হোম > মতামত

গাজায় তবু শান্তি নেমে আসুক

সৈয়দ আবদাল আহমদ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গাজা শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণার পর বিশ্বে কিছুটা হলেও স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। বিভীষিকার কালো মেঘ ভেদ করে এক ফালি আলোর রেখা যেন উদ্ভাসিত হচ্ছে। অভিশপ্ত ইহুদিদের বিশ্বাস করা কঠিন। তবু যেন মনে হচ্ছে আপাতত যুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে। হয়তো সারি সারি লাশ আর আমাদের দেখতে হবে না। দেখতে হবে না আহত শিশুর কান্না, মায়েদের আহাজারি। হয়তো শান্তি আসতেও পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সোমবার হোয়াইট হাউসে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী গণহত্যাকারী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে গাজা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ট্রাম্পের এই ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, গাজায় সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করা হবে, হামাসের হাতে আটক ২০ জন জীবিত ইসরাইলি জিম্মি এবং দুই ডজনেরও বেশি মৃতদেহের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি, শত শত আটক ফিলিস্তিনিকে এবং গাজার অন্য বাসিন্দাদের দেহাবশেষ মুক্ত করবে ইসরাইল। হামাস তাদের অস্ত্র সমর্পণ করবে এবং গাজা শাসনে তাদের ভূমিকা থাকবে না। পক্ষগুলো এসব প্রস্তাবে সম্মত হলে ‘পূর্ণ সহায়তা’ অবিলম্বে গাজা উপত্যকায় পাঠানো হবে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং অন্য নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি আন্তর্জাতিক ‘বোর্ড অব পিস’ বা শান্তি বোর্ড’ গঠন করা হবে এবং এর তত্ত্বাবধানে একটি টেকনোক্র্যাটিক অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটির মাধ্যমে গাজা উপত্যকার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা হবে। পরিকল্পনাটি ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য দরজা উন্মুক্ত করবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শান্তি পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময়সীমা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই হামাস ও ইসরাইল তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।

হামাস ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনা মেনে ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। তবে অন্যান্য বিষয়ে তারা আলোচনা করতে চায়। হামাসের এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ট্রাম্প ইসরাইলকে গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করতে বলেছেন। ইসরাইল এরপরও অন্তত তিনটি জায়গায় হামলা করেছে। যদিও ইসরাইল সরকার তাদের সেনাবাহিনীকে গাজায় হামলা বন্ধ করতে বলেছে।

হামাস বলেছে, তারা গাজায় জিম্মি অবস্থায় থাকা সব ইসরাইলিকে মুক্তি দেবে। জিম্মিদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের মৃতদেহও হস্তান্তর করা হবে। এর বিনিময়ে তারা চায়, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনারা সরে যাক। হামাস আরো বলেছে, তারা একটি স্বাধীন ও অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (টেকনোক্র্যাট) কাছে গাজার শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। হামাসের এই প্রতিক্রিয়াকে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাগত জানিয়েছেন। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, তিনি মনে করেন ফিলিস্তিনি সংগঠনটি ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য প্রস্তুত’। ট্রাম্প পরে একটি ভিডিও বার্তাও দেন। এতে তিনি হামাসের জবাবকে একটি বিজয় হিসেবে দেখছেন বলে উল্লেখ করেন। বিশ্বনেতারাও এই পরিস্থিতিকে ‘গাজায় যুদ্ধবিরতি হাতের নাগালে’ বলে বর্ণনা করেছেন।

তবে ইসরাইলকে চাপে রাখতে না পারলে গাজায় যুদ্ধবিরতি কতটা সফল হবে সেটা দেখার বিষয়। কারণ ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র সঙ্গে ইসরাইলের আচরণ বিশ্ববাসী দেখেছে। গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ফ্লোটিলার ৪০টি নৌবহর। ইসরাইললি সেনারা সবগুলো নৌযান আটক এবং ত্রাণকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। এই বহরে ছিলেন সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। ইসরাইলিরা তাকে শুধু আটকই করেনি, তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনও করেছে। বাংলাদেশের আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলম পরের নৌবহরে গাজায় পৌঁছার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের জন্য এটা গর্বের। কিন্তু ইসরাইল কী করে এটাও দেখার বিষয়।

ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রায় দুই বছর ধরে ইসরাইলের এই যুদ্ধ চলমান। ইসরাইলি হামলায় ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের সমগ্র উপত্যকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর রয়টার্স ও আলজাজিরার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৬৫ হাজার ৩৪৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই ২০ হাজার। আহত হওয়ার সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৯৫ জন। নিহত ১ হাজার ৯ জনের বয়স এক বছরের কম। জন্ম নেওয়ার পরই নিহত হয়েছে ৪৫০ শিশু। অগণিত শিশু মারা গেছে ক্ষুধায়। এখন পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ১৯৫টি ভবন ও অবকাঠামো। এর মধ্যে হাসপাতাল ২১৩টি এবং স্কুল ১০২৯টি। গাজার ৭৫ শতাংশ এলাকা ইসরাইলি সামরিক নিয়ন্ত্রণে। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শিশুর অঙ্গহানি হয়েছে গাজায়। ইসরাইলি নৃশংসতার বড় শিকার হয়েছে শিশুরা। কোনো শিশু পা হারিয়েছে, কেউ হাত। কেউ হাত-পা দুটোই। জাতিসংঘ বলেছে, বিশ্বে এখন গাজায় শিশুপ্রতি সবচেয়ে বেশি অঙ্গহানি ঘটেছে। এ সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। ইসরাইলের বোমা হামলায় সবচেয়ে বেশি শিশু আহত হচ্ছে। বোমা হামলার পর ছিটকে আসা ধারালো বস্তু বা স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে শিশুরা। ট্রাম্প বোমা হামলা বন্ধ করতে বলেছেন। মুরব্বির আদেশ মেনে বর্বর ইসরাইল এবার হয়তো বোমা হামলা থামাবে, যা আপাতত স্বস্তি বয়ে আনবে। শিশুদের, নারীদের করুণ মৃত্যু আর আমরা দেখতে চাই না।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলা শুরু হয়েছিল। ইসরাইল ওইদিন ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছিল। সেদিন থেকেই ইসরাইলের যুদ্ধ শুরু। ইসরাইলের হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলি রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিরোধের সূত্রপাত। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই ঘোষণায় সই করেছিলেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর। ঘোষণায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি আবাস বা বসতি গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় দলে দলে ইহুদি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এসে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জড়ো হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের পরামর্শে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরিকল্পনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা থাকলেও তাকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আলোর মুখ দেখেনি। বরং ইসরাইল ক্রমেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত ভূখণ্ড দখলের দিকে এগিয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধও হয়। এই যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিমতীর দখল করে নেয়। ২০০৭ সালে ইসরাইল গাজার দখলদারি ছেড়ে দিলেও পশ্চিমতীরে অবৈধ বসতি স্থাপন ক্রমেই বাড়াতে থাকে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে ৫৫ শতাংশ ভূমি ইসরাইলের এবং ৪৫ শতাংশ আরবদের বলে একটি প্রস্তাব পাস হয়। কিন্তু এই ফয়সালাও মানা হয়নি। বরং ইসরাইল ফিলিস্তিনে তার আগ্রাসন চালাতেই থাকে। পুরো ভূখণ্ডের মালিকানা আরবদের। ইসরাইলকে এখানে জায়গা করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ইসরাইল সমুদয় ফিলিস্তিনি জায়গা গ্রাস করতেই মরিয়া হয়ে ওঠে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইল নতুন করে পশ্চিমতীরের প্রায় ১৫ হাজার একর ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করেছে বলে আলজাজিরার তথ্যসূত্রে জানা গেছে।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন একটি ন্যায়সংগত এবং মানবিক দাবি। কিন্তু বিশ্ব মোড়লদের চক্রান্তে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আজও গঠন হয়নি। ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশেই পরবাসী। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর থেকেই বিভিন্ন দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে নতুন করে স্বীকৃতি দেওয়া পশ্চিমা দেশের তালিকা বেড়েছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগালের পর ফ্রান্সও স্বীকৃতি দেওয়ার পথে হাঁটছে। ইসরাইলের মিত্রদের আরো কয়েকটি দেশও স্বীকৃতি দেবে বলে আলোচনা রয়েছে। বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৫১টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা পিএলওর মাধ্যমে অসলো চুক্তি সই হয়। এই চুক্তিতে একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পথ তৈরি হয়। পিএলও ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিলেও আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে মানছে না ইসরাইল। অসলো চুক্তির শান্তি প্রক্রিয়া মানা হলে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ কিংবা হামলা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, শুধু ইসরাইল নয়, ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্রদের অনাগ্রহের কারণে এই শান্তি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন, তা আপাতত যুদ্ধবিরতি পরিস্থিতি বলবৎ করবে বলে মনে হচ্ছে। তবে স্থায়ী শান্তি আদৌ আসবে কি না সময়ই বলে দেবে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগের অনেক প্রেসিডেন্টও এ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা শুরু হয়ে যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এ পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে যদি শান্তি আসে তাহলে তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হোক। বিশ্ব মানবতা গাজার মতো এমন অমানবিক যুদ্ধ আর দেখতে চায় না। এর অবসান হোক।

আমাদের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণেও ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এটাই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারে। তিনি ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে জানান।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ

abdal62@gmail.com

নদীর বুকে বিষের স্রোত

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব

যুক্তরাষ্ট্র কি গাজায় সংঘাতে জড়াবে?

আস্থাহীন উদ্যোক্তা স্থবির কর্মসংস্থান

ভারতের প্রেসক্রিপশনে গোয়েন্দা সংস্থার অবক্ষয়

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ন্যায়বিচারে যুগান্তকারী ঘটনা

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বাড়াতে যা প্রয়োজন

ইউক্যালিপটাস আকাশমণি ও সেগুনের কথা

আগামী সংসদ নির্বাচনে ভারত ফ্যাক্টর

নতুন নিরাপত্তা সমীকরণে ভারত