হোম > মতামত

প্রবাসে রাজনৈতিক বিদ্বেষের নতুন সংস্কৃতি

রাজু আলীম

ছবি: সংগৃহীত

একটি জাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার অভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উভয়েরই প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল সরকার গঠন বা নীতি নির্ধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা এবং জাতীয় ঐক্যকেও প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছে, যা দেশের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং সেই সফরে তার প্রতিনিধি দলের সদস্য আখতার হোসেনের ওপর হামলার ঘটনাটি এই সংকটেরই এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফর ও অপ্রীতিকর ঘটনা:

প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফরটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক মুহূর্ত। দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিল। সফরটি কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার জন্য নয়, বরং একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্যও জরুরি ছিল। কিন্তু এই সফরের শুরুতেই নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ও নিন্দনীয় ঘটনাটি সকল ইতিবাচক দিককে আড়াল করে দিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপ ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা হয় এবং এ ঘটনায় একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে আটকও করা হয়েছে। এই ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবেই দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজন কতটা গভীর, তা আবারও সামনে এনেছে।

এই হামলার পেছনের মূল কারণ রাজনৈতিক বিদ্বেষ। আখতার হোসেন যে দল (জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি) থেকে এসেছেন, তা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং এটি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘জুলাই বিপ্লবের’ ফসল হিসেবে দেখা হয়। তাই, হামলায় জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আক্রমণকারী একজন যুবলীগ নেতা। এই হামলাকে অনেকেই ‘জুলাই সন্ত্রাসী’ স্লোগান দিয়ে সংঘটিত একটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ হিসেবে দেখছেন। এটি প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক বিরোধিতা এখন আর কেবল আদর্শিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা সহিংস ব্যক্তিগত বিদ্বেষে রূপ নিয়েছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা এই হামলাকে ব্যক্তি আখতার হোসেনের ওপর আক্রমণ না বলে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে করা হামলা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এটি ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে যারা কাজ করছে, তাদের প্রতি পরাজিত শক্তির ভয় ও হতাশার প্রতিফলন বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতি ও ভাবমূর্তির সংকট:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিপক্ষকে দমন করার একটি প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতা কেবল দেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে প্রায়শই সভা-সমাবেশ, পাল্টা বিক্ষোভ এবং স্লোগান দেখা যায়। কিন্তু এবার তা ব্যক্তিগত সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, যা দেশের সম্মান ও মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব এতটাই তীব্র যে তা ভিন্নমতের প্রতি ন্যূনতম সহনশীলতাও দেখাতে পারে না। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত। একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকবে, কিন্তু তা কখনই ব্যক্তিগত আক্রমণ বা সহিংসতার রূপ নেবে না।

যখন এই ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে, তখন তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক বার্তা দেয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী, পর্যটক এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বুঝতে হবে যে দেশের সম্মান যেকোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যতই তীব্র হোক না কেন, তা যেন ব্যক্তিগত আক্রমণ বা সহিংসতার রূপ না নেয়, সেদিকে তাদের সচেতন থাকতে হবে।

সরকারের দায় ও প্রবাসে সংঘাত:

এই ধরনের ঘটনার দায়ভার পুরোপুরি রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকদের। আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত যে সহিংসতা করে জনসমর্থন পাওয়া যায় না। বরং এই ধরনের আচরণ দেশের অভ্যন্তরে থাকা সাধারণ নেতা-কর্মীদের আরও বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। যারা প্রবাসে থেকে এসব কাজের ইন্ধন দিচ্ছেন, তাদের বোঝা উচিত যে এই ধরনের সহিংসতা কেবল মানুষের মধ্যে বিরক্তি ও ঘৃণার উদ্রেক করবে।

নিউইয়র্কের ঘটনায়, সরকার ও নিউইয়র্কের বাংলাদেশের কনস্যুলেট অফিস নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ভিডিওগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তার অভাব ছিল। এই ঘটনাটি কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার চরম ব্যর্থতা। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশের অভ্যন্তরেও যে উগ্রতা দেখা যাচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে আহ্বান কেউ কেউ জানাচ্ছেন, তা 'পারস্পরিক উগ্রতা' (reciprocal radicalization)-এর একটি লক্ষণ, যেখানে এক পক্ষের সহিংসতা অপর পক্ষকে আরও উত্তেজিত করে তোলে।

অর্থনীতি ও ভাবমূর্তি:

প্রধান উপদেষ্টার সফরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আস্থা অর্জন করা। দেশের অর্থনীতি বর্তমানে চাপের মধ্যে। রিজার্ভ সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতে হলে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই বিনিয়োগকারীরা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া হামলার খবর বিনিয়োগকারীদের মনে নতুন করে প্রশ্ন তুলতে পারে – বাংলাদেশ কি সত্যিই স্থিতিশীল হচ্ছে? তারা কি নিরাপদে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকে দ্রুত দিতে হবে। নইলে সফরের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

রাজনীতির জটিলতা:

প্রবাসী সম্প্রদায় প্রায়ই নিজ দেশের রাজনীতির সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, 'ডায়াসপোরা রাজনীতি' ‘হোমল্যান্ড পলিটিকস’ ও ‘হোস্টল্যান্ড পলিটিকস’-এর মাঝামাঝি এক অস্বস্তিকর অবস্থানে থাকে। এই অস্বস্তিকর অবস্থানে যদি নেতারা সহিংসতার উসকানি দেন, তবে তার রাজনৈতিক ফলাফল ভালো হয় না। বাস্তবতা হলো, প্রবাসী রাজনৈতিক সহিংসতা শুধু বিদেশে অশান্তি তৈরি করবে না, বরং বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করবে। এটি বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা ব্যর্থতাকেও তুলে ধরে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে আরও উসকে দেবে। এই মুহূর্তে বিবদমান পক্ষগুলো এই সহিংসতার মাধ্যমে প্রতীকী ক্ষমতার প্রদর্শন করছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ দেখাতে চাচ্ছে যে প্রবাসের মাটিতে তারা রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম রেখেছে। কিন্তু এতে করে তাদের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও রাগ আর বাড়বে।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা

মনের তালা এবং শরবতের মতো ভালোবাসা

মোদি-নেতানিয়াহুর মুসলিমবিদ্বেষী দোস্তি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি

শান্তির মুখোশে গাজায় টনি ব্লেয়ারের প্রত্যাবর্তন

মেধা পাচার রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিচ্ছে

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কে বেশি অসহায়

মুসলিম বিদ্বেষ ও ভারতের বিনোদন সংস্কৃতি

দুর্ঘটনা না নাশকতা

নেতৃত্ব নির্বাচনে সচেতনতার ঘাটতি

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল কী বার্তা দেয়