বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে গঠিত অনুসন্ধান এবং তদন্ত কমিটিগুলো ১৪ মাসেও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কমিটি জানিয়েছে, সুপারিশসহ তাদের প্রতিবেদন আগামী বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জমা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন, বণ্টন, আমদানি ও বিল পরিশোধ সংক্রান্ত সব নথি চেয়েও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে আদানির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নিলেও জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে এখনো সায় মেলেনি।
আইনজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টদের অভিমত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বড় দুর্নীতিবাজরা এখনো বিচারের বাইরে। তাদের মতে, এসব রাঘব বোয়াল গত সাড়ে ১৫ বছরে অন্তত এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, যার একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। লুটেরাদের একজন সামিটের আজিজ খান সিঙ্গাপুরের ‘অন্যতম শীর্ষ ধনী’র তকমাও পেয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারা অন্তর্বর্তী সরকারের বড় ব্যর্থতা।
তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, সরকার ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হলেও জাতীয় কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ না মেলায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্যদের দাবি, বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এ খাতে যে পরিমাণ দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে, তার হিসাব করা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বিচারপতি মইনুল কমিটির শম্বুকগতি
গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনায় একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটিকে যেকোনো সূত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় যেকোনো নথি নিরীক্ষা করা, সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তি বা
প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে তলব করা এবং বিশেষ আইনের (ইনডেমনিটি) আওতায় করা চুক্তিগুলোতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে কি না, তা নিরীক্ষা করার পূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑবুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
বারবার তাগাদা সত্ত্বেও কমিটি গত ২ নভেম্বর কেবল একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি কমিটির আহ্বায়ক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। তবে তিনি জানিয়েছেন, প্রাথমিক পর্যায়ের পর্যালোচনাতেই ‘ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ’ পাওয়া গেছে। তার ভাষায়, বিদ্যুৎ খাতের সব চুক্তিই অত্যন্ত কারিগরি প্রকৃতির। তাই যাচাই-পর্যালোচনায় সময় লাগছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হবে।
চুক্তি পর্যালোচনায় কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছেÑএমন প্রশ্নে একজন সদস্য আমার দেশকে বলেন, আমরা শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই-বাছাই করে দেখছি। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের তথ্য ও প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এছাড়াও এ খাতের দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পাদকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউসের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছি।
কমিটির অপর সদস্য জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তির সব নথি নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গত সাড়ে ১৫ বছরে এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ব্যক্তিগত নথিও সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০০৯-এর জানুয়ারি থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্টের আগে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, পাওয়ার পারসেজ অ্যাগ্রিমেন্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্টসহ (পিপিএ) সম্পাদিত সব চুক্তি, চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমোদন ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুকূলে পরিশোধকৃত বিল এবং বকেয়া বিল-সংক্রান্ত তথ্যসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র নেওয়া হয়েছে। অন্য তথ্য-উপাত্তসহ এগুলো সব পর্যালোচনা, মূল্যায়ন, পরীবিক্ষণ সম্পন্ন করে রিপোর্ট তৈরি করতে একটু সময় লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
অপর এক সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাড়ে চারগুণ বেড়েছে। কিন্তু ব্যয় বেড়েছে ১১ গুণের বেশি। এসব ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে সংঘবদ্ধ দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। যারা টাকা পাচার করেছে, তাদের বোঝাতে হবেÑদুর্নীতি ও অর্থ পাচার করে পার পাওয়া যাবে না।
রিপোর্ট দিতে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাড়াহুড়া করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। এটা বাতিল করতে চাইলেও বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।
আদানির চুক্তিতে দুর্নীতির প্রমাণ
বিচারপতি মইনুল হোসেন চৌধুরীর কমিটি ভারতের আদানির সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে একটি পৃথক প্রতিবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে জমা দিয়েছে। এতে আদানি এবং আওয়ামী লীগ সরকার আমলের কিছু রাজনৈতিক নেতা ও আমলার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, চুক্তিটি সম্পূর্ণ অসমভাবে করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রীয় পক্ষ ভারতের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমন ধারা-শর্তে চুক্তি করেছে, যেগুলো দেশের জন্য ‘আত্মঘাতী’। তিনি বলেন, চুক্তিটি বাতিল করতে হলে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। তবে আমরা আদালতে যাব কি না, তা নির্ভর করছে জয়ের সম্ভাবনার ওপর। আইনগতভাবে যদি ৮০ শতাংশ জেতার সম্ভাবনা দেখি, তাহলেই সরকারকে সে পরামর্শ দেব। তদন্তের স্বার্থে আপাতত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
‘ইনডেমনিটি আইন’ বাতিলের সুফল মিলছে না
আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিতে শেখ হাসিনার সরকার ২০১০ সালে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ করে, যা পরবর্তীতে ‘বিদ্যুৎ খাতের ইনডেমনিটি আইন’ নামে পরিচিতি পায়। এ আইনে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে নেওয়া যে কোনো পদক্ষেপ বা নির্দেশনার বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আইনের এমন বিধানের সমালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইনটি শুধু সংবিধানবিরোধীই নয়, মানবতার বিরুদ্ধে এক জঘন্যতম অপরাধও। এ আইনের বলে বিগত সরকার ও আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ এই আইন জারির পরপরই পিডিবি তিন বছরমেয়াদি ১৭টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পরে আরো কয়েকটি পাঁচ বছরমেয়াদি রেন্টাল কেন্দ্র অনুমোদন দেয়। বর্তমানে ১৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৬২টি সরকারি ও ৮১টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট হলেও সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট।
গত বছরের ১৮ আগস্ট হাইকোর্ট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ইনডেমনিটি আইন স্থগিত করে সরকারের প্রতি রুল জারি করে। রুলের শুনানি শেষে ১৪ নভেম্বর আইনের দুটি বিধান অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে পূর্ণাঙ্গ রায় দেয় হাইকোর্ট। সরকার ৩০ নভেম্বর পুরো আইনটি বাতিল করে অধ্যাদেশ জারি করলেও গত ১৫ মাসেও দৃশ্যমান কোনো সুফল মেলেনি। আইন ও প্রথা ভেঙে প্রতিযোগিতাবিহীন প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
সোয়া লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে গত ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ আমলে এ খাতে লুটপাট হয়েছে অন্তত এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ দুর্নীতি মূলত হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কমিশন এবং কেন্দ্র ভাড়া ও অতিরিক্ত মুনাফাÑএই তিনটি খাতে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ওই সময়ে জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে কমপক্ষে তিন বিলিয়ন ডলার সরাসরি লুট হয়েছে। শুধু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ লুট হয়েছে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ভারতের আদানির ঝাড়খণ্ড প্লান্ট থেকে উচ্চমূল্যে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিও ‘গোপনে’ সম্পন্ন করা হয়।
দুর্নীতির পরিসংখ্যানচিত্র তুলে ধরে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আমার দেশকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে মোট খরচ করা হয়েছে দুই হাজার ৮৩০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হারে প্রায় তিন লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লুট হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এক হাজার ৫০৭ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩-এ ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অর্থ লুটের বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, সামিট গ্রুপ ১০ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল সাত হাজার ৯৩২ কোটি টাকা, আল্ট্রা পাওয়ার হোল্ডিংস নিয়েছে সাত হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, ইউনাইটেড গ্রুপ ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, আরপিসিএল পাঁচ হাজার ১১৭ কোটি টাকা নিয়েছে। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা।
২০১৩ সালে প্রকাশিত ফোর্বসের সিঙ্গাপুরের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় সামিট গ্রুপ চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান ৪১তম স্থানে উঠে আসেন, যার সম্পদের পরিমাণ ছিল এক দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, শেখ হাসিনার আমলে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিল সামিট গ্রুপ।
রাঘব বোয়ালরা অধরা
খুনি হাসিনার পতন ও পলায়নের পর প্রায় ১৫ মাস পার হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের রাঘব বোয়ালরা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে কেনÑএমন প্রশ্ন ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব ও এ খাতের বিশেষজ্ঞদের কাছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সঙ্গে বিগত সরকারের সময় যতগুলো চু্ক্তি হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতে দেশের স্বার্থকে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের কেনাকাটা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে এখনো নসরুল হামিদ সিন্ডিকেটই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে। নতুন কাউকে এ ক্ষেত্রে যুক্ত করতে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ বিঘ্ন হতে পারেÑএমন আশঙ্কায় সরকারও ভিন্ন পদক্ষেপ নিতে ভয় পাচ্ছে। এ সুযোগে বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতিবাজ ও রাঘব বোয়ালরা সবাই বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এটিকে সরকারের বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। আমার দেশকে তিনি বলেন, বিগত সরকার বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে অর্থ লুটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিল। মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদ, দেশি-বিদেশি অনেক সুবিধাভোগী এবং ওই সরকারের ঘনিষ্ঠরা এ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত। সরকার বদলেছে, কিন্তু আমলাতন্ত্র থেকে গেছে আগের মতোই। তাদের সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। তিনি আরো জানান, তারা বহু নথিপত্র সরাসরি সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে; কিন্তু সরকার এখনো পর্যন্ত একটি মামলা বা অভিযোগও আনতে পারেনি। এটাকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় আটকে গেছে দুদকের উদ্যোগ
১৫৬ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতির ১৭২টি নথি তলব করেছে দুদক। কমিশন বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি অনুসন্ধানে পাঁচ কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করেছে। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক আক্তারুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে, তার বেশিরভাগই বেসরকারি মালিকানাধীন। এসব কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ঘুস, স্বজনপ্রীতি, জমি দখল, ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে ঋণ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। চুক্তিপত্র, অনুমোদন-সংক্রান্ত নথি, বিল পরিশোধ ও বকেয়া-সংক্রান্ত কাগজপত্রও চাওয়া হয়েছে। তবে দুদকের আরেক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত শুরু তো অনেক দূরের কথা, এখনো সব নথিই হাতে আসেনি।
দুদকের কর্মকর্তারা এর জন্য আমলাতন্ত্রের দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেছেন। দুদক থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে নথি চাইলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে দিতে দেরি করছেন। কেউ কেউ জাতীয় কমিটির কথাও বলছেন।
বিদ্যুৎ খাতে গত সরকারের আমলের সাড়ে ১৫ বছরের নথিপত্র চেয়েও না পাওয়া এবং এ খাতের দুর্নীতি রোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অসহযোগিতা নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। এ খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ আরো বাড়াব। এ জন্য আমরা তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলারও উদ্যোগ নিয়েছি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম অবশ্য এ ব্যাপারে দাবি করেন, দুদক যা চাইছে, তারা ‘যথাসময়েই’ দিচ্ছেন।
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা সুশাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। আমার দেশকে তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ খাতের লুটপাট দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। তিনি বলেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হতো।
সরকারের ব্যর্থতা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
এদিকে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ব্যাপক অনিয়ম আর সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে—এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ আইন বাতিল হয়েছে ঠিকই; কিন্তু সরকারের মধ্যে যথেষ্ট সাহস ও সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তারা শঙ্কা করছেন, বড় পদক্ষেপ নিলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে সংকট বাড়তে পারে, জনঅসন্তোষ তৈরি হতে পারে। তবে তিনি মনে করেন, ক্যাপাসিটি চার্জ ও প্রকল্প দুর্নীতির বিপুল অঙ্কের টাকা লুট হওয়ার প্রমাণ থাকলেও অন্তত জরিমানা করা যেত।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিগত সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে যে বিশাল আকারে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে তা বর্তমান সরকারের সময়ে এসেও রোধ হয়নি। এটি অবশ্যই সরকারের জন্য বড় ব্যর্থতা। কেননা বিগত সরকারের আমলের দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে, আমরাও অনেক নথিপত্র দিয়েছি। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেÑএমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনার আমলে বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি সর্বজনবিদিত। এক্ষেত্রে শত শত রাঘব বোয়াল রয়েছে, যাদের বিচার হওয়া জরুরি বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের অপেক্ষায় সরকার
১৫ মাসেও বড় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার প্রশ্নে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাউজুল কবির খান আমার দেশকে জানান, দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মধ্যেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব নথি তাদের হাতে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যারা কমিটিতে আছেন, তাদের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
তিনি জানান, কমিটি ইতোমধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যা সরকার পর্যালোচনা করছে। তবে সিদ্ধান্তের আগে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টই চূড়ান্ত বিবেচ্য।
আদানি চুক্তি প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, আদানি চুক্তিতে অনিয়ম পাওয়া গেলে বাতিল করতে দ্বিধা নেই। কারণ দেখিয়ে বা কারণ ছাড়াই চুক্তি বাতিল করা যায়, তবে ক্ষতিপূরণের ধারা রয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিল সহজ হবে। কিন্তু মুখের কথায় আদালত মানবে না; সুনির্দিষ্ট প্রমাণ লাগবে।
আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে দুদকের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অভিযুক্তদের অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তেমন সুযোগ।