কোয়াড নিয়ে ট্রাম্পের অনাগ্রহ
শুল্ক নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে চলছে টানাপড়েন। সম্ভব হয়নি দু’পক্ষের কোনো বাণিজ্যচুক্তি। চলমান পরিস্থিতিতে কোয়াডের বৈঠক এড়িয়ে যেতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাই শিগগিরই ‘কোয়াডের অপমৃত্যু’ ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগে রয়েছে ভারত।
কোয়াড অর্থাৎ ‘কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ অথবা চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপ। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এই জোটের সদস্যপদ রয়েছে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার। চলতি বছরের নভেম্বরে নয়াদিল্লিতে এর রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। ওয়াশিংটনের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস’ জানিয়েছে, এ বারের কোয়াডের বৈঠকে ট্রাম্প যোগ দেবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
২০০৭ সালে কোয়াডের জন্ম হলেও মাত্র এক বছরের মধ্যেই প্রায় অচল হয়ে পড়ে এর কার্যক্রম। প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ফের একে পুনরুজ্জীবিত করেন ট্রাম্প। সেটা ছিল ২০১৭ সাল। পরবর্তী আট বছরে ধীরে ধীরে সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নিয়ে এগোয় এই চতুঃশক্তি জোট। কিন্তু দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প এই প্রক্রিয়ায় আগ্রহ হারিয়েছেন তা স্পষ্ট।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা কোয়াড নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ হারানোর নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তাদের দাবি, দীর্ঘ দিন ধরেই এই গোষ্ঠীটিকে একটি সামরিক জোট হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত বিবাদকে কেন্দ্র করে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে আরো কঠোর হতে বলেছে ওয়াশিংটন। অন্য দকে বেইজিংয়ের সঙ্গে সংঘাত দ্বিপক্ষীয়ভাবে মিটিয়ে নিতে বেশি আগ্রহী ভারত।
কোয়াডের মূল উদ্দেশ্য হল ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের নিয়ন্ত্রণ কমানো। সূত্রের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার বলছে, নয়াদিল্লিকে সঙ্গে নিয়ে সেই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব নয় বলে মনে করছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্প চাইছেন, কোয়াডকে শক্তিশালী করতে শুধুমাত্র ওয়াশিংটনের থেকে অস্ত্র কিনবে ভারত। এ ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে মোদী সরকারের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে তার।
ভারতের পণ্যে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে রেখেছেন ট্রাম্প। পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে সামান্য চিড় ধরেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে কোয়াড-ধ্বংসের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
চতুঃশক্তি জোটে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া থাকলেও ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এর মূল ভরকেন্দ্র বলা যেতে পারে। সংবাদসংস্থা ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের জেরে কোয়াডে অদলবদল চাইছে ওয়াশিংটন। সেখানে ভারতকে বাদ দিয়ে ফিলিপিন্সকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র।
গত ১ নভেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ফিলিপিন্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। ২০২৫ সালে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে এই ধরনের আলোচনা করলেন তিনি।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই বৈঠকের পরেই কোয়াডে সদস্য পরিবর্তনের ব্যাপারে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের দাবি, ফিলিপিন্সকে এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে একটি সেনাঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াশিংটনের।
তবে কোয়াডে সদস্য পরিবর্তন হলে চীনকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারতের মতো পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের সমর্থন হারাবে ওয়াশিংটন। সে ক্ষেত্রে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার যাবতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব গিয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে। আর তাই সংশ্লিষ্ট চতুঃশক্তি জোটটির সম্প্রসারণ চাইছে ট্রাম্প প্রশাসনের একাংশ, খবর সূত্রের। ফলে কোয়াডে ফিলিপিন্সের অন্তর্ভুক্তি সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, যুক্তরাষ্ট্র জানে কোয়াডের সম্প্রসারণে ফিলিপিন্সের অন্তর্ভুক্তি হলে কোনো আপত্তি করবে না ভারত। কারণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক ভাল।
মার্কিন বিশ্লেষকদের অপর অংশের দাবি, কোয়াডকে রেখেই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আর একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি থাকবে ফিলিপিন্স। কোয়াড ছাড়াও এই অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আরো একটি জোট সক্রিয় রয়েছে। তার নাম ‘অকাস’। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এর সদস্যপদ পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া এবং গ্রেট ব্রিটেন (পড়ুন ইউনাইটেড কিংডম)।
কুয়ালালামপুরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ফিলিপিন্স। আগামী বছর ‘বালিকাতান-২০২৬’ যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করবে ম্যানিলা। সেখানে বাকি সদস্য দেশগুলোর সেনাবাহিনীকে অংশ নিতে দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্পের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য পিট হেগসেথ।
‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস’ জানিয়েছে, কোয়াড সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে চীনকে ঘিরে ফেলতে চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। চতুঃশক্তি জোটকে কলেবরে বাড়িয়ে মান্দারিনভাষীদের ওপর ভূ-রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে চাইছেন ট্রাম্প।
নভেম্বরের গোড়ায় জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ফিলিপিন্সের পাশাপাশি কুয়ালালামপুরে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। এর পর ১০ বছরের জন্য একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করেন তারা। সেখানে নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটনের যৌথ উদ্যোগে অস্ত্র তৈরির কথাও বলা রয়েছে।
তবে কোয়াডের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো পুরোপুরি হতাশ নন বিশ্লেষকদের একাংশ। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তখন ফের এক টেবলে চতুঃশক্তি জোটের নেতাদের বসতে দেখা যায় কি না, তার উত্তর দেবে সময়।
সূত্র: আনন্দবাজার