হোম > মতামত

ইউক্যালিপটাস আকাশমণি ও সেগুনের কথা

প্রফেসর ড. মো. আবুল কাসেম

ফাইল ছবি

কাঠের চাহিদা মেটাতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির আগমন ঘটে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ষাটের দশক থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত গবেষণা করে দেশের সব কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের উপযোগী অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা ৮০০ জাতের ইউক্যালিপটাস থেকে মাত্র তিন প্রজাতির ইউক্যালিপটাস এবং আট জাতের আকাশমণি থেকে মাত্র দুই প্রজাতির আকাশমণি গাছ অবমুক্ত করে।

ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি উদ্ভিদগুলো দ্রুত বাড়ে, পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা বেশি, যেসব অবক্ষয়িত জায়গায় অন্য কোনো গাছ জন্মানো সম্ভব না, সেসব জায়গায়ও এদের চাষ করা যাচ্ছে। উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে, পতিত জমিতে, রাস্তার ধারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বাড়ির আঙিনায় ও শুষ্ক মাটিতে, জলাশয়ের আশপাশে ও অবক্ষয়িত বনে এদের রোপণ করা যেতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলে এদের চাষে মানুষের কাঠের চাহিদা, ঘরের খুঁটি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংস থেকে মানুষের ধন-সম্পদ রক্ষা, মাটিকে চাষ উপযোগী এবং ভূমির ক্ষয়রোধে গাছগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

ইউক্যালিপটাস গাছ দিনে প্রায় ২০-২০০ লিটার পর্যন্ত পানি টেনে নেয় (আকাশমণি কিছু কম শোষণ করে)। অন্যদিকে দেশীয় ফলদ ও বনজ গাছ দৈনিক গড়ে ২০-৭০ লিটার পানি শোষণ করে থাকে। দেশীয় গাছের মধ্যে সাদা কড়ই ইউক্যালিপটাসের চেয়ে বেশি পানি শোষণ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সের গবেষণা অনুযায়ী, এক ঘন সেন্টিমিটার কাঠ উৎপাদনে কদমগাছ পানি শোষণ ৪ হাজার ২৩৩ মিলিমিটার, ইউক্যালিপটাসের ক্যামেলডালেন্সিস প্রজাতি শোষণ করে ৩ হাজার ১৪৫ মিলিমিটার, আকাশমণি (একাশিয়া) শোষণ করে ২ হাজার ২২৩ মিলিমিটার।

সাধারণত হাইব্রিড জাতের সব উদ্ভিদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য অতিরিক্ত পুষ্টি ও পানির প্রয়োজন হয়। যেমন : বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে ৩ হাজার ৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ পানির উৎস থেকে। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন, বৃক্ষচ্ছেদন, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট এবং ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জের অভাব। শুধু ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে, যা দিয়ে মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আকারের অন্তত ২০টি স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব।

সম্প্রতি ব্রিটিশ সাপ্তাহিক নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে কূপ থেকে লাখ লাখ লিটার পানি উত্তোলনের ফলে অনেক স্থানে দ্রুত কমে গিয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির মজুত। গবেষকরা মূলত জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের অতিরিক্ত পানি ব্যবহারকে এর জন্য দায়ী করেছেন। উল্লেখ্য, ইউক্যালিপটাস বা আকাশমণি গাছের পানি শোষণের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামা বা কৃষিজমির আর্দ্রতা কমে যাওয়ার তথ্য আমার জানা মতে কোনো গবেষণায় উপস্থাপন করা হয়নি।

যে অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৫ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন-১ অধিশাখা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ দুটির চারা তৈরি, রোপণ এবং কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছেন, আমার অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন তথ্যবিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, এই উদ্যোগ সেগুনের ক্ষেত্রে হলে প্রশংসনীয় হতো। কারণ উল্লিখিত দুটি উদ্ভিদের চেয়ে পরিবেশে সেগুনের নেতিবাচক প্রভাব অনেক অনেক গুণ বেশি।

সেগুনগাছের শিকড় খুব বেশি গভীরে পৌঁছায় না, এক থেকে দুই মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে মাটি থেকে পানি শোষণ করে মাটিকে রুক্ষ করে তোলে। ফলে যেখানে সেগুনগাছ লাগানো হয়, সেখানে মাটি শুকিয়ে যেতে থাকে। পাহাড়ি অঞ্চলের ঝিরি-ঝরনা, যা প্রাকৃতিক পানির উৎস, সেগুনগাছের কারণেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এই গাছের পাতাগুলো বেশ বড় এবং মাটিতে পড়ে মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধি করে, যা মাটির পুষ্টিচক্রকে ব্যাহত করে।

সেগুনগাছের পাতা অনেক বড়। এ গাছের ছায়ায় অন্যান্য গাছপালা জন্মাতে পারে না বা তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং জীববৈচিত্র্য কমে যায়। তাছাড়া এ গাছের শিকড় মাটি আলগা করে দেয় এবং ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত করে।

এই প্রসঙ্গে সেগুনগাছ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশে বিরূপ প্রভাব শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে, পাহাড়ে পরিবেশের বিষবৃক্ষ হলো সেগুন। সেগুনগাছ লাগানোর ফলে পরিবেশে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, তা স্থানীয় জনগণের জীবিকা এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রার জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
যাই হোক, যেসব অজুহাতের ভিত্তিতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি রোপণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাদের কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন ছিল।

আমি বলছি না যে, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির কোনো বিরূপ প্রভাব পরিবেশের ওপর নেই; কিন্তু তাদের চাষাবাদ বন্ধ না করে ব্যবহারে একটা সীমারেখা টানা যেতে পারে। যেমন : প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, একক বাগান এবং ফসলি জমির পরিবর্তে উপকূলীয় অঞ্চল, অবক্ষয়িত বন পতিত জমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি অফিস প্রাঙ্গণ এবং জলাভূমির আশপাশে এই বৃক্ষগুলো রোপণ করা যেতে পারে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানুষের কাঠের চাহিদা লাঘবে গাছ দুটো ভূমিকা রাখবে। আমার এই ধৃষ্টতা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে সংশ্লিষ্ট মহলকে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির ব্যাপারে পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক : মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব

যুক্তরাষ্ট্র কি গাজায় সংঘাতে জড়াবে?

আস্থাহীন উদ্যোক্তা স্থবির কর্মসংস্থান

ভারতের প্রেসক্রিপশনে গোয়েন্দা সংস্থার অবক্ষয়

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ন্যায়বিচারে যুগান্তকারী ঘটনা

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বাড়াতে যা প্রয়োজন

আগামী সংসদ নির্বাচনে ভারত ফ্যাক্টর

নতুন নিরাপত্তা সমীকরণে ভারত

শিবিরের উত্থান : ছাত্ররাজনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা