অতি অল্প সময়ের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজ ও শাসনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। এর বড় একটি কারণ হলো এটি বিদ্যুতের মতোই বহুমুখী প্রযুক্তি, যার প্রয়োগের কোনো ধরাবাঁধা ক্ষেত্র বা সীমা নেই। ২০২৪ সালে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের নোবেল পুরস্কার দুটোই এআইনির্ভর গবেষণার ওপর দেওয়া হয়। এটি যেমন এআইয়ের বহুমাত্রিকতার স্বীকৃতি, তেমনি এআই যে দ্রুতগতিতে মানবসভ্যতার পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে, তারও ইঙ্গিত।
নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের পাশাপাশি এআই নিয়ে আসছে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা। এআই-পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে, এই প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রধান উদ্বেগগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কা, বৈষম্য বৃদ্ধি, যুদ্ধক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ও অ্যালগরিদমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নৈতিক সংকট। একই সঙ্গে যেমন (আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারস অনুযায়ী) ২০৩০ সালের মধ্যে এআই বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ১৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করতে পারে, তেমনি (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের হিসাব অনুযায়ী) প্রায় ৩০ কোটি মানুষ অটোমেশনের কারণে এ সময়ের মধ্যে কর্মচ্যুত হয়ে যেতে পারেন।
তবু এই চ্যালেঞ্জগুলোই বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এআই অঙ্গনে বিশ্ববাজারে কৌশলগত অবস্থান গড়ে তোলার নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। এর মূল কারণ দেশের তরুণ মানবসম্পদ এবং জ্ঞানসৃষ্টির ক্রমবর্ধমান সক্ষমতা। বাংলাদেশ এখন এমন এক অবস্থানে রয়েছে, যেখানে এআইকে প্রবৃদ্ধি, উদ্ভাবন এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো সম্ভব।
মানব উন্নয়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : দক্ষ মানবসম্পদ একটি শক্তিশালী সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে, মানব উন্নয়নে এআইয়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী সুফল আনার সম্ভাবনাময় দুটি খাত হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা।
শিক্ষা : ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় ৯৭ শতাংশ হলেও সমাপ্তির হার মাত্র ৮৬ শতাংশ এবং ১০ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে শুধু ৪৩ শতাংশ মৌলিক পাঠদক্ষতা অর্জন করতে পারে। শিক্ষার মান এখনো মূলত বড় শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত সম্পদ ও দুর্বল শিক্ষাদানের চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এআইচালিত প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যক্তিগত টিউটরিং, অভিযোজিত পাঠদান এবং উচ্চমানের ডিজিটাল শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহের মাধ্যমে শিক্ষাকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে পারে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও শহরের শিক্ষার্থীদের সমান মানের সুযোগ পেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমান খানের খান একাডেমির উদ্যোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে আসছেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে এআইভিত্তিক ব্যক্তিগত টিউটরিং ধারণাকে জোরালোভাবে প্রচার করছেন।
অন্যদিকে, আমাদের মতো দেশে যেখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ এখনো সীমিত, সেখানে এআই শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমিক প্রশিক্ষণ, বিষয়বস্তুর জ্ঞান বৃদ্ধি এবং পাঠ পরিকল্পনায় সহায়তা দিতে পারে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি বিশ্লেষণ, দুর্বল দিক চিহ্নিতকরণ ও ব্যক্তিগত সহায়ক উপকরণ তৈরিতেও শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকদের সহায়তা করতে সক্ষম। উচ্চশিক্ষায় এআই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করতে পারে এবং প্রশ্ন-উত্তর ও গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে যুক্তিনির্ভর ও উদ্ভাবনী চিন্তার চর্চাকে জোরালো করতে পারে। এর মাধ্যমে দেশেই এমন এক তরুণ কর্মশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব যারা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার উপযুক্ত এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণে সক্ষম।
স্বাস্থ্যসেবা : বাংলাদেশে বেশির ভাগ ডাক্তার শহরে থাকেন, ফলে গ্রামীণ জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন। এ অবস্থায় এআইচালিত টেলিমেডিসিন, ডায়াগনস্টিক অ্যালগরিদম এবং রোগ শনাক্তকরণের ডিজিটাল টুলস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব প্রযুক্তি একদিকে যেমন গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞতার প্রসার ঘটাতে পারে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা বৃদ্ধি ও হালনাগাদ জ্ঞানের সুযোগ তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রুয়ান্ডায় একটি পাইলট প্রকল্পে এআই ব্যবহার করে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সিজারিয়ান অপারেশন-পরবর্তী ক্ষত পর্যবেক্ষণে সহায়তা করা হচ্ছে। একইভাবে, ভারতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্পে এআই ব্যবহার করে মায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ, দূরবর্তী চিকিৎসাসেবা এবং সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলা : বাংলাদেশ এমন এক জলবায়ু-ঝুঁকির মুখোমুখি, যা আগামী কয়েক দশক ধরে দেশের উন্নয়নের গতি ও দিক অনেকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করবে। সীমিত সম্পদের মধ্যে দেশটিকে একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অন্যদিকে জনবসতি স্থানচ্যুতি ও বসবাসযোগ্য ভূমি কমে যাওয়ার মতো বাস্তব সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে। ফ্রন্টিয়ার্স ইন ক্লাইমেটের (Frontiers in Climate) এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ২ দশমিক ২ কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। জলবায়ু-পূর্বাভাস আরো ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে চরম আর্দ্রতা মানবস্বাস্থ্য ও টেকসই জীবনের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এরূপ বাস্তবতায় সীমিত সম্পদের সঠিক ও দক্ষ ব্যবহার অপরিহার্য।
এখানেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অভিনব ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নত পূর্বাভাস, তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এআই জলবায়ু-ঝুঁকির মোকাবিলায় অভিযোজনযোগ্য এবং সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু-মডেলিং ও ডেটা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস নির্ভুল করা সম্ভব, যা প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে ও কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সহায়তা করবে। বর্তমানে ফিলিপাইনে এমন এক এআইভিত্তিক মডেল তৈরি করা হচ্ছে, যা কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়জনিত বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে পারে। নেদারল্যান্ডসেও বন্যা ও পানি-ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। একইভাবে, এআইনির্ভর টুলস অনিয়মিত বৃষ্টিপাতে কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালি খাতে পানিসম্পদের দক্ষ বণ্টনে সাহায্য করতে পারে। তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত ও সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে এআই বাংলাদেশের জলবায়ু-সহনশীলতা বাড়াতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জোরদার করতে পারে। প্রযুক্তির বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য জলবায়ু অভিযোজনের এক অনুকরণীয় উদাহরণে পরিণত করতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সম্পদ বণ্টন কিংবা সহনশীল নগর-পরিকল্পনার সঙ্গে এআইয়ের সঠিক সংযুক্তি ঘটিয়ে আমরা দেখাতে পারি কীভাবে উদ্ভাবন ও দূরদৃষ্টি দিয়ে সীমিত সম্পদের মধ্যেও বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব।
এআইয়ের ‘আছে’ ও ‘নেই’ পৃথিবী : এআইকে সচরাচর ‘বিঘ্নকারী প্রযুক্তি’ (disruptive technology) হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যা প্রচলিত ব্যবস্থাকে ওলটপালট করে দিয়ে দ্রুতগতিতে নতুন বাস্তবতা রচনা করছে। সব প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনই সমাজে পরিবর্তন আনে, তা ধীরে হোক বা দ্রুতগতিতে। কিন্তু এআই যেন কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয় আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান।’ স্বাভাবিকভাবেই ‘এআই আছে’ আর ‘এআই-নেই’-এর পৃথিবীর মধ্যকার ফারাক দ্রুত বাড়বে। ধনী দেশগুলো বিনিয়োগের মাধ্যমে আরো ধনী হবে আর স্বল্প আয়ের দেশগুলো তাদের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। কিন্তু আশার বিষয়, এআই এখনো তার গঠন ও প্রয়োগের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আর এই প্রারম্ভিক অবস্থাতেই পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য অর্থবহ অগ্রগতি অর্জন সম্ভব।
বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও এর মূল কারণ হলো, এআইয়ের ভিত হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি তথ্য, সৃজনশীলতা, নৈতিক চিন্তা এবং নীতিনির্ধারণের প্রজ্ঞার ওপর আরো গভীরভাবে নির্ভরশীল। এই বৈশিষ্ট্যই একে সত্যিকার অর্থে একটি বৈশ্বিক প্রযুক্তিতে পরিণত করেছে, যার সম্ভাবনা প্রতিটি দেশের জন্যই উন্মুক্ত। সীমিত সম্পদের দেশগুলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও তা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে এই যাত্রায় অংশীদার হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগ আরো বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী তরুণ যারা এআইনির্ভর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়ার উপযুক্ত সময়ে রয়েছে। শুধু এআই ব্যবহারকারী নয়, বরং এআই উদ্ভাবন ও সরবরাহকারী দেশ হিসেবেও আমরা আত্মপ্রকাশ করতে পারি। এআইয়ের বিধ্বংসী রূপই আমাদের ‘নিশাবসান’-এর সম্ভাবনা এনে দিয়েছে।
কৌশলগত মানবসম্পদ উন্নয়ন কীভাবে বিশ্ব উদ্ভাবনের ধারাকে নতুন পথে চালিত করতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ভারত। শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী বৃহৎ কর্মশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভারত দক্ষ পেশাজীবীদের একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে, যারা বর্তমানে বিশ্ব প্রযুক্তি খাতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির উত্থানে অন্যতম চালিকাশক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বেও এখন বহু ভারতীয় রয়েছেন।
একইভাবে, গত চার দশকে চীনের রূপান্তরও দৃষ্টান্তমূলক। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) শিক্ষায় ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন এক শক্তিশালী জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলেছে এবং স্বল্পমূল্যের শ্রমনির্ভর উৎপাদন থেকে উচ্চমূল্য সংযোজনকারী, প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে রূপান্তর ঘটিয়েছে। আজ চীন বিশ্ব উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশে অবদান রাখে এবং বৈদ্যুতিক যান, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও সৌরশক্তিসহ ভবিষ্যতের মূল প্রযুক্তিগুলোয় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। আর এআইয়ের কথাই বাদ দিই কেন? কিছুদিন আগ পর্যন্ত অনুসারীদের কাতারে থাকা চীন অল্প সময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে দৌড়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্যও সঠিক শিক্ষানীতি, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নের একাধিক ধাপ অতিক্রম করে উদ্ভাবনের অগ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ সম্ভব। বর্তমানে ওপেন সোর্স এআই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও নতুন উদ্যোগগুলো (স্টার্টআপ) স্বল্প ব্যয়ে উন্নত এআই টুলস ব্যবহার করতে পারছে, যা আগে শুধু ধনী দেশগুলোর নাগালে ছিল। এর ফলে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো স্থানীয় খাতেও নিজেদের বাস্তবতা এবং চাহিদা অনুযায়ী উদ্ভাবন ঘটানো সম্ভব হচ্ছে।
এই পথ অনুসরণ করতে পারলে বাংলাদেশ তার তরুণ মানবসম্পদ ও ক্রমবর্ধমান জ্ঞানসম্পদকে (knowledge capital) কাজে লাগিয়ে এআইকে দেশের উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করতে পারবে, যাতে প্রযুক্তির সুফল সমাজের সবস্তরে পৌঁছে যায় এবং শুধু ব্যবহারকারী নয়; বরং উদ্ভাবক হিসেবেও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যায়।
কৌশলগত অগ্রাধিকার : কার্যকর এআইনীতিমালা গড়ে তুলতে হলে বাংলাদেশকে কয়েকটি কৌশলগত খাতে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রথমত, এআই অবকাঠামো (AI infrastructure), বিশেষত ডেটা-সেন্টার নির্মাণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দক্ষতা, টেকসই ব্যবহার এবং পরিবেশের ওপর ন্যূনতম প্রভাব নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, এআই শিক্ষাকে (AI education) প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা পর্যন্ত একীভূতভাবে (vertically integrated) গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উন্নত গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন, যা শুধু এআই-এ সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংলগ্ন ক্ষেত্রগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করবে, কারণ উদ্ভাবন প্রায়ই আন্তঃবিষয়ক জ্ঞান-হস্তান্তরের মাধ্যমেই এগিয়ে যায়।
তৃতীয়ত, নাগরিকবান্ধব এআই টুলস তৈরি ও সম্প্রসারণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যাতে একটি এআইসচেতন সমাজ গড়ে ওঠে। ই-গভর্নেন্স পোর্টাল, আর্থিক অ্যাপ্লিকেশন ও দুর্যোগের আগাম সতর্কতা ব্যবস্থায় এআই সংযুক্ত করলে নাগরিকরা এআইকে এক দূরবর্তী প্রযুক্তি নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের সহায়ক শক্তি হিসেবে অনুভব করবে। একই সঙ্গে, এআইয়ের সুফল ও ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নাগরিকদের ডিজিটাল সক্ষমতা ও দায়িত্ববোধ বাড়ানো সম্ভব হবে।
চতুর্থত, দেশীয় ভাষাভিত্তিক এআই উন্নয়নে বিনিয়োগ করা জরুরি। বিশেষ করে বাংলা ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার জন্য প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ (NLP-Natural Language Processing) প্রযুক্তির বিকাশ এআইয়ের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহজলভ্য ব্যবহারের পথ প্রশস্ত করবে।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল খাতগুলোয় এআইয়ের প্রয়োগকে গুরুত্ব দিতে হবে। তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, ডিজাইন উন্নয়ন ও গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে এআই ব্যবহার করলে আমাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। অভিবাসন খাতে দক্ষতা মেলানো, আইনি সহায়তা ও প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগে এআইচালিত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা গেলে কর্মীদের সুরক্ষা এবং কল্যাণ নিশ্চিতকরণ সহজ হবে। এছাড়া, সিঙ্গাপুর ও রটারডামের মতো বন্দরগুলোয় যেভাবে এআইনির্ভর পণ্য পরিবহন এবং লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা সফলভাবে চালানো হচ্ছে, সেখান থেকে চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নের জন্যও কার্যকর দিকনির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে।
ষষ্ঠত, কর্মসংস্থান পুনর্গঠন (retooling) ও পুনঃদক্ষীকরণ (reskilling) অপরিহার্য, যাতে এআই উদ্ভূত স্বয়ংক্রিয়তার ফলে কর্মহীন হওয়া মানুষ এআইচালিত নতুন অর্থনীতির উপযোগী কাজে পুনর্নিয়োজিত হতে পারেন।
বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এই উদ্যোগগুলো শুরু করা যেতে পারে আঞ্চলিক পাইলট প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি), লক্ষ্যভিত্তিক সরকারি প্রণোদনা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতার মাধ্যমে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের সমন্বয়ে বাংলাদেশ এক নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করতে পারে, সীমিত সম্পদ রক্ষা করতে পারে এবং আজকের চ্যালেঞ্জকে আগামী দিনের সুযোগে রূপান্তর করতে পারে।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেকসই অগ্রগতির ধারা বজায় রাখা সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ বছরের নোবেল পুরস্কারটি তাই বিশেষভাবে অর্থবহ এবং বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা চাই, আমাদের শক্তিশালী তরুণ প্রজন্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনাগত যুগের মুখ্য রূপকার হয়ে উঠুক এবং এর ভবিষ্যৎ নির্মাণে নেতৃত্ব দিক। আর তা সম্ভব।
লেখক পরিচিতি
ড. সাজ্জাদ নাসির যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টিএইচআইএর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভাগের পরিচালক।
ড. মো. মঈনুল আকবর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট ডালাসের গণিতবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।