হোম > মতামত

বাংলাদেশ থেকে নেপাল : স্বাধীনতার নতুন স্বপ্ন

শামসুল আরেফীন

মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ—বাংলাদেশ ও নেপাল—তরুণদের নেতৃত্বে অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের সাক্ষী হলো। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব টেনে নামিয়েছে এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী সরকারকে। আর নেপালে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র দশ দিনের ‘জেন জেড বিপ্লব’ সেই দেশের কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে, যিনি তরুণদের কণ্ঠরোধ করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করেছিলেন। প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও এই দুই আন্দোলনের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই তরুণ প্রজন্ম এবং তাদের ডিজিটাল জগৎ স্বাধীনতার নতুন স্বপ্নকে জন্ম দিয়েছে। যে তরুণ প্রজন্মকে বলা হতো রাজনীতিতে অনাগ্রহী আর শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, তারাই রাজনৈতিক দলগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে দিল—ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে হয় কেমন করে।

ঢাকা ও কাঠমান্ডুকে এক সুতোয় বেঁধেছে তরুণদের সাহস এবং ডিজিটাল স্পেস যেখানে তারা একসঙ্গে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছে। উভয় ক্ষেত্রেই, সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে কার্যকর মাধ্যম, যেটি একদিকে বিপ্লোবকে সংগঠিত করেছে, অন্যদিকে শাসকের নিষেধাজ্ঞার প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। নেপালে যখন টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও এক্স নিষিদ্ধ হলো, তখন তরুণরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।

বাংলাদেশেও সরকার যখন কোটার দাবিকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টকে ব্যবহার করে অযৌক্তিক রায় দিল, তখন শিক্ষার্থী এবং তরুণরা রাষ্ট্রের নানা নজরদারি ও সেন্সরশিপ থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেরা সংগঠিত হলো। ৩৬ দিনের আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় বাধা সত্ত্বেও তরুণরা শুধু সাইবার স্পেস-ই দখল করেনি, বরং রক্ত দিয়ে ফিজিক্যাল স্পেস রঞ্জিত করেছে। নানা সৃজনশীল কৌশলে রাষ্ট্রের দমননীতিকে অতিক্রম করেছে—কখনো পোস্টারের ভাষায়, কখনো গোপন লাইভস্ট্রিমে।

কিন্তু কেন এই বিদ্রোহগুলো ঘটল?

বাংলাদেশে বহুদিন ধরে চলছিল গণতন্ত্রের সংকট। ভোটহীন নির্বাচন, দুর্নীতি আর রাষ্ট্রীয় দমননীতি শাসকগোষ্ঠীকে জনগণের চোখে বৈধতা থেকে বঞ্চিত করেছিল। নেপালে, ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকার ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে মানুষের আস্থা হারাচ্ছিল। শেষমেশ বিস্ফোরণ ঘটাল তরুণ প্রজন্ম—যারা কর্তৃত্ববাদী শাসনে দমবন্ধ হয়ে পড়েছিল এবং পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে নিজেদের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছিল না।

সমাজতত্ত্বের আলোকে এই ঘটনাগুলো আরো স্পষ্ট হয়। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘ইমাজিন্ড কমিউনিটি’ ধারণা দিয়ে বোঝা যায় কীভাবে ভিন্ন দেশে থেকেও তরুণরা একে অন্যের সঙ্গে সংহতি গড়েছে। মুদ্রণপুঁজির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের বদলে জেনারেশন জেড নিজেদের কল্পিত সম্প্রদায় তৈরি করেছে অনলাইনে—হ্যাশট্যাগ, মিম, লাইভ ভিডিও আর ভাইরাল পোস্টের মাধ্যমে। বাংলাদেশের এক শিক্ষার্থীর টুইট নেপালের তরুণদের কাছে অনুরণন তুলেছে, তৈরি করেছে সীমান্ত ছাড়ানো এক নতুন জনপরিসর।

একইভাবে, মানুয়েল কাস্টেলসের ‘নেটওয়ার্ক থিওরি’ ধারণা দেখায় কীভাবে তরুণরা রাজনৈতিক দলকে পাশ কাটিয়ে বিকেন্দ্রীভূত ও অনুভূমিকভাবে সংগঠিত হয়েছে। প্রচলিত রাজনৈতিক দলকে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরতান্ত্রিক হিসেবে দেখেছে। তার বদলে তারা ভরসা করেছে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের ওপর—যেখানে নেতৃত্ব ভাগাভাগি, সৃজনশীলতা উন্মুক্ত আর সিদ্ধান্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই বিকেন্দ্রীভূত কৌশলই রাষ্ট্রের দমননীতিকে অকার্যকর করেছে।

প্রজন্মগত দিকটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। জেনারেশন জেড বড় হয়েছে একদিকে তথ্যপ্রযুক্তির উন্মুক্ত জগতে, অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দমবন্ধ পরিস্থিতিতে। তাদের রাজনৈতিক চেতনা শুধু স্থানীয় বাস্তবতায় গড়ে ওঠেনি; বৈশ্বিক সংগ্রাম থেকেও তারা শিক্ষা নিয়েছে। তাই বাংলাদেশের রাজপথে বা নেপালের স্কয়ারে শোনা গেছে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি।

তবে সমালোচকরা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী এবং দিশাহীন। বাংলাদেশে সরকার পতনের পরও রাষ্ট্রগঠন এবং গণতন্ত্র পুনর্গঠনের কঠিন কাজ এখনো বাকি রয়েছে। পুরোনো কাঠামোকে ভেঙে না দিয়ে সংস্কারের রূপকল্প নিয়ে দেশ পুনর্গঠন করতে গিয়ে সরকারকে দেশি এবং বিদেশি নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নেপালেও ওলির পদত্যাগের পর দেশটির ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী বিচারপতি ইন্টেরিয়াম সরকারের প্রধান হিসেবে তরুণদের আস্থার জায়গা কুড়িয়েছেন এবং তিনি দায়িত্ব নিয়েই দ্রুতই একটি নির্বাচনের পথে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবু প্রশ্ন থেকেই গেছে—তরুণরা কি নতুন রাজনৈতিক বিকল্প দাঁড় করাতে পারবে, নাকি পুরোনো অভিজাতরা আবার ফিরে আসবে? সমাজবিজ্ঞানী চার্লস টিলি যেমন বলেছেন, প্রতিটি আন্দোলন একদিকে মুক্তির উৎসব, অন্যদিকে অনিশ্চয়তার সূচনা।

তবু তরুণদের, বিশেষ করে ‘জেন-জি’ প্রজন্মকে সরল বা অপরিণত ভাবা ভুল হবে। তারা রাজনীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। তাদের কাছে গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন বা দল নয়; বরং মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং অফলাইন ও অনলাইনে সমানভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। তাদের কল্পিত সম্প্রদায় কোনো জাতীয় সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং আন্তঃদেশীয় সংহতির ভিত্তিতে গড়ে উঠছে। এই তরুণরা ইতিহাসকে নিছক বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সমষ্টি হিসেবে দেখছে না; বরং ইতিহাসের ভেতরে থাকা পারস্পরিক যোগসূত্রগুলো অনুধাবন করছে। আবার কেউ যদি ইতিহাসের বয়ানের আড়ালে অপরায়নের রাজনীতি চাপিয়ে দিতে চায়, সেখানেও তারা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলই দেখায়—তরুণদের মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর ঘটেছে আর তারা এখন সব ধরনের সন্ত্রাস ও অপরায়নের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস অর্জন করেছে।

এখানে ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রভাবও উপেক্ষা করা যাবে না। বাংলাদেশে আগের সরকার বহুদিন টিকে ছিল ভারতের কৌশলগত সমর্থনের কারণে, যেখানে দিল্লি স্থিতিশীলতাকে এবং কল্পিত নিরাপত্তার ধারণাকে গণতন্ত্রের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে। নেপালের আন্দোলনের সময় ভারতের ভূমিকা নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে। তাদের নীরবতাই প্রমাণ করেছে তারা এ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারেনি, উপেক্ষাও করতে পারেনি। তাই দক্ষিণ এশিয়ার গণআন্দোলনগুলো আঞ্চলিক শক্তির রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

ঢাকা ও কাঠমান্ডুর জেন জেড আন্দোলনগুলো শুধু প্রতিবাদ নয়, এগুলো ছিল নতুন পৃথিবী গড়ার মহড়া। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা আশার সম্প্রদায় তৈরি করেছে। অভিজ্ঞতা ও কৌশল শেয়ার করেছে আর যেসব কণ্ঠকে স্বৈরতন্ত্র স্তব্ধ করতে চেয়েছিল, সেগুলো আরো জোরালো করেছে। নজরদারি আর কর্তৃত্ববাদের যুগে তারা প্রমাণ করেছে তরুণরাই স্বাধীনতার সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষক। তরুণরা তাদের রাজনৈতিক কর্তাসত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছে।

অবশ্য ইতিহাস বলে, বিপ্লব কখনো সরল পথে এগোয় না। বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব বা নেপালের জেন জেড বিপ্লব হয়তো এখনো ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্ণ স্বপ্নপূরণ করতে পারেনি। কিন্তু তারা ইতোমধ্যেই এক গভীর বার্তা দিয়ে গেছে : গণতন্ত্র মৃত নয়, তরুণরা নীরব নয়। কর্তৃত্ববাদী সরকার নয়, বরং জনগণের সরকারকেই তারা ক্ষমতায় দেখতে চায়। ফলে, এই নতুন প্রজন্মের ভাষা ও তাদের প্রত্যাশা পূরণের রাজনীতিই হবে এ সময়ের রাজনীতিবিদদের আসল চ্যালেঞ্জ।

লেখক : শিক্ষক এবং গবেষক, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

sarefin@umass.edu

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা

মনের তালা এবং শরবতের মতো ভালোবাসা

মোদি-নেতানিয়াহুর মুসলিমবিদ্বেষী দোস্তি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি

শান্তির মুখোশে গাজায় টনি ব্লেয়ারের প্রত্যাবর্তন

মেধা পাচার রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিচ্ছে

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কে বেশি অসহায়

মুসলিম বিদ্বেষ ও ভারতের বিনোদন সংস্কৃতি

দুর্ঘটনা না নাশকতা

নেতৃত্ব নির্বাচনে সচেতনতার ঘাটতি

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল কী বার্তা দেয়