মন্তব্য প্রতিবেদন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি দেশের নাম ভারত এবং ইসরাইল। তবে দুই দেশের জনগণের ইসলামবিদ্বেষের মধ্যে চরিত্রগত কিছুটা তফাত রয়েছে। আমার আজকের লেখায় সেই পার্থক্যের ধরনটি বোঝার চেষ্টা করব।
ইসরাইলিদের ঘৃণার মূল টার্গেট যতটা না ইসলাম ধর্ম, তার চেয়ে বেশি ফিলিস্তিন এবং ভূখণ্ডটির জনগণ। তারা অধিকৃত ফিলিস্তিনের শুধু যে মুসলমানদের নিপীড়ন এবং হত্যা করে বিষয়টি সে রকম নয়, দেশটির স্বাধীনতাকামী খ্রিষ্টানরাও ইসরাইলি বর্বরতা থেকে নিস্তার পান না। ২০২২ সালে শিরিন আবু আকলেহ নামের আলজাজিরার দায়িত্বপালনরত এক সুবিখ্যাত সাংবাদিককে ইসরাইলের সেনারা স্নাইপারের গুলিতে রীতিমতো টার্গেট করে হত্যা করলে আন্তর্জাতিক মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। এই নারী সাংবাদিক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। তিনি খ্রিষ্টান ধর্মমতের পাশাপাশি মার্কিন নাগরিকও ছিলেন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিছিলে পর্যন্ত ইসরাইলি সেনারা গুলি চালিয়েছিল, লাশবহনকারী গাড়ি থেকে কফিন ফেলে দিয়েছিল, শোকের মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের নির্মমভাবে মেরে রক্তাক্ত করে গ্রেপ্তার করেছিল। যেহেতু শিরিন দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর বর্বরতা সারা বিশ্ব বিশ্বস্ততা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রচার করছিলেন, তাই মোসাদ এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাকে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিল।
শিরিনের ধর্ম কিংবা মার্কিন নাগরিকত্বের বিষয়টি উদ্ধত নেতানিয়াহু বিবেচনায় নেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি। একইভাবে গাজা যুদ্ধ চলাকালে সেখানকার চার্চে ট্যাংকের গোলা নিক্ষেপ করে আশ্রয় নেওয়া খ্রিষ্টান নারী-পুরুষদের হত্যা করতেও ইসরাইলি সেনারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলে ফিলিস্তিনের নাগরিক হলেই তারা হত্যাযোগ্য। অবশ্য চার্চে গোলাবর্ষণ করে খ্রিষ্টানদের হত্যার জন্য আমেরিকা ও ইউরোপের মৃদু প্রতিবাদ নেতানিয়াহুকে শুনতে হয়েছিল। এসব লোকদেখানো প্রতিবাদে মার্কিন অন্ধ মদতপুষ্ট জায়নিস্ট ইসরাইলের অবশ্য কিছু যায় আসে না। ইউরোপকে ইসরাইলি নেতারা কোনো ধরনের তোয়াক্কা করে না। অন্যদিকে মার্কিন জনমত গাজা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইলের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলেও সে দেশের রাজনীতিবিদরা এখনো ওয়াশিংটনের অত্যন্ত ধনবান এবং প্রভাবশালী ইহুদি লবির পকেটে। ফিলিস্তিন ছাড়া বিশ্বের বাদবাকি মুসলমানদের প্রতি ইসরাইলিদের মনোভাব যতটা না ঘৃণার, তার চেয়ে বেশি উপেক্ষার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের আরব ও খ্রিষ্টান অধিবাসীদের তাদেরই ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে যেহেতু ইউরোপ এবং আমেরিকার ইহুদি অভিবাসী সম্প্রদায় দখলকৃত ভূমিতে একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র (Settler Colonial State) বানিয়েছে, তাই দখলদার ইসরাইলিদের ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি উন্মত্ত ঘৃণার পেছনে তীব্র ধর্মবিদ্বেষ ছাড়াও কৃত্রিম রাষ্ট্রটি হারানোর ভয়ও সর্বদা কাজ করে। এ জন্যই পশ্চিমা বিশ্বের সব জায়নবাদী মিডিয়ায় ফিলিস্তিনের মানুষদের নিকৃষ্টতর মানুষ (Lesser Human) হিসেবে দেখানো হয়। ফক্স, স্কাই, সিএনএন, বিবিসিসহ এসব মিডিয়ার বয়ান অনুযায়ী, ‘নিকৃষ্টতর মানুষদের’ ওপর ‘উৎকৃষ্ট মানুষরা’ গণহত্যা চালালে তাকে অপরাধ বলা চলবে না। এদের নীতি অনেকটা জর্জ অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্ম (Animal Farm) বইয়ের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো— ‘All animals are equal, but some animals are more equal than others’। এ জন্যই ‘উৎকৃষ্ট মানুষদের’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কথায় কথায় গাজার জনগণকে ‘নিকৃষ্ট মানুষ’ বিবেচনা করে হত্যার হুমকি দিলেও কেউ তার প্রতিবাদ করে না।
এবার ভারতীয় কট্টর সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের মুসলমানবিদ্বেষের স্বরূপ খানিকটা বোঝার চেষ্টা করি। ভারতের হিন্দুদের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি যে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ বিস্তার লাভ করেছে, তার তীব্রতা ইসরাইলের ইহুদিদের তুলনায় আরো কট্টর ও হিংস্র। এর একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। প্রায় হাজার বছর মুসলমান শাসকদের অধীনে থাকার ফলে দেশটির আধুনিক, শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মধ্যে এক বিচিত্র হীনম্মন্যতা জন্ম নিয়েছে। এই অসুস্থ হীনম্মন্যতা বোধের ফলে দেশটির বর্তমান কালের হিন্দু জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু মুসলমানদের অতীতের মুসলমান শাসকদের উত্তরপুরুষ হিসেবে কল্পনা করে। তাদের কাছে একালের একজন হতদরিদ্র, বস্তিবাসী মুসলমানও অতীতের মুসলমান শাসকদের বংশধর, যাদের তারা ‘বাবর কি আওলাদ’ নামে সম্বোধন করে। অর্থাৎ, কট্টর হিন্দু মানসিকতায় মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের সন্তান হওয়াটা একটা গালি। এই কট্টর ও মূর্খ হিন্দুরা এটাও জানে না যে, মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার (১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ) আটশ বছর আগে মুসলমানরা সর্বপ্রথম এই মহাদেশে বিজয় লাভ করেছিল। ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধের হিন্দু রাজা দাহিরকে পরাজিত করে মুসলমানদের প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুসলমানদের হাতে দিল্লির পতনও হয়েছিল সম্রাট বাবরের দিল্লি বিজয়ের ৩৩৪ বছর আগে। আফগানিস্তানের সুলতান মুইজ-আল-দিন মুহাম্মদ ঘুরি ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে দিল্লির হিন্দু রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করেছিলেন।
ভারতের আবহাওয়া পছন্দ না হওয়ায় সুলতান ঘুরি তার তুর্কি সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে ভারতের শাসনভার অর্পণ করে আফগানিস্তানে নিজ জন্মস্থানে ফিরে গিয়েছিলেন। কেন যেন আজকের ভারতীয় কট্টর সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের যত আক্রোশ প্রধানত মোগলদের প্রতি। অথচ ইতিহাস বলে, মোগল শাসকরাই সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সেক্যুলার ছিলেন। ভারতীয়দের এই বিচিত্র মানসিকতার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। এটা একধরনের সমষ্টিগত মনোবিকার। ভারতীয় মুসলমানদের সংহার করার বিকৃত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আমরা একুশ শতকের ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে অহরহ দেখতে পাচ্ছি। ভারতীয় রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতারা যে অনবরত পাকিস্তানকে মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার হুমকি দেয় এবং বাংলাদেশকে অলিখিত উপনিবেশ বানিয়ে রাখতে চায়, এর পেছনে রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলমান শাসনাধীনে থাকার গ্লানি। আঞ্চলিক সর্ববৃহৎ দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এক ধরনের সমষ্টিগত পাগলামিতে (Collective Schizophrenia) আক্রান্ত হওয়ার ফলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতের কট্টর হিন্দু জনগোষ্ঠী নিজেদের বিশ্ববিজয়ী দেখার অবাস্তব স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘বিশ্বগুরু’ এবং ‘নররূপে দেবতা’ ভাবতে শুরু করেছে। এই সামষ্টিক বিভ্রম যে কতখানি বিস্তৃত হতে পারে, তার প্রমাণ, নরেন্দ্র মোদি নিজেও দাবি করেন যে, তিনি জীববিজ্ঞানের নিয়মে জন্মগ্রহণ করেননি, তিনি নাকি Non-biological ।
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া গুরুতর রূপ ধারণ করলে ভারতেও উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটেছে। এদের উগ্রতার উদাহরণ গাজায় দুই বছরব্যাপী ইসরাইলি গণহত্যার সময়ও দেখা গেছে। যখন ইসরাইলের অন্ধ সমর্থক খোদ মার্কিন মুলুকেও জনগণ গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে, হার্ভার্ড এবং কলম্বিয়ার মতো ‘আইভি লীগ’ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা দিনের পর দিন বিক্ষোভ করে ক্যাম্পাস অচল করে রেখেছে, পুরো ইউরোপ লাখ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে, সে সময় ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উগ্র হিন্দুরা গণহত্যাকে পূর্ণ সমর্থন জুগিয়েছে এবং নোংরা ভাষায় ফিলিস্তিনের মুসলমানদের গালাগাল করেছে। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর ২০২৩ সালের শেষার্ধে ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষী কনটেন্ট ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইসলামিক কাউন্সিল অব ভিক্টোরিয়া নামের অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, সারা বিশ্বে ‘এক্স’-এর মুসলমানবিরোধী অধিকাংশ টুইটের উৎপত্তিস্থল ভারত। যুদ্ধে ইসরাইলের জয়ের জন্য হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের বিভিন্ন শহরে পূজার আয়োজন করেছে। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা দিলে নরেন্দ্র মোদি অভিনন্দন জানিয়ে যে টুইট করেছেন, সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি নেতানিয়াহুর প্রশংসা করেছেন।
মোদি লিখেছেন—‘We welcome the release of all hostages after over two years of captivity. Their freedom stands as a tribute to the courage of their families, the unwavering peace efforts of President Trump and the strong resolve of Prime Minister Netanyahu. We support President Trump’s sincere efforts to bring peace to the region.’ (জিম্মিদের দুই বছরের বন্দিত্বের অবসান হওয়ায় স্বাগত জানাচ্ছি। তাদের এই মুক্তিতে সব জিম্মি পরিবারের বিরল সাহসিকতা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তির জন্য অবিচল প্রচেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অটুট সংকল্পের প্রতি সম্মান জানাই। আমরা ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি)।
লক্ষ করুন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর টুইটে গাজায় গণহত্যায় নিহত ৭০ হাজার শিশু নারী পুরুষ, ১ লাখ ৭০ হাজার পঙ্গু ও আহত এবং অনাহারে মৃতপ্রায় প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশার কোনো ধরনের উল্লেখ নেই। আসলে নরেন্দ্র মোদির মতো হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানদের মানুষ হিসেবেই কোনো অস্তিত্ব নেই। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ও ইসরাইলের ইহুদিবাদী জায়নিজমের মধ্যে আদর্শগত সাদৃশ্য ভারত এবং ইসরাইলকে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত করেছে। পিউ রিসার্চের এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ভারতীয় গাজায় ইসরাইলি গণহত্যাকে সমর্থন করে।
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর মোদির রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান খেলার সময় দর্শকরা মাঠে ইসরাইলের পতাকা ও ব্যানার নিয়ে দেশটির পক্ষে স্লোগান দিয়েছিল। দীর্ঘ দুই বছরের গাজায় গণহত্যাকালে ভারতের কোথাও ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো বিক্ষোভ হয়নি। দেশটির ১৫ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীও নিজেদের নিরাপত্তার আশঙ্কায় ফিলিস্তিনের সমর্থনে রাস্তায় নামতে পারেনি। তারা শুধু ভারতীয় পুলিশকেই ভয় করেননি, কট্টর হিন্দুদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকেও বাঁচতে চেয়েছেন। হিটলারের মতবাদের অনুরূপ এক ভয়ানক কট্টর জাতি-ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী (Ethno-religious nationalism) বর্বর ও সংকীর্ণ চিন্তাধারা ভারতে হিন্দুত্ববাদ এবং জায়নবাদের মিলন ঘটিয়েছে। ভূরাজনৈতিক যেকোনো বিষয়ে ইসরাইল এবং ভারত একসঙ্গে কাজ করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, গত মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চার দিনের সীমিত যুদ্ধের সময় সারা বিশ্বে একমাত্র ইসরাইল ভারতকে সমর্থন করে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছিল। ভারতের ঐতিহাসিক মিত্র রাশিয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সরাসরি বিরোধিতা করে কোনো কথা বলেনি। তারা শুধু যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিল।
এক দশক ধরে মোদি-নেতানিয়াহু জুটি আরব রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে ছয় জিসিসিভুক্ত দেশে (সৌদি আরব, আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইন) তাদের প্রভাব বিস্তারের যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে এই দেশগুলো জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ এবং সম্পদশালী হওয়ায়, আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে তাদের যথেষ্ট দাম রয়েছে। গাজা যুদ্ধের পূর্বপর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি এবং বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাদের প্রচেষ্টায় দৃশ্যমান সফলতাও অর্জন করেছিলেন। উল্লিখিত ছয় আরব দেশ উম্মাহর স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারত এবং ইসরাইলের প্রতি বেশ ঝুঁকে পড়তেও শুরু করেছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গত আমলে (২০১৬-২০২০) ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরাইলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে ঔপনিবেশিক ও দখলদার দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। শোনা যাচ্ছিল, সৌদি আরবও ইসরাইলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা শুরু না হলে হয়তো এতদিনে সৌদি আরবের সঙ্গেও ইসরাইলের আনুষ্ঠানিক সখ্য আমরা দেখতে পেতাম। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদিও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তার ট্রেডমার্ক ‘গলাগলি’ করার কূটনীতি (Politics of Hugging) নিয়ে জিসিসি দেশগুলোতে ঘনঘন সফর করেছেন। সেখানকার শাসকদের আলিঙ্গন করেছেন।
গুজরাটের কসাই নামে কুখ্যাত, নিজ দেশে মুসলমান হত্যাকারী মোদিকে আরব দেশের শেখ ও বাদশাহরা তাদের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান নিজেও ভারত সফর করে গেছেন। কিন্তু ‘অপারেশন সিন্দুরের’ ব্যর্থতায় মোদির আন্তর্জাতিক কূটনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতের কোনো দৃশ্যমান সফলতা আসেনি, ভূরাজনীতিতে দেশটি একঘরে হয়েছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মোদির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়েছেন। মার্কিন শুল্কের ভারে ভারতীয় অর্থনীতি এখন ধুঁকতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে ‘চিরশত্রু’ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসীম মুনির হোয়াইট হাউসে দাওয়াত খাচ্ছেন, পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ মিসরের শার্ম আল-শেখে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। অথচ বিশ্বগুরুর দাবিদার নরেন্দ্র মোদি আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট থেকে যেন হারিয়ে গেছেন। এখানেই ভারতের শিরঃপীড়া শেষ হয়নি। এই ডামাডোলের মধ্যে পাকিস্তান এবং সৌদি আরব এমন এক নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করেছে, যেখানে এক দেশ আক্রান্ত হলে অন্য দেশটিও আক্রান্ত বলে ধরে নেওয়া হবে। সুতরাং, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সৌদি আরবসহ সমগ্র আরব বিশ্বে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে দিল্লিকে বহুবার চিন্তা করতে হবে।
গাজা যুদ্ধ এবং অপারেশন সিন্দুর বিশ্ব ভূরাজনীতিতে কতটা পরিবর্তন এনেছে, তার সম্পূর্ণ চিত্রটি দেখার জন্য আমাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, দুই পরম বন্ধু মোদি এবং নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বেশ ঘোলাটে হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে তারা ইতোমধ্যে এক ধরনের অচ্ছুতে পরিণত হয়েছেন। বিশ্বনেতারা একে একে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। দেশের ভেতরেও ভারত ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর যে অজেয় এবং জনপ্রিয় ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, সেটিও ধসে পড়ার মুখে। তাদের রাজনৈতিক জীবনের এপিটাফ এখনো লেখার সময় হয়নি। তবে, আগামী নির্বাচনে উভয় নেতাই পরাজিত হলে আমি অবাক হব না।