হোম > মতামত

জেন-জির চাকরিবাজার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম

প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ এবং অবোধ্যের মতো তার ব্যবহার অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে চলমান পরিবর্তনগুলোর দৃশ্যমান প্রভাব সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনারও জন্ম দিয়েছে। বিশেষত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং তার বিভিন্ন ব্যবহার সমাজের প্রাথমিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনছে। বদলে দিচ্ছে শ্রমের ধরন ও সময়কাল। আর সামাজিক পরিসরে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব যে যে জায়গায় পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি বড় ক্ষেত্র হলো চাকরিবাজার। একদিকে এআই বিভিন্ন সৃজনশীল খাত ও কর্মক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে; ঠিক তার বিপরীতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চাকরি এবং কর্মক্ষমতার সুযোগ কমানোর ঝুঁকিও তৈরি করছে। যেই কাজ আগে দশজন মিলে করত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফল প্রয়োগে, সেই কাজ মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একজন মানুষ করতে পারছে। আর তার ফলাফল হিসেবে জেন-জির (Gen Z) কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গিয়েছে।

বিশ্বের নানা দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম, দ্রোহ আর বিপ্লব নিয়ে বিখ্যাত হয়েছে জেন-জি। তাদের অনেকেই এখন সদ্য স্নাতক শেষ করেছে, কেউ কেউ স্নাতকের ময়দানে সবে পা রেখেছে। তারা যখন শিক্ষাজীবন শেষ করবে তখন কর্মক্ষেত্রে তাদের অর্জন ও উপার্জনের পথ-পাথেয় কী হবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর, আর শঙ্কাও দেখা দিয়েছে দুস্তর। মানুষের কাজ ধীরে ধীরে যন্ত্রাংশের নিয়ন্ত্রণে হতে শুরু করলে সেই সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রচুর কষ্ট হয়েছিল। তারপর এলো কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তির যুগ। এর প্রভাব এতটাই হয়েছিল যে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছিল, পক্ষান্তরে কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল। সাম্প্রতিক এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব হতে পারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর জেন-জি কীভাবে এর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে কর্মক্ষেত্র তৈরি করবে, সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

বর্তমান যুগে প্রযুক্তির বিকাশ এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন দিক থেকে আসা পরিবর্তনগুলো আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে দৃশ্যমান। বিশেষত, এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আধুনিক চাকরিবাজারে এই প্রযুক্তি কীভাবে প্রবলভাবে প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। একদিকে এআই বিভিন্ন সেক্টরে উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, তবে অন্যদিকে এআই-এর কারণে চাকরি হারানোর ভয়ও বাড়ছে, বিশেষত জেন-জির (Gen Z) মতো প্রজন্মের কাছে, যারা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। এই প্রজন্মের চাকরির বাজারে এআই-এর প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ এটি একই সঙ্গে নতুন সুযোগ এবং নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।

জেন-জির বহুল ব্যবহৃত অরা (Aura) শব্দটিকে ব্যবহার করতে দেখেছিলাম প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ভাল্টার বিনিয়ামিনকে (Walter Benjamin)। তিনি তার ‘The Work of Art in the Age of Mechanical Reproduction’ শীর্ষক প্রবন্ধে সরাসরি লিখেছিলেন: ‘When art is mechanically reproduced (such as through photography or film), it loses this aura because the reproduction removes it from its original context and makes it more widely accessible. The loss of aura symbolizes the transformation of art from a ritualistic or sacred object to one that is consumed in a more superficial and mass-produced way.’ বিনিয়ামিন কোনো ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা জ্যোতিষী নন। তবে তিনি শিল্পকলাকে সামনে রেখে যে মন্তব্য করেছিলেন, সেখানে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুযোগ ও কিছু ভয়াবহতা।

বিনিয়ামিনের ওপরে বর্ণিত প্রবন্ধের ধারণাগুলো আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও প্রযুক্তির যুগে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ যখন শিল্পকর্ম যান্ত্রিকভাবে পুনরুৎপাদিত হয়, তখন তার অনন্যতা হারিয়ে যায়। ঠিক তেমনই, আজকের প্রযুক্তিগত যুগে, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি কাজের পুনরুৎপাদনও এই অনন্যতাকে সংকুচিত করতে পারে। যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সৃষ্ট শিল্প, কোড বা ডিজাইন দ্রুত এবং সস্তায় পুনরুৎপাদিত হতে পারে। এর ফলে এসব কাজের ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক মূল্য ক্ষুণ্ণ হয়। ওদিকে জেন-জির চাকরিবাজারে, যেখানে অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুততার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সেখানে কাজের পরিবেশও এক নতুন ধরনের প্রোপাগান্ডার শিকার হতে পারে।

সৃষ্টিশীল যে কাজগুলো আগে মানুষের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দ্বারা স্বীকৃত ছিল, সেগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এখন পুনরুৎপাদনযোগ্য এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে। ফলে সৃজনশীলতা, শিল্পকর্মের অনন্যতা এবং চাকরির মূল মূল্যবোধগুলো এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আর এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে জেন-জি তার কাঙ্ক্ষিত সফলতা থেকে ছিটকে পড়বে।

আমাদের অস্বীকারের সুযোগ নেই যে এআই প্রযুক্তি এমন এক ধরনের প্রযুক্তি, যা মানবজাতির জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনছে। এর মাধ্যমে এমন অনেক কাজ দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে করা সম্ভব হচ্ছে, যা একসময় মানুষকে অনেক সময় এবং শ্রম দিয়ে করতে হতো। উদাহরণস্বরূপ, গ্রাফিক ডিজাইন, ডেটা বিশ্লেষণ ও রিপোর্ট লেখার মতো কাজ এখন এআই-এর সাহায্যে অতি দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে। এই কাজগুলোর জন্য মানুষের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষত, জেন-জির জন্য এটি এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেহেতু তারা এমন এক সময়ে বেড়ে উঠছে যেখানে এআই দিন দিন বিভিন্ন শিল্প ও খাতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং মানুষের কাজের জায়গা দখল করছে।

জেন-জির জন্য এই চ্যালেঞ্জটি আরো প্রকট হয়ে উঠছে, কারণ তারা এমন একটি প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের পরিচিতি অর্জন করেছে। তারা জানে, কেবল প্রযুক্তির সাহায্যে নিজের দক্ষতা বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, বরং সেই দক্ষতাকে মানবিক সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও সমালোচনামূলক চিন্তার সঙ্গে মিশিয়ে কাজ করতে হবে। তবে এআই যখন মানুষের কাজের জায়গা দখল করবে, তখন তাদের জন্য চাকরির বাজারে নতুন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হবে। একদিকে এআই মানবজীবনকে অনেক সহজ ও কার্যকর করে তুলছে। অন্যদিকে এতে অনেক মানুষ তাদের চাকরি হারানোর আশঙ্কায় পড়ছেন, বিশেষত তারা যারা কম দক্ষতার কাজ করেন।

এআই প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির সঙ্গে সংগতি রেখে নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। এই সুযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ডেটা সায়েন্টিস্ট, এআই গবেষক, রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ার এবং আরো অনেক নতুন পেশা, যা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। তবে এই নতুন চাকরিগুলোর জন্য অত্যন্ত উচ্চমানের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সৃজনশীলতা প্রয়োজন। সুতরাং জেন-জির জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, কিন্তু তাদের এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হলে তাদের প্রযুক্তির দক্ষতার পাশাপাশি মানবিক গুণাবলি, যেমন সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনও বজায় রাখতে হবে।

এআই একটি চমৎকার প্রযুক্তি হতে পারে, যদি এটি মানবিক সৃজনশীলতার বিরুদ্ধে না যায়। আজকাল অনেক বড় কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করে খরচ কমাতে এবং কাজের গতি বাড়াতে চাইছে। তবে, যদি এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সমস্ত কাজ রোবটিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে থাকে, তাহলে মানুষের জন্য সৃজনশীল কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে। এআই-এর সাহায্যে যেসব কাজ ইতোমধ্যে সহজ হয়ে গেছে, যেমন গাণিতিক বিশ্লেষণ, রিপোর্ট তৈরি, প্রোগ্রামিং ও গ্রাফিক ডিজাইন—এসব ক্ষেত্রে মানুষের সৃজনশীলতার বিকাশের সুযোগ কমে যাবে। এর ফলে মানবিক গুণাবলি, যেমন সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ কমে যাবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে।

বিশেষ করে বার্টান্ড বদ্রি (Bertrand Badré) এবং ফ্লোরিয়ান ইনজেনহজ (Florian Ingen-Housz) তাদের ‘Will AI Bury Future Generations in Cognitive Debt?’ শীর্ষক নিবন্ধে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, সেগুলো নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। কারণ এআই-এর সঙ্গে সমন্বয় করেই জেন-জির সদস্যদের নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী না হলে তারা বিপদে পড়বে। অন্যদিকে তারা যদি প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতা একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারে, তবে তারা কর্মসংস্থানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হবে।

জেন-জির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে, তাদের মানবিক গুণাবলি যেন এআই প্রযুক্তির কাছে হারিয়ে না যায়। সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও সঠিক চিন্তা-বিশ্লেষণই তো একমাত্র সেই শক্তি, যা মানুষের কাজের মূল ভিত্তি। সুতরাং জেন-জির উচিত তাদের সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে একত্র করে একটি সুস্থ এবং উন্নত কর্মজীবন তৈরি করা।

এআই শুধু যে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুবিধা দেবে, তা নয়, এটি নতুন ধরনের সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রও খুলে দেবে। উদাহরণস্বরূপ, এআই ব্যবহারে চিত্রকলা, সংগীত, সাহিত্য ও ডিজাইন বিষয়ে নতুন নতুন ধারণা এবং উদ্ভাবন আসতে পারে। জেন-জির উচিত এই প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করা, তবে সেক্ষেত্রে তাদের সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতাকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবে তারা ভবিষ্যতে এমন একটি কর্মবাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে, যেখানে তারা প্রযুক্তি ও মানবিক গুণাবলি একত্র করে সাফল্য অর্জন করবে।

এই প্রযুক্তির যুগে যদি জেন-জির সদস্যরা মানবিক সৃজনশীলতার প্রতি তাদের ভালোবাসা ও মনোযোগ ধরে রাখতে পারে, তবে তারা আগামী দিনে একটি সৃজনশীল, প্রযুক্তিনির্ভর এবং উন্নত পৃথিবী গড়ে তুলবে। এআই-এর সাহায্যে তারা শুধু নিজেদের কর্মজীবনেই সফল হবে না, বরং তারা নতুন ধরনের সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে একটি উদ্ভাবনী পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করবে। তাই রাজপথের বিপ্লবে যারা স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট ও জনবিদ্বেষী শাসকদের উৎখাত করেছে, তাদের চাকরিবাজারও হতে পারে তেমনি বৈপ্লবিক। তবে এর জন্য শুরু থেকেই নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। আর এক্ষেত্রে প্রযুক্তি, মানবিক গুণাবলি আর সৃষ্টিশীলতার অভূতপূর্ব সমন্বয় হওয়াটা জরুরি। আর সেটা সম্ভব হলে জেন-জির চাকরিবাজারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আশীর্বাদ হয়েই দেখা দিতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

পাকিস্তানের অলৌকিক কূটনৈতিক অর্জন

জুলাই সনদ : আইনি ভিত্তি প্রশ্নে গড়িমসি কেন?

বাঁকা আঙুলে ঘি ও অবৈধ অস্ত্রের চোখ রাঙানি

গুম-খুনের বিচার : অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ

সুষ্ঠু নির্বাচন কি নির্বাসনে যাবে?

আফগানিস্তানে ভারতের ছায়া

নতুন বাংলাদেশে ৭ নভেম্বরের প্রাসঙ্গিকতা

নতুন ব্যাংক কতটা যৌক্তিক?

জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় আসার পটভূমি

যে শিখা জ্বলে উঠেছিল ৭ নভেম্বর