হোম > মতামত

সৌদি-পাকিস্তান সামরিক চুক্তি ভূরাজনীতির এক সম্ভাব্য নয়া সমীকরণ

মন্তব্য প্রতিবেদন

মাহমুদুর রহমান

গত সপ্তাহে পাকিস্তান ও সৌদি আরব ‘Strategic Mutual Defence Agreement’ (যৌথ কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি) নামে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যার মূল বিষয়গুলো হলো-

১. চুক্তি স্বাক্ষরকারী দুই দেশের মধ্যে যেকোনো একটি আক্রান্ত হলে সে ক্ষেত্রে উভয় দেশ আক্রান্ত বলে ধরে নেওয়া হবে।

২. দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা হবে।

৩. বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে যৌথ সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমন সময় এই চুক্তিটি সম্পাদিত হলো যখন বিবেকহীন মার্কিন সমর্থনে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে জায়নিস্ট ইসরাইল সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে গণহত্যা এবং নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত আরব শাসকরা তাদের রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসন টিকিয়ে রাখতে এবং রাষ্ট্রের কথিত নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে এসেছেন।

যে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি ফিলিস্তিনের আদি আরব বাসিন্দাদের নিজেদের দেশ থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল নামক একটি চরম বর্ণবাদী, ধর্মীয় চরমপন্থি ও বর্বর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে, তাদের কাছেই আরব শাসকদের নিরাপত্তার জন্য ধরনা দেওয়া এক অতি বিস্ময়কর, নির্বোধ ও আত্মগ্লানিকর ব্যাপার ছিল। আরব ও ইরান এবং আরব ও তুরস্কের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকে সুচতুরভাবে কাজে লাগিয়ে বিগত দুই শতকেরও অধিককাল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মুসলিম বিশ্বকে বিভাজিত রাখতে সক্ষম হয়েছে।

আরব শাসকদের অনবরত বোঝানো হয়েছে, তাদের শত্রু ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল নয় বরং শিয়া ইরান এবং সুন্নি তুরস্ক। মুসলিম বিশ্বে বিভক্তির সুযোগ নিয়ে একদিকে নিরাপত্তার ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব দেশগুলোর বুকের ওপর সামরিক ঘাঁটি বসিয়ে তাদের সার্বভৌমত্ব করায়ত্ত করেছে, অন্যদিকে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আরব দেশগুলো অস্ত্র কিনেছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো চালানোর জন্য উপযুক্ত, দক্ষ, সাহসী এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তৈরি করেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রের নামে কতগুলো অকার্যকর খেলনা গছিয়ে দিয়ে বিনিময়ে আরবদের কাছ থেকে নেওয়া পেট্রোডলার দিয়েই ইসরাইলকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল একাধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ আরবদের অর্থসম্পদ দিয়েই ইসরাইলি বাহিনী আরবদের হত্যা করেছে অথচ আরব দেশের সব শেখ, আমির ও বাদশাহরা ঘুমিয়ে থেকেছেন।

অতিসম্প্রতি কাতারের রাজধানীতে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মনে হচ্ছে আরব শেখদের কালঘুম অবশেষে ভেঙেছে। দোহার যে বেসামরিক এলাকায় ইসরাইল একের পর এক মিসাইল হামলা করেছে, তার কয়েক মাইল দূরেই মধ্যপ্রাচ্যে সর্ববৃহৎ মার্কিন ঘাঁটি অবস্থিত। সেখানে অত্যাধুনিক সব রাডার সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুর বাহিনী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘অনুমোদনক্রমে’ সর্বাধুনিক মার্কিন বিমান বহর নিয়ে আরেক আরব দেশ জর্ডানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে উড়ে গিয়ে ওয়াশিংটনের সরবরাহ করা মিসাইল নিক্ষেপ করেই ফিলিস্তিনি ও কাতারি আরবদের হত্যা করেছে। অথচ কাতারকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই নাকি দেশটির অপরিণামদর্শী শাসক পরিবার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে দিয়েছিল।

এখন হয়তো সব আরব শাসক বুঝতে পারছেন যে, ইসরাইল ছাড়া আর কোনো দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের কানাকড়ি দাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট, কোনো রাজনীতিবিদ এবং ডিপ স্টেটের কাছে নেই। সুতরাং, মুসলিম দেশগুলোর কথিত নিরাপত্তার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য যেকোনো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশের ওপর নির্ভর করা অনেকটা আমাদের দেশের প্রবাদবাক্য ‘শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া’র মতোই ব্যাপার।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার এই প্রেক্ষিতে সৌদি-পাকিস্তান সামরিক চুক্তি মুসলিম বিশ্বকে এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এটিকে পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক জোট ন্যাটোর আদলে ভবিষ্যৎ ‘মুসলিম ন্যাটো’র প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেও দেখছেন। আমার অতীতের একাধিক লেখায় মন্তব্য করেছি যে, বিপুল সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ সৌদি আরব, মিসর, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যদি কখনো শিয়া ইরানের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়, তাহলেই শুধু মুসলমানদের ওপর জুলুমের অবসান সম্ভব। এই মুহূর্তে শিয়া ও সুন্নির হাজার বছরের দ্বন্দ্ব না মিটলেও, অন্তত উপরে উল্লিখিত পাঁচ শক্তিশালী সুন্নি দেশের মধ্যে সামরিক চুক্তি করা সম্ভব হলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের একাধিপত্যের অবসান ঘটবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

এবার দক্ষিণ এশিয়ায় সৌদি-পাকিস্তান চুক্তির প্রভাব নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। এই চুক্তির ফলে এই অঞ্চলে ভারত সবচেয়ে অধিকমাত্রায় বিচলিত বোধ করছে। দেশটিতে মোদির অন্ধ সমর্থক ‘গোদি’ মিডিয়ায় চুক্তি নিয়ে রীতিমতো হাহাকার চলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালালেও বিগত প্রায় এক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয় প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে সৌদি আরব, আমিরাতসহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশে একাধিকবার সফর করেছেন, গলাগলি করেছেন এবং পুরস্কার নিয়েছেন। চরম মুসলমানবিদ্বেষী, গুজরাটের কসাই মোদি সুযোগ পেলেই সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান এবং আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদকে ভাই সম্বোধন করে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জড়িয়ে ধরেছেন।

প্রকৃতপক্ষে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে সেই ৯/১১ থেকেই অনবরত কাজ করে গেছে। প্রেসিডেন্ট বুশ (২০০০-২০০৮), প্রেসিডেন্ট ওবামা (২০০৮-২০১৬) এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম দফার শাসনামলে (২০১৬-২০২০) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময়ের সোভিয়েত ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ ভারতকেই দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত মিত্র হিসেবে কাছে টেনে নিলে সেই সুযোগে দক্ষিণ এশিয়ায় দিল্লি তার ‘হেজেমনিক’ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছে। সেই সময়কালে বাংলাদেশকেও তার প্রবল প্রতিবেশীর কাছে সার্বভৌমত্ব হারাতে হয়েছিল।

ভারতের সৌভাগ্যসূর্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমল থেকেই অস্তমিত হতে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অতি চালাকি ভূরাজনীতিতে তাকে একটি অবিশ্বস্ত ও চরম সুবিধাবাদী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই বছর মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে চার দিনব্যাপী যুদ্ধকালে পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতই যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একঘরে হয়ে পড়েছে, সেটা বেশ পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে। যুদ্ধের সময় তুরস্ক এবং চীন পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে সহায়তা করলেও পৃথিবীর কোনো দেশ ভারতকে সমর্থন করেনি।

এমনকি ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধু রাশিয়া সন্ত্রাসবাদের সমালোচনা করে বিবৃতি দিলেও সরাসরি অথবা ইঙ্গিতেও পাকিস্তানকে দায়ী করেনি। বরং উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হওয়ার পর হতাশ মোদি ভারতের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সরকারি এবং বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন দেশে ওকালতি করার জন্য পাঠালে তাতেও কোনো ফায়দা হয়নি। যেসব দেশে ভারতীয় নেতারা গেছেন, সেসব দেশের সরকার ও বিরোধী দলের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের সঙ্গে দেখা করেননি। আন্তর্জাতিক মিডিয়াও ভারতীয় দলের সফরকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বভাব সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি নাকি কোনো পরাজিতকে পছন্দ করেন না। ভারত ও পাকিস্তানের চার দিনের মারামারির প্রথম দিনেই ভারত তার আধুনিক বিমান বহর নিয়েও পরাজিত হলে দেশটির সামরিক শক্তি সম্পর্কে যে ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল, সেটা ভেঙে পড়ে।

মার্কিন নীতিনির্ধারকরা বুঝে ফেলেন, যে দেশটিকে তারা এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী শক্তি বলে মনে করছিলেন, সেই দেশটির সব বিবেচনায় অনেক ক্ষুদ্র পাকিস্তানকে হারানোর মতো শক্তিও নেই। ওয়াশিংটন দৃশ্যত খুব দ্রুত তাদের দক্ষিণ এশীয় কৌশলগত নীতিতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তারা একদিকে ভারতের ওপর শুল্কের বোঝা চাপিয়েছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজ খাইয়ে মোদির কাটা ঘায়ে লবণ ঘষে দিয়েছেন। আসলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা নিয়ে ভারতের ধোঁকাবাজি আজ পুরো পৃথিবীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।

ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ-পরবর্তী চার মাসের মধ্যে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে প্রায় ছয় দশকব্যাপী ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্কের কোনো ধরনের হেরফের না করে ওয়াশিংটনের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছে। পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশটি সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে তার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় শেখ হাসিনার পনেরো বছরব্যাপী শাসনামলে অলিখিত ভারতীয় উপনিবেশ বাংলাদেশের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক ফ্যাসিবাদ পতনের প্রেক্ষিতে ক্রমান্বয়ে উষ্ণ হচ্ছে। প্রশংসনীয় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তান মোদির কথিত বিশ্বগুরুর ফাঁপানো বেলুনকে মাত্র কয়েক মাসে ফুটো করতে সক্ষম হয়েছে। সাম্প্রতিক জেন-জি অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ভারতের আরেক প্রতিবেশী নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত হলেও সে দেশেও প্রবল ভারতবিরোধী জনমত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

উপরোক্ত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের অনেকটা আকস্মিক সামরিক চুক্তি ভারতকে একেবারে নিরুপায় করে ফেলেছে। দেশটির ২৬ লাখ নাগরিক এক সৌদি আরবেই কাজ করে। ভারত বছরে যে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার প্রবাস থেকে আয় করে, তার চল্লিশ শতাংশ ছয়টি জিসিসি (Gulf Countries)-ভুক্ত মুসলিম দেশ থেকে আসে। মার্কিন চাপে রাশিয়া ও ইরান থেকে ভারতের জ্বালানি তেল কেনা বন্ধ হয়ে গেলে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছ থেকে তেল না পেলে উদ্ধত দেশটির সব চাকাও সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে ভারত ও রাশিয়ার অর্থনীতিকে একসঙ্গে গোল্লায় দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

কাজেই সৌদি-পাকিস্তান চুক্তি নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য করার ক্ষমতা ভারতের নেই। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শুধু এটুকু বলতে পেরেছেন যে, তারা বিদ্যমান পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছেন। কিছুদিন আগেও বিশ্বগুরুর স্বপ্ন দেখা মোদির জন্য সারা বিশ্বের দরজা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আমরা ২০২৪ সালে দেখেছি অহংকার কীভাবে পতন ডেকে আনে। অহংকারী শাসকদের বিনাশ করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা নিজে সময় নির্ধারণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির অহংকার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তিনি নিজেকে ‘স্বয়ম্ভু মহামানব’ রূপে কল্পনা করেন।

গত বছর ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনের আগে এক সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে ‘Non-biological’ দাবি করে বলেছিলেন, ‘I am convinced I am not biologically born’ (আমি নিশ্চিত যে আমার জন্ম জীববিজ্ঞানের নিয়মে হয়নি)। মোদির অন্ধভক্তরাও তাকে ‘নররূপে দেবতা’ বলেই মনে করে থাকেন। দিল্লির সেই মহাশক্তিধর কথিত দেবতা আন্তর্জাতিকভাবে এতটাই একঘরে হয়ে পড়েছেন যে, এ মাসের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

অথচ ফি বছর এই অনুষ্ঠানে মোদি সাড়ম্বরে অংশগ্রহণ করতেন। সেসব অনুষ্ঠানে তার গলাগলি থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিশ্বের অন্যান্য নেতাকে বেশ দূরত্ব অবলম্বন করতে হতো। এবার তারা নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছেন। ১৯৪৭ সাল থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ভারতের আপাতত বিশ্ব ভূরাজনীতিতে দর্শক হয়েই থাকতে হবে বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশের যেসব রাজনৈতিক দল ভারতের ক্ষমতা নিয়ে এখনো জুজুর ভয়ে ভুগছেন, তাদের ভূরাজনীতি নিয়ে খানিকটা লেখাপড়া করা দরকার।

তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে মুসলিম বিশ্ব আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৭৩ সালে ইসরাইল-মিসর যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বাদশাহ ফয়সলের সাহসী এবং কুশলী নেতৃত্বে জ্বালানি অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্ব ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাদশাহ ফয়সলের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড, ইরান-ইরাক যুদ্ধ এবং একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের গোঁয়ার্তুমির মিলিত ফলাফল বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মুসলমানকে হতোদ্যম ও পরনির্ভর করে ফেলেছে।

পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের মৈত্রী কতখানি ফলপ্রসূ হবে, সেটি আমাদের অজানা। এর আগেও দুই বা ততোধিক মুসলমান রাষ্ট্রের মধ্যে এ ধরনের চুক্তি সম্পাদিত হলেও সেগুলো কার্যকর কিংবা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আমরা আশা করতে চাই যে, অতীতের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি সৌদি-পাকিস্তান চুক্তির ক্ষেত্রে হবে না। বিশ্ব শান্তির জন্য শক্তির ভারসাম্য যে কতখানি আবশ্যক, সেটা আমরা গাজায় প্রতিদিনের ইসরাইলি গণহত্যা প্রতিরোধে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ভয়াবহ ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি।

এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কাছে বিশ্বমানবতা অসহায় হয়ে পড়েছে। এমন এককেন্দ্রিক (Unipolar) বিশ্বব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান শতাব্দীতে চীন এবং কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উত্থানে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বহুকেন্দ্রিক (Multipolar) বিশ্বব্যবস্থা আবার বিকশিত হচ্ছে। নতুন সেই বিশ্বব্যবস্থায় ২০০ কোটি মুসলমান যেন আগের মতো আর প্রান্তিক ও মূল্যহীন অবস্থায় না থাকে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য সৌদি-পাকিস্তান চুক্তির সাফল্য এবং সম্প্রসারণ অপরিহার্য। মুসলমানের আত্মোপলব্ধি এবং জাগরণের জন্য প্রার্থনা করে আজকের লেখা শেষ করলাম।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা

মনের তালা এবং শরবতের মতো ভালোবাসা

মোদি-নেতানিয়াহুর মুসলিমবিদ্বেষী দোস্তি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি

শান্তির মুখোশে গাজায় টনি ব্লেয়ারের প্রত্যাবর্তন

মেধা পাচার রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিচ্ছে

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কে বেশি অসহায়

মুসলিম বিদ্বেষ ও ভারতের বিনোদন সংস্কৃতি

দুর্ঘটনা না নাশকতা

নেতৃত্ব নির্বাচনে সচেতনতার ঘাটতি

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল কী বার্তা দেয়