন পুষ্পালয়ের মালিক মো. রুবেল বলেন, শাহবাগে সর্বাধিক ফুল বিক্রি হয় পহেলা ফাল্গুন। এরপরই ২১ ফেব্রুয়ারি। প্রতিটি দোকানে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ব্যবসা হয়। আর বড় দোকানগুলোতে এর পরিমাণ তিন থেকে চার লাখ টাকারও বেশি হয়।
সব ফুলের নাম ঠিকমতো জানেন না নাটোরের যুথি খাতুন (২৫)। তবুও সেসব ফুলেরই মালা গেঁথে চলেছেন। পাঁচ-ছয় হাত লম্বা একটি মালা গেঁথে পারিশ্রমিক পান এক টাকা। প্রায় প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যান মহাজনের বাগানে, নিজের হাতে সংগ্রহ করেন ফুল। এরপর বাড়িতে বসে গাঁথেন মালা। গ্রামের অন্যান্য নারীও মালা গেঁথে যুথির কাছে দিয়ে যান। বিকালে তার বাড়ি থেকে এসব মালা সংগ্রহ করেন মহাজন। এরপর ঢাকার শাহবাগ কিংবা কোনো ফুলের দোকানে মুগ্ধতা ছড়ায় তাদের গাঁথা মালাগুলো। এরপর হয়তো শোভা পায় কোনো নারী বা তরুণীর খোঁপায়।
যুথি খাতুন বলেন, মালা গাঁথার জন্য তাদের ফুল ও সুতা দেন মহাজন। শুধু সুই কিনতে হয়। তিনি মহাজনের এজেন্ট হিসেবে মাসে ৬০০ টাকা বেতন পান। আর প্রতিদিন যতগুলো মালা গাঁথেন, সে অনুযায়ীও টাকা পান। যুথি খাতুনের ভাষ্য, গরমের সময় বাগানে ফুল বেশি আসে, তখন তিনি ১০০টি পর্যন্ত মালা গাঁথতে পারেন। শীত আসছে, ধীরে ধীরে ফুলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তাই এ সময় মালাও কম গাঁথা হয়।
অহনা ফুল কুটিরের স্বত্বাধিকারী আলাউদ্দিন জানান, মাঝারি সাইজের একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি তৈরি করতে ২৫০-৩০০ টাকা খরচ হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা এ শ্রদ্ধাঞ্জলি বিক্রি করেন ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায়। অন্য সময় এর দাম থাকে ৭০০-৮০০ টাকা। এছাড়া এদিন ছোট আকারের শ্রদ্ধাঞ্জলিও তৈরি করা হয়, যা বিক্রি হয় ৪০০-৫০০ টাকায়। শাহবাগে এক পিস গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। এছাড়া রজনীগন্ধার স্টিক পাঁচ-ছয় টাকা, গাঁদাফুলের মালা ২০-২৫, অর্কিড ৫০-৭০, লিলি ২৫০-৩০০, জারবেলা ১৫-২০, কেলোনজরা ১০ থেকে ১৫ টাকা; ফুলের তোড়া ১০০-২০০ এবং মাথার রিং ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শাহবাগের ফুলশ্রমিকদের প্রধান কাজ হলো ফুল কেনাবেচা করা এবং তোড়া তৈরি করা।
কাজী নজরুল ইসলাম গানে গানে বলে গেছেন, ‘ফুল চাই-চাই, ফুল-টগর চম্পা চামেলি/ফিরি ফুলওয়ালী নিয়ে ফুল ডালি/মল্লিকা মালতী জুঁই বেলি।’ গাজরা, টগর, কাঠ বেলি যে নামেই ডাকি না কেন, মালার কারিগরদের কাছে এর নাম শুধুই ফুল।