ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে, তখন দুর্নীতি কেলেঙ্কারি, মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের কারণে দেশটিতে অসন্তোষের ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই ভারতে একটি নতুন যুগের সূচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার এই প্রতিশ্রুতি ছিল—‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ বা ‘সকলকে সাথে নিয়ে, সকলের জন্য উন্নয়ন’। তার এই প্রতিশ্রুতির মূল কথা ছিল সুশাসন, উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং ‘অভিজাত সংস্কৃতির’ অবসান ঘটানো। কিন্তু এক দশক পর ভারতের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন, যেখানে মোদিও এই স্লোগান সাধারণ মানুষের চেয়ে রাজনৈতিক এলিট শ্রেণিকেই বেশি উপকৃত করেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মসের (এডিআর) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় নির্বাচিত ৯৩ শতাংশ সদস্যই কোটিপতি। এদের প্রত্যেকের সম্পদের পরিমাণ ১২০,০০০ মার্কিন ডলারের বেশি।
ভারতের গণতন্ত্র খুব দ্রুতই অতি-ধনী বা ধনতন্ত্রের শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই প্রবণতার নেতৃত্ব দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। অথচ দলটি ভারতে এলিট কালচারের অবসান ঘটানোর কথা বলেই ক্ষমতায় এসেছিল।
সুবিধাভোগীদের গণতন্ত্র
২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি থেকে বিজয়ী ২৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৪ জন (১৪ শতাংশ) ৬ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি সম্পদের মালিক থাকার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ১৩০ জন (৫৪ শতাংশ) জানিয়েছিলেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ ১২০,০০০ থেকে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে এবং ৬৩ জন (২৬ শতাংশ) ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার থেকে ৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে সম্পদের কথা জানিয়েছেন। বিজেপির মাত্র ১৩ জন বিজয়ী সদস্যের (৫ শতাংশ) সম্পদের পরিমাণ ১২০,০০০ মার্কিন ডলারের কম ছিল।
অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টিতে ৯৯ জন নির্বাচিত সদস্যের মধ্যে ৯৩ শতাংশই কোটিপতি। এছাড়া ২০টির বেশি আসন পাওয়া দলগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ বিজয়ী সদস্যও কোটিপতি।
২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিজেপি সদস্যদের গড় সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার, যেখানে কংগ্রেস সদস্যদের গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির দিক থেকে বিজেপি এমপি তেজস্বী সূর্যের সম্পদ ২০১৯ সালে ১৬,০০০ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে প্রায় ৪,৯০,০০০ ডলারে পৌঁছে। তার সম্পদ প্রায় ৩০ গুণ বেড়েছে। একইভাবে, বিজেপির আরেক এমপি রমেশ চন্দপ্পা জিগাজিনাগির সম্পদ ২০ বছরে বেড়েছে প্রায় ১০০ গুণ। সম্পদের এই বৃদ্ধি শুধু বিজেপি সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গদকারির ছেলে নিখিল গাদকারির কোম্পানি সিয়ান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ২০২৪ সালে ইথানল উৎপাদন শুরু করে এবং ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়া প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির আয় ২১০,০০০ ডলার থেকে বেড়ে এক বছরে ৬১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২৫ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দামও শূন্য দশমিক ৫৩ ডলার থেকে বেড়ে ৩৬ দশমিক ৫ ডলারে পৌঁছে যায়।
একইভাবে, ২০২৪ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে মোদির ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে জয় শাহর কোম্পানি কুসুম পলিপ্লাস্ট প্রাইভেট লিমিটেডের আয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এ সময় কোম্পানির সম্পদ প্রায় ১৪১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানির সম্পদ ২০২৫ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। গত এক দশকে এভাবেই রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের পরিবারের সম্পদ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক দ্রুত বেড়েছে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যরা গড়ে ৯০০,০০০ ডলার সম্পদের মালিক। তারা দেশটির সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় ২৭ গুণ বেশি ধনী। ভারতের জনসংখ্যার বেশির ভাগই এখনো বাস করে গ্রামীণ এলাকায়। তাদের সঙ্গে রাজনীতিকদের আয়ের তুলনা করলে এই বৈষম্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বৈষম্যের একটি বড় উদাহরণ হলো বিহার। বিজেপি-জেডিইউ জোটশাসিত এই রাজ্য দেশের দরিদ্রতম এবং স্বল্প শিল্পোন্নত রাজ্যগুলোর একটি।
বিহারের মাথাপিছু গড় আয় বছরে মাত্র ৬৫০ ডলার, যা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে কম। কিন্তু এই রাজ্যের রাজনীতিকদের অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র ভিন্ন। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মসের (এডিআর) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিহারের ২৪১ জন বিধানসভার সদস্য বা বিধায়কের ৮০ শতাংশই কোটিপতি। তাদের গড় সম্পদের পরিমাণ ৫৬০,০০০ মার্কিন ডলার। এমনকি এত দরিদ্র রাজ্যেও বিজেপি নেতাদের সম্পদ গত এক দশকে ৪৭ থেকে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরীর সম্পদের পরিমাণ এখন ১ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রেণু দেবীর সম্পদের পরিমাণ ৮৪৩,০০০ ডলার এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পান্ডের ২৮২,০০০ ডলার। ২০২৩-২৪ সালে বিহারের ১২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও নির্বাচিত নেতারা ব্যক্তিগত সম্পদে যা সঞ্চয় করছেন, তার মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ (বার্ষিক ৬৫০ ডলার) আয় করেন সাধারণ নাগরিকরা। এটি বিজেপি প্রতিষ্ঠিত একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিত্র বহন করে, যেখানে জনকল্যাণের চেয়ে সম্পদ অর্জনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
যখন রাজনীতি একটি পোর্টফোলিওতে পরিণত হয়
স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকগুলোয় ভারতের রাজনীতির মানদণ্ড নির্ধারিত হতো আদর্শিক প্রতিশ্রুতি এবং ব্যক্তিগত কঠোরতার নিরিখে, যেখানে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মতো নেতারা সম্পদের চেয়ে সেবার মানদণ্ডে সাফল্যকে মূল্যায়ন করতেন। কিন্তু সম্পদ যখন রাজনীতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে ওঠে, তখন গণতন্ত্রে আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা খেলার সমান মাঠ থাকে না। সমাজতান্ত্রিক নেহরুবাদী রাষ্ট্র অর্থের শক্তিকে ভয় পায়। কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকার এই প্রবণতাকে আলিঙ্গন এবং সম্প্রসারিত করে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূল কর্মীদের পরিবর্তে বিত্তশালী প্রার্থীদের পছন্দ করে। এডিআরের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, দরিদ্র প্রার্থীদের তুলনায় ১২০,০০০ রুপির বেশি সম্পদের মালিক প্রার্থীদের নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা ২৮ গুণ বেশি।
ভারত আজ এক গণতান্ত্রিক বিরোধের মুখোমুখি
বিত্তশালী বা ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে দেশের দরিদ্র ভোটাররা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আনুমানিক ১৬০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যা ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন। বিপুল এই ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। বর্তমানে ভারতের একটি সংসদীয় আসনে প্রচারণার ব্যয় ৬০০,০০০ মার্কিন ডলার থেকে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে পড়ে। ফলে একজন সাধারণ ভোটারের পক্ষে এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রচারণা চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
ফলে নির্বাচনে বিত্তশালীদের একটি স্থায়ী চক্র তৈরি হয় এবং কার্যত অর্থই নির্বাচনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জেতা মানেই প্রচারণায় ব্যয় করা অর্থের বহুগুণ আবার ঘরে ফিলে আসার নিশ্চয়তা। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া একজন রাজনীতিকের অর্থকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে। বিজয়ী হওয়ার পর নানা চুক্তি এবং নীতির ওপর প্রভাব বিস্তার, করপোরেট অনুদানে প্রবেশ করা এবং বিবেচনামূলক তহবিলের মাধ্যমে সম্পদ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। বর্তমানে ভারতের রাজনীতি জনসেবার হাতিয়ার নয়, বরং সম্পদ বৃদ্ধির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এভাবেই ভারতের রাজনীতিতে অর্থ, পেশিশক্তি ও ভোটচক্র দরিদ্রদের একপাশে রাখে, অর্থের প্রভাবে নির্বাচনে জিতে যায়।
কিন্তু একটি প্রকৃত গণতন্ত্রে নেতাদের সম্পদ দিয়ে পরিমাপ করা হয় না, বরং তারা কতটা ন্যায্যভাবে দরিদ্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তা দিয়েই পরিমাপ করা হয়। ভারতের প্রতিষ্ঠাতারা সাম্য বা সমান মর্যাদার গণতন্ত্রের কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তা বিনিয়োগকারী বা সুবিধাভোগীদের গণতন্ত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী