হোম > মতামত

ফিনিক্স পাখির মতো আমার দেশ-এর নতুন উন্মেষ

জাহেদ চৌধুরী

ছাত্র-জনতার অভাবনীয় জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করে আমার দেশ আবার প্রকাশিত হয়েছে। গণমানুষের কণ্ঠস্বর এ পত্রিকাটি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার অন্যায়ভাবে বন্ধ করে রেখেছিল।

আমার দেশ এ দেশে সত্য সাংবাদিকতা করেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ এই পত্রিকা। সরকারের দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অপশাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে পত্রিকাটি সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে। পত্রিকার পাতায় পাতায় বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। ‘স্বাধীনতার কথা বলে’ পত্রিকাটির মূল স্লোগান। এজন্য ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধেও পত্রিকাটিকে লড়াই করতে হয়েছে।

আমার দেশ-এর লড়াই দুই দশকের। তিন দফায় কারাবরণকারী মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির সাড়া জাগানো রিপোর্ট আর আওয়ামী দুঃশাসন ও ভারতের আগ্রাসনবাদী নীতির বিরুদ্ধে দুরন্ত সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বারবার ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখে পড়ে আমার দেশ। হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার দু’দফায় বন্ধ করে দেয় পত্রিকাটি। তারও আগে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় কারারুদ্ধ মালিকদের পক্ষ থেকে লে-অফ করে বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বারবার ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভস্ম থেকে জেগে উঠেছে আমার দেশ। দুই দশকে পত্রিকাটি প্রায় এক যুগই আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু তাতে কী? একদল অদম্য সংবাদকর্মী আর মাহমুদুর রহমানের মতো অসীম সাহসী সম্পাদকের নেতৃত্বাধীন পত্রিকাকে ঠেকিয়ে রাখে কে? ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমার দেশকেও মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলার সুযোগ এনে দিয়েছে।

গত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার দুঃশাসনে অন্যতম টার্গেট ছিল আমার দেশ। আর এতে ইন্ধন দিয়েছে ভারত। কারণ শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি আর ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে আমার দেশ যে দুঃসাহসী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। আর এ কারণেই আওয়ামী হায়েনারা বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার দেশ সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ওপর। জ্বালিয়ে ছাইভস্ম করে দেয় অফিস। গায়ের জোরে তালাবদ্ধ করা হয় ছাপাখানা। পুলিশ প্রহরায় প্রেস তালাবদ্ধ রেখে লুটেরা আওয়ামী লীগ লুটে নেয় প্রেসের সব মালামাল। পেশিশক্তির উন্মত্ততার পাশাপাশি চলে সারাদেশে সিরিজ মামলা।

শুধু সত্য লেখার অপরাধে একজন সম্পাদকের প্রাণনাশের চেষ্টা, কারানির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা বিশ্বে নজিরবিহীন। আদালত অঙ্গনে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাচেষ্টায় রক্তাক্ত করা হয় মাহমুদুর রহমানকে। কেবল আমার দেশে চাকরি করার ‘অপরাধে’ এর সংবাদকর্মীদের সব যোগ্যতা থাকার পরও ফিরিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মিডিয়ার দুয়ার থেকে। সিনিয়র সাংবাদিকদের কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়। এক যুগ কোথাও চাকরি করতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী সরকার।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে আমার দেশ। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী মইন-ফখরুদ্দীনের শাসনে ২০০৮ সালে চরম ক্রান্তিকালে আমার দেশ-এর দায়িত্ব নেন অকুতোভয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম আঘাত হানে পত্রিকাটির ওপর।

হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দুর্নীতি নিয়ে তৎকালীন বিশেষ প্রতিনিধি এম আবদুল্লাহর আলোচিত রিপোর্টের জেরে হামলে পড়ে সম্পাদক, সাংবাদিক ও পত্রিকার ওপর। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও প্রতিবেদক এম আবদুল্লাহর গাড়িতে বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটে। সারাদেশে সিরিজ মামলা করানো হয় দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে।

কমান্ডো স্টাইলে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে ৩৯ দিন রিমান্ডে রেখে চলে নির্যাতন। আয়নাঘরে চলে হত্যাচেষ্টা। বন্ধ করা হয় পত্রিকার প্রকাশনা। পত্রিকাটি যাতে কোনোভাবেই প্রকাশিত না হয়, সেজন্য বর্তমান নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, প্রধান সহকারী সম্পাদক প্রয়াত সঞ্জিব চৌধুরী, ক্রাইম রিপোর্টার আলাউদ্দিন আরিফ, সাইফুল ইসলামসহ ছয়জন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা হিসেবে ৪০০ সাংবাদিকের নামে ঢালাও মামলা দেওয়া হয়। অভিযোগ আনা হয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারে পুলিশকে বাধা দেওয়ার। মাহমুদুর রহমানকে আটকের পর আইনগতভাবে তাকে যখন জেলে আটকে রাখা যাচ্ছিল না, তখন বিচার বিভাগ নিয়ে সম্পাদকের একটি মন্তব্য প্রতিবেদন ও ‘চেম্বার মানে সরকার পক্ষে স্টে’-এ প্রতিবেদনের জন্য আপিল বিভাগের সুয়োমটো রুল ও রায়ে সাত মাস জেলে আটকে রাখা হয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। একই মামলায় সিনিয়র সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকেও এক মাস কারাবরণ করতে হয়।

সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রথম দফায় ৯ মাস জেল খেটে আইনি লড়াইয়ে মুক্ত হওয়ার পর ২০১১ সালে তার নেতৃত্বে ফের পাঠক সমাদৃত হয় আমার দেশ। কিন্তু থামেনি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন।

২০১৩ সাল। শাহবাগে তখন চেতনার মাতম আর চরম উন্মাদনা। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আমার দেশ আলোচিত সেই ব্যানার হেডিং করে ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। অল্পদিনের মধ্যেই আমার দেশে সাড়া জাগানো স্কাইপ কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ধারাবাহিকভাবে। অলিউল্লাহ নোমানের লেখা সেই প্রতিবেদনে তোলপাড় শুরু হয় দেশ-বিদেশে। উন্মোচিত হয় জুডিশিয়াল কিলিংয়ের নীলনকশা। এতে আওয়ামী সরকার বেসামাল হয়ে আবার হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশ ছেড়ে লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচান সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান।

সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে প্রথমে কয়েক মাস বন্দি করে রাখা হয় পত্রিকা অফিসে। ২০১৩ সালের এপ্রিলের ১১ তারিখে পুলিশের পোশাকধারী ক্যাডাররা ভোররাতে আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে মাহমুদুর রহমানকে তুলে নিয়ে যায় কমান্ডো কায়দায়। এবার আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে প্রেসে তালা লাগিয়ে দ্বিতীয় দফায় আমার দেশ প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে প্রায় ১২ বছর আলোর মুখ দেখেনি পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা সংবাদপত্র আমার দেশ।

দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে দীর্ঘসময় নির্যাতন ও সাড়ে তিন বছর দুঃসহ জেল জীবন কাটিয়ে ২০১৬ সালে আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হন মাহমুদুর রহমান। কিন্তু হুমকির মুখে পড়ে তার জীবন। কুষ্টিয়ার আদালতে জামিন চাইতে গেলে চেষ্টা করা হয় প্রাণনাশের।

রক্তাক্ত অবস্থায় দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দেন- স্বাধীনতার জন্যে প্রয়োজনে একাই জীবন দেবেন, তবুও দিল্লির দাসদের কাছে নতিস্বীকার করবেন না।

এতে করে ভারতের মদতে শেখ হাসিনার হয়রানি ও নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। রাতের পর রাত বাসায় পুলিশি হানা ও হয়রানি চলতে থাকে। চলে জীবননাশের নানা চেষ্টা। এমন অবস্থায় অসুস্থ মাহমুদুর রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গেলে আর ফিরে আসতে পারেননি। প্রথমে মালয়েশিয়ায় এবং পরে তুরস্কে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় তাকে।

ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় জুলাই বিপ্লবে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে টানা ছয় বছর নির্বাসিত জীবন শেষে মুক্ত স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন মাহমুদুর রহমান। শেখ হাসিনার দেওয়া ১২৪ মামলা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আইনকে সম্মান দেখিয়ে আদালতে হাজির হয়ে জেলে যান তিনি।

জেল থেকে মুক্তি পেয়েই জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ঘোষণা দেন নতুন করে আমার দেশ পত্রিকা চালুর।

মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশ আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দিলেও সেখানে লোহার স্ক্র্যাপ ও কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। আওয়ামী দুর্বৃত্তরা লুটে নিয়ে যায় সব মালামাল।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন করে আবার ডানা মেলেছে আমার দেশ। এক যুগ পর ২২ ডিসেম্বর ড. মাহমুদুর রহমানের সম্পাদনায় ‘স্বাধীনতার কথা বলে’ স্লোগান নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হয়েছে আমার দেশ। নব উদ্দীপনায় নতুন করে স্বপ্ন বুনছে আমার দেশের মজলুম কর্মী বাহিনী। একঝাঁক দুরন্ত সাহসী সংবাদকর্মী আবারও কর্মমুখর। এ কর্মী বাহিনীর হাত দিয়েই মাহমুদুর রহমানের ‘আমার দেশ’ আবার ফিরে এসেছে পাঠকের হাতে।

লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, আমার দেশ

AD/ZM

কপ-৩০ সম্মেলন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বন্দর ব্যবস্থাপনা : ভারতের বয়ানে সমালোচনা

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ফ্রন্ট মধ্য এশিয়া

জুলাই বিপ্লবের উচ্ছ্বাস ও সামনের কঠিন বাস্তবতা

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে কিছু প্রস্তাব

চক্রের ফাঁদে পড়েছে চীন আর ভারত

আসল বাউল নকল বাউল

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শঙ্কা

মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি লবির প্রভাব

ভারত কেন শেখ হাসিনাকে রাখতে চায়?