বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ভার্জিয়া উল্ফ ‘Shakespeare’s Sister’ প্রবন্ধে একটি কাল্পনিক গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, কীভাবে নারীর সৃজনশীলতা অবদমিত হয়, কীভাবে সাহিত্যচর্চা থেকে তারা বঞ্চিত হয় এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান কীভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তিনি কল্পনা করেন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের একটি সমান প্রতিভাবান বোন ছিল, যার নাম জুডিথ শেক্সপিয়ার। কিন্তু তিনি ভাইয়ের মতো সুযোগ পাননি, পড়ালেখা করতে পারেননি, থিয়েটারে অংশ নিতে পারেননি; বরং তাকে অল্প বয়সে নেকাহ দিতে চাওয়া হয়। জুডিথ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে নাট্যজগতে প্রবেশের চেষ্টা করলেও সেখানে তাকে কেউ তাজিম ও তোয়াজ করেনি; বরং তাকে যৌন নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। হতাশ, নিরুপায় হয়ে নিদারুণ দুঃখ, কষ্ট ও ছদমা নিয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে নিষ্ঠুর দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। উল্ফ এই মেটাফোর দিয়ে বোঝাতে চান, যদি অতীতে কোনো নারী শেক্সপিয়ারের মতো প্রতিভাবান ও দানিশমানও হতেন, তবুও পেট্রিয়ারকিয়াল সমাজ ও অর্থনৈতিক পরাধীনতা তার প্রতিভা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াত।
উল্ফ বলেন, ইতিহাসে নারীর লেখার অনুপস্থিতি কোনো প্রাকৃতিক দুর্বলতা নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার ফল। তিনি নারী-পুরুষের সমান প্রতিভার মধ্যকার অসম সুযোগের বাস্তবতা তুলে ধরেন।
নারীবাদ একটি সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন ও মতাদর্শ, যা নারীর সমানাধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়েছে। এটি শুধু নারীর অধিকারের জন্য লড়াই নয়, বরং একটি সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার জন্য একটি দর্শন। নারীবাদের ইতিহাস বহু যুগ ধরে বিস্তৃত এবং এর মূল চালিকাশক্তি ছিল সমাজে নারীর অবস্থান, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
নারীবাদের হিস্টোরিওগ্রাফিকে সাধারণত চারটি তরঙ্গ বা ধাপে ভাগ করা হয়। প্রথম তরঙ্গ (১৮৪৮-১৯২০) ছিল মূলত আইনি সমতা অর্জনের আন্দোলন। নারীরা তখনো ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, শিক্ষা ও চাকরি পেত না, সম্পত্তির অধিকার ছিল না। এমনকি ফরাসি বিপ্লবের ‘liberty, equality, fraternity’ নারীদের জন্য কার্যকর ছিল না; কিন্তু এটাই প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছিল নারীদের।
সেনেকা ফলস কনভেনশন ১৮৪৮, আমেরিকাতে এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন ও লুক্রেটিয়া মোট নারীর ভোটাধিকারের দাবি তোলেন। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ, লেখিকা ও নারীবাদের পথপ্রদর্শক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট তার ‘A Vindication of the Rights of Woman’ (১৭৯২) গ্রন্থে নারীর শিক্ষা ও মর্যাদার পক্ষে যুক্তি হাজির করেন। বলা হয়ে থাকে, গ্রন্থটি আধুনিক নারীবাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। ফরাসি বিপ্লবের ‘স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব’ আদর্শ শুধু পুরুষের জন্য প্রযোজ্য ছিল, নারীর জন্য নয়। ফলে নারীরা নিজেদের কণ্ঠস্বর খুঁজে নিতে শুরু করে। আর এই বইটিতে বিশ্ববিখ্যাত ও সর্বযুগে সমাদৃত ইংরেজি সাহিত্যের মহান কবি John Milton ও ফরাসি বিখ্যাত দার্শনিক Jean-Jacques Rousseau-কে ও সমালোচনা করা হয়, কারণ এই দুজন নারী সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছিলেন, তা ছিল পুরুষতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর। তাছাড়া রুশো তার বিখ্যাত বই ‘Émile, or On Education (1762)’-এ বলেছিলেন, ‘A woman’s education should always be relative to a man... to please him, to be useful to him... to make his life sweet and agreeable.’ এই বক্তব্য অনুযায়ী, নারীর শিক্ষা ও অস্তিত্ব কেবল পুরুষের জরুরত মেটানোর জন্য। রুশো মনে করতেন নারীকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নয়, আবেগ ও সৌন্দর্যগতভাবে গড়া উচিত, যেন সে পুরুষকে খুশি রাখতে পারে। তিনি বলেন, রুশো নারীদের স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে ভাবতেই পারেননি, নারীকে পুরুষের সেবিকা বানাতে চেয়েছিলেন এবং নারীকে শিক্ষা ও যুক্তিবোধ থেকে বঞ্চিত রাখতে চেয়েছেন। অথচ নারী ও পুরুষ উভয়েই যুক্তিবান মানুষ। সুতরাং নারীকে শুধু পুরুষের খুশির জন্য গড়ে তোলার চিন্তা অমানবিক ও অযৌক্তিক। আর Milton তার মহাকাব্য ‘Paradise Lost’-এ ঈশ্বর ও সৃষ্টির বর্ণনার মাঝে নারীকে পুরুষের অধীন হিসেবে দেখিয়েছেন। বিশেষত ‘He for God only, she for God in him.’— Paradise Lost, Book IV; অর্থাৎ, পুরুষ সরাসরি ঈশ্বরের জন্য, কিন্তু নারী ঈশ্বরের জন্য নয়—পুরুষের জন্ম ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে। এছাড়া ইভকে পাপের মূল কারণ হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়। তিনি বলেন, Milton নারীর আত্মস্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করেছেন। ধর্মের আড়ালে নারীকে অপরাধী ও অধীনস্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি দেখান, এ ধরনের সাহিত্যিক পোরট্রেইট নারীর প্রতি সমাজের অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গিকে ন্যায়সংগত করে তোলে। তিনি চাইতেন নারীকে যুক্তিবান মানুষ, সম্পূর্ণ ব্যক্তি এবং সমান অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক হিসেবে দেখা হোক।
আর জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘The Subjection of Women’ বইটিও প্রথম তরঙ্গের দর্শনের ভিত্তি গড়ে দেয়, নারীবাদের মূলভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। সুফ্রেজেট আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন এমিলি প্যাঙ্কহার্স্ট। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। ব্রিটেনে ১৯১৮ সালে প্রথম নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। এর সূচনা ঘটে ১৮৪৮ সালের আমেরিকার সেনেকা ফলস কনভেনশনের মাধ্যমে, যেখানে এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন ও লুক্রেটিয়া মোট নারীদের ভোটাধিকার দাবি তোলেন।
দ্বিতীয় তরঙ্গ (১৯৬০-১৯৮০) প্রশ্ন তোলে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে। এই পর্যায়ে মূলত ‘পিতৃতন্ত্র (Patriarchy)’, পরিবার, নারীর ব্যক্তিগত জীবন এবং যৌনতার স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক পরিসরে তুলে আনে। এই পর্যায়ে নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ, গৃহস্থালি শ্রমের মূল্য, যৌন হয়রানি, গর্ভপাতের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, পারিবারিক নিপীড়ন, বায়োপলিটিক্স, হাউসওয়ার্ক, মিডিয়ার ভূমিকা এবং সংস্কৃতিতে নারীর উপস্থাপনাকে ঘিরে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
সিমোন দ্য বোভোয়ার তার ‘The Second Sex’ (১৯৪৯) বইয়ে তিনি লেখেন, ‘One is not born, but rather becomes, a woman.’ মানুষ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, নারী হওয়া কোনো জৈবিক বা প্রাকৃতিক বিষয় নয়, বরং সমাজ ও সংস্কৃতি একজন মানুষকে ‘নারী’ বানায়। অর্থাৎ, জন্মের সময় শুধু দেহ থাকে, কিন্তু সমাজ শেখায় কীভাবে ‘নারীর মতো’ আচরণ করতে হবে।
বেটি ফ্রায়েডান তার লেখা ‘The Feminine Mystique’ (১৯৬৩) আমেরিকার গৃহিণীদের ‘অসন্তুষ্টির নামহীন রোগ’ তুলে ধরে। গ্লোরিয়া স্টেইনেম মার্কিন নারীবাদের এক সাংগঠনিক মুখ। নারীর শরীর, যৌনতা ও প্রজননের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নারীদের অধিকার উঠে আসে। পরিবার, ধর্ম ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের পুনঃবিশ্লেষণ শুরু হয়। গৃহবন্দি নারীর বিষণ্ণতার কথা বলে নারীবাদী চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটায়।
তৃতীয় তরঙ্গ (১৯৯০-২০১০) এই ধাপে নারীবাদ আরো বহুবিধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপ নেয়। সমকামিতা, লিঙ্গপরিচয়, রেসিজম ও ক্লাসিজমকে নারীবাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। Diversification of voices: ব্ল্যাক, লাতিনো, এশিয়ান, নারীবাদী কণ্ঠ। ‘আমার শরীর, আমার অধিকার’, ‘choice feminism’ ও পপ কালচারকে নারীবাদের আলোকে দেখা। ‘ইন্টারসেকশনালিটি’ : কিম্বারলি ক্রেনশ’র এই তত্ত্ব অনুযায়ী, নারীর অভিজ্ঞতা তার লিঙ্গ ছাড়াও জাতি, শ্রেণি ও যৌনতা দ্বারা প্রভাবিত হয়। ধারণা অনুসারে একজন নারীর অভিজ্ঞতা তার লিঙ্গ পরিচয়ের পাশাপাশি তার জাতিগত, শ্রেণিগত ও যৌনিক পরিচয়ের ওপরও নির্ভর করে। এই তরঙ্গের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক Judith Butler তার ‘Gender Trouble’ গ্রন্থে বলেন, জেন্ডার একটি পারফরমেটিভ কনস্ট্রাকশন; অর্থাৎ এটি কোনো জন্মগত সত্য নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মিত। অর্থাৎ আমরা যা করি, তা-ই আমাদের জেন্ডার পরিচয় নির্মাণ করে। বেল হুকসের লেখায় কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়।
চতুর্থ তরঙ্গ (২০১০-বর্তমান)—এই তরঙ্গ ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, ধর্ষণ সংস্কৃতি, কনসেন্ট ও অনলাইন হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরির কোশেশ হয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নারীবাদী কর্মকাণ্ডকে নতুন মাত্রা দেয়। MeToo, WhyIStayed,TimesUp,YesAllWomen-এর মতো হ্যাশট্যাগ আন্দোলন বিশ্বজুড়ে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। এই ঢেউ নারীবাদের ওপর একটি বৃহৎ প্রযুক্তিগত ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করে, যেখানে নারীর কণ্ঠস্বর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়।
নারীবাদের মধ্যে বিভিন্ন ফিলোসোফিক্যাল ধারা কাজ করেছে। উদার নারীবাদ নারীর সমান অধিকার ও সুযোগের পক্ষে, যা মূলত আইন ও নীতির মাধ্যমে অর্জনের চেষ্টা করে। মার্কসবাদী নারীবাদ নারীর আর্থ-সামাজিক শোষণের দিকটি তুলে ধরে, যেখানে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তার ‘Origin of the Family, Private Property and the State’ গ্রন্থে বলেন, পিতৃতন্ত্রের উত্থান হয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের মাধ্যমে। র্যাডিক্যাল নারীবাদ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকেই ভেঙে ফেলার আহ্বান জানায়। পোস্টমডার্ন নারীবাদ ‘নারী’ ধারণাকে আবার বিশ্লেষণ করে, যা কেবল একটি জৈবিক পরিচয় নয়, বরং সামাজিকভাবে নির্মিত একটি রূপ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীবাদ একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। উপমহাদেশে বেগম রোকেয়া ছিলেন নারীবাদের প্রাথমিক পথিকৃৎ, যদিও তিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং এন্ড্রোসেন্ট্রিক ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে লিখেছেন এবং অনেক মহলে বিতর্কিতও হয়েছেন বটে। স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীবাদী চেতনার ভিত্তি গড়ে তোলে বলে গুমান করি। পোস্ট-ইন্ডিপেনডেন্স সময়ে বিভিন্ন এনজিও, নারী সংগঠন ও সচেতনতা কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মজীবী নারী, গ্রামীণ নারী এবং শহরের মধ্যবিত্ত নারীর অভিজ্ঞতা নারীবাদের আলোচনায় উঠে আসে। বাংলাদেশের নারীবাদ আজ শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়; এটি একটি বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যময় সামাজিক বাস্তবতাও বটে।
সাম্প্রতিককালে নারীর প্রতি সহিংসতা, গার্হস্থ্য নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, পোশাকশিল্পে বৈষম্য এবং মিডিয়ায় নারীর যৌনীকরণ—এসব বিষয়ে নারীবাদ মুখ খুলেছে এবং আইন ও নীতিতে প্রভাব ফেলেছে। যদিও ধর্মীয় কট্টরপন্থা, সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা এবং নারীবাদ নিয়ে বাজারে চালু ভুল ধারণা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সোশ্যাল মিডিয়া ও তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি নারীবাদকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। সবশেষে, নারীবাদ একটি চলমান যাত্রা, একটি প্রশ্ন ও প্রতিরোধের নাম। এটি প্রতিটি সমাজ, সংস্কৃতি এবং সময়ের আলাদা প্রেক্ষাপটে আলাদা রূপ নেয়। নারীবাদ কেবল নারীর মুক্তি নয়—পুরুষেরও মুক্তি, এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বিপরীতে বিকেন্দ্রীকরণ এবং মানবতার সম্মিলিত জয়। যদিও পশ্চিমের নারীবাদের বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ায় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রথা, পরিবার ও শ্রেণিগত কাঠামোর কারণে নারীবাদের গতি ধীর, তবে বর্তমানে নারীর পুনর্বাসন ও অংশগ্রহণ সব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং বাড়ছে।
পরিশেষে বলব, নারীবাদ আজ কেবল একটি সামাজিক আন্দোলন নয়—এটি হচ্ছে রাজনীতি, দর্শন, সাহিত্য ও রাজনীতির একটি জটিল জালে আবদ্ধ শক্তি। নারীবাদ যদি সত্যিকার অর্থে সামাজিক মুক্তি ও ন্যায়বিচারের আন্দোলন হয়, তবে সেটিকে অবশ্যই শ্রেণি, ধর্ম, অঞ্চল, যৌন পরিচয় ইত্যাদির বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে হবে, নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিভাজনকে স্বীকার করে নতুন ভাষা খুঁজতে হবে এবং নারীদের জন্য নয়, সামগ্রিক মানবমুক্তির লড়াইয়ে পরিণত হতে হবে। নারীবাদ তখনই কার্যকর ও অর্থপূর্ণ, যখন তা সবার, সব নারীর, এমনকি পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের মুক্তির গল্প হয়ে দাঁড়ায়।
নারীবাদ কোনো একরৈখিক বা একপক্ষীয় আন্দোলন নয়—এটি একটি জীবন্ত বিকাশমান চিন্তাধারা, যা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতির ছাঁচে প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত হচ্ছে। নারীবাদের মূল আত্মা হলো মানবিক সমতা, মর্যাদা ও স্বনির্ভরতা। বিশ্বজুড়ে নারীবাদ নারীর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে; কিন্তু একইসঙ্গে তা জটিল রাজনৈতিক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। নারীবাদ আজও ধর্মীয় মৌলবাদ, সমাজের রক্ষণশীলতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দখলদারি মনোভাবের মুখে পড়ে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও নারীরা যেভাবে সাহিত্য, রাজনীতি, শিক্ষা ও সমাজে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে, তা এই তত্ত্বের কার্যকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তারই প্রমাণ।
লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি
sahidkamrul25@gmail.com