হোম > মতামত

বাংলাদেশের গোয়েন্দা ব্যবস্থা : কাঠামোগত সংকট ও করণীয়

ব্যারিস্টার রফিক আহমেদ

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামোর অন্যতম কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হওয়ার কথা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। একটি দক্ষ, পেশাদার ও প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম গোয়েন্দা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রথম রক্ষাকবচ। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি ভিন্ন; এটি ক্রমাগত ব্যর্থতার এক করুণ দলিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড থেকে সাম্প্রতিক সময়ে শরীফ ওসমান হাদির মতো দেশপ্রেমিক কর্ণধারদের নৃশংস হত্যা—প্রতিটি ঘটনাই গোয়েন্দা ব্যবস্থার গভীর সংকট, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতি নির্দেশ করে। শরীফ ওসমান হাদি হত্যার হুমকি পেয়ে তা জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, এই ব্যর্থতা কি শুধুই অতীতের গলদ, নাকি এটি একটি চলমান প্রাতিষ্ঠানিক মহামারি?

গোয়েন্দা ব্যর্থতা : ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতি

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড, ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ড এবং ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলা—এসব ঘটনার একটি সাধারণ সূত্র হলো গোয়েন্দা পূর্বাভাস ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা। প্রতিবারই তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, রিপোর্ট প্রদান করা হয়, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাবে একই ধরনের ব্যর্থতা বারবার ঘুরেফিরে আসে। এই ব্যর্থতা কোনো দৈবদুর্বিপাক নয়; এটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আন্তঃসংস্থার জবাবদিহিতার অভাব এবং অদক্ষতার সম্মিলিত ফল।

১. বর্তমান গোয়েন্দা কার্যকলাপ : তথ্যের ভিড়ে বিশ্লেষণের দুর্ভিক্ষ

বর্তমান গোয়েন্দা কার্যক্রমের মূল সমস্যা হলো ‘তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ততা বনাম বিশ্লেষণে অপারগতা’। সামাজিক মাধ্যম নজরদারি, ফোন ট্যাপিং এবং মানবিক সূত্র থেকে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এই তথ্য যথাযথভাবে বিশ্লেষণ, ছাঁকনি ও অগ্রাধিকার নির্ধারণের অভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে ‘গাছ দেখা হয়, কিন্তু বন দেখা হয় না’। তদুপরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা সংস্থার অপব্যবহার এবং বিরোধী দল বা সরকারের অস্বস্তিকর ব্যক্তিদের ওপর নজরদারির ফলে সংস্থাগুলোর মূল নিরাপত্তা মিশন থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আন্তঃসংস্থা সমন্বয় ও তথ্য শেয়ারের অভাবে এক সংস্থা অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ Intelligence অপর সংস্থার অজানাই থেকে যায়।

২. বিদেশি গোয়েন্দা তৎপরতা : নিষ্ক্রিয় নজরদারি ও প্রতিক্রিয়াবাদী মনোভাব

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এটিকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। বিদেশি গোয়েন্দারা অর্থনৈতিক জ্ঞান চুরি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে অপারেশনের জন্য বাংলাদেশকে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষমতা পরিচালিত হয় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক নজরদারির দিকে। বিদেশি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক চিহ্নিতকরণে আধুনিক কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স কৌশল, সাইবার ট্র্যাকিং এবং দীর্ঘমেয়াদি HUMINT (মানব গোয়েন্দাবৃত্তি) অপারেশনের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। ফলে বহিরাগত হুমকি প্রায়ই প্রতিরোধের বাইরে থেকে যায়।

৩. নাগরিক হত্যা ও ‘ক্ষতিকর গোয়েন্দা’: বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অভ্যন্তরীণ শত্রু

নাগরিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত গোয়েন্দা কর্মী বা তাদের সহযোগীদের আইনের আওতায় আনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। পরিকল্পিত হত্যা (Targeted Killing) চালানোর জন্য রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি গোয়েন্দা এজেন্টদের ব্যবহারের গুঞ্জন সমাজে বিদ্যমান। সমস্যাটি দ্বিমুখী। প্রথমত, ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ দমনে গোয়েন্দা সংস্থার অপব্যবহার। দ্বিতীয়ত, সংস্থার ভেতরেই বিদ্যমান দূষিত ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, যারা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষা বা আর্থিক লাভের জন্য বেআইনি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। এদের চিহ্নিতকরণ এবং একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিতে পরিণত হতে পারে।

৪. উচ্চতর ট্রেনিং: প্রযুক্তি ও মানসিকতার আধুনিকীকরণ

বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ এখনো অনেকাংশে গতানুগতিক ও তত্ত্বকেন্দ্রিক। বাস্তবমুখী ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। আধুনিক যুগের গোয়েন্দা যুদ্ধ শুধু শারীরিক নজরদারি নয়; এটি সাইবার ওয়ারফেয়ার, অর্থনৈতিক গোয়েন্দাবৃত্তি, ডিপ ফেক ও তথ্যযুদ্ধের যুগ। অথচ সাইবার ইন্টেলিজেন্স, ডিজিটাল ফরেনসিক, ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ এখনো সীমিত। তদুপরি, প্রশিক্ষণের চেয়েও বেশি প্রয়োজন নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের শিক্ষা, যাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে শুধু জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কাজ করতে পারেন।

৫. দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা : রাজনীতির ঊর্ধ্বে একটি পেশাদার কাঠামো

গোয়েন্দা সংস্থার একমাত্র উত্তরসূরি হওয়া উচিত সংসদ ও জনগণ—কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি নয়। বাংলাদেশে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম প্রায়ই ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে প্রকৃত জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিগুলো উপেক্ষিত হয়। একটি শক্তিশালী, স্বায়ত্তশাসিত, জবাবদিহিমূলক ও প্রযুক্তিগতভাবে অত্যাধুনিক গোয়েন্দা কাঠামো গড়ে তুলতে না পারলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নিরাপত্তা কখনোই নিশ্চিত হবে না। এজন্য প্রয়োজন একটি ‘গোয়েন্দা সুপারভাইজরি বোর্ড’ গঠন, যেখানে সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, যারা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজের ওপর নজরদারি রাখবে।

সংস্কার নয়, বিপ্লবের প্রয়োজন

বাংলাদেশের গোয়েন্দা ব্যর্থতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি কাঠামোগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সংকটের বহিঃপ্রকাশ। শহীদ জিয়ার রক্ত থেকে শহীদ শরীফ ওসমান হাদির রক্ত পর্যন্ত ইতিহাসের পাতাজুড়ে লিখিত রয়েছে সতর্কবার্তা। ছোটখাটো সংস্কারে এই গভীর ক্ষত শুকানো যাবে না। প্রয়োজন একটি সাহসী ও মৌলিক পরিবর্তনের—রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কাঠামো তৈরি, সর্বোচ্চ স্তরে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের প্রবর্তন এবং সর্বোপরি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মিশনকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে একে শুধু জাতীয় নিরাপত্তার সেবায় নিয়োজিত করা। বাংলাদেশের জনগণ এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এই সংস্কারকে এখনই অপরিহার্য করে তুলেছে। সময় ফুরিয়ে আসছে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা কতটা গুরুত্ব পাবে?

চট্টগ্রাম বন্দর : লাভ না ক্ষতি

খৃস্টের সম্মান

মাতুয়া অভিবাসন : হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের মিথ্যা বয়ান

শেষ হয়নি আরব বসন্ত

চিরকালের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে গেলেন ওসমান হাদি

আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লড়াই

মিডিয়ার ভালোবাসায় দিশাহারা বিএনপি

গণমাধ্যমের বয়ান নির্মাণ এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান