গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফসলের ক্ষতি বাঁচাতে চড়ুই পাখি নিধনের এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চীন। লাখ লাখ পাখি মারার পর দেখা গেল উল্টো চিত্র—প্রাকৃতিক প্রহরী না থাকায় পোকামাকড়ের অবাধ আক্রমণে উজাড় হয়ে গেল সব ফসল, নেমে এল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সেই ঐতিহাসিক ভুলেরই যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ আজ মঞ্চস্থ হচ্ছে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। ফসল রক্ষার অজুহাতে এখানেও চলছে প্রকৃতির বন্ধু পাখিদের নির্বিচার গণহত্যা।
সন্দ্বীপের সন্তোষপুর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন একটি বরই গাছে নিথর হয়ে পড়ে আছে কয়েকটি পাখির ডিম। যে মা পাখিটি ডিমে তা দিয়ে নতুন প্রাণের অপেক্ষায় ছিল, সে এখন পাশের ক্ষীরাখেতের উপর টাঙানো জালে ঝুলে থাকা একখণ্ড নিষ্প্রাণ দেহ। কৃষকের দৃষ্টিতে সে ছিল ফসলের শত্রু।
সন্দ্বীপের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠগুলোতে এখন সবুজের ওপর দেখা যায় এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কুয়াশা, কিন্তু কাছে গেলেই গা শিউরে ওঠে। ওগুলো আসলে কৃষকের পাতা অতি সূক্ষ্ম কারেন্ট জাল। সকাল-সন্ধ্যা খাবারের খোঁজে নিচে নামলেই এই অদৃশ্য মরণফাঁদে আটকে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। ফসলের ক্ষেতগুলো পরিণত হয়েছে পাখিদের বধ্যভূমিতে।
ভোরের আলো ফুটতেই পাখির কিচিরমিচিরে যে জনপদ মুখর হওয়ার কথা, সেখানে এখন শুধুই মৃত্যুর নীরবতা। স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল আনোয়ার প্রায়ই এই নির্মম দৃশ্য দেখেন। তিনি বলেন, সেদিন সকালেও জালের সুতায় পেঁচিয়ে যাওয়া একটি ছটফটরত বুলবুলি পাখিকে দেখতে পাই। অনেক কসরত করে জালের বাঁধন কেটে পাখিটিকে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সবার ভাগ্য তো আর সুপ্রসন্ন হয় না। নুরুল আনোয়ার আক্ষেপ করে বলেন, একটাকে বাঁচাতে গিয়ে দেখি পাশেই আরেকটা মরে শক্ত হয়ে আছে। সাদা সুতার জালে রক্ত মেখে ঝুলে আছে নিষ্পাপ প্রাণগুলো। কোনোটা সদ্য মারা গেছে, কোনোটা আবার রোদে শুকিয়ে মমি হয়ে ঝুলে আছে।
কেন প্রকৃতির এই সুন্দর সন্তানদের হত্যা করা হচ্ছে? কৃষকদের দাবি, ফসল বাঁচাতেই তাদের এই কঠোর অবস্থান। সন্তোষপুর এলাকার কৃষক মো. মহব্বতের ক্ষীরাখেতে গিয়ে দেখা যায় এক মর্মান্তিক দৃশ্য। জালের গায়ে মরে শুকিয়ে আছে একটি ফিঙে পাখি। অন্য পাখিদের ভয় দেখাতে ইচ্ছা করেই তিনি মরা পাখিটি সরাননি।
এই নির্মমতার বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষক মহব্বত বলেন, ভাবলাম, যত বুলবুলি মরবে, তত আমার ফসলের শত্রু কমবে। অথচ কৃষিবিজ্ঞান বলে ভিন্ন কথা। ফিঙে বা বুলবুলি ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে উল্টো কৃষকের উপকারই করে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে কৃষকরা বন্ধুকেই শত্রু ভেবে হত্যা করছেন। একসময় এই চরাঞ্চল ঘুঘু, বাবুই, মাছরাঙা, টিয়া আর হরেক রকমের পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত। স্থানীয়রা বলছেন, এখন আর আগের মতো পাখির ডাক শোনা যায় না। কেবল পাখি নয়, এই সর্বনাশা জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে গুইসাপ ও বেজির মতো প্রাণীও।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা মারুফ হোসেন আমার দেশকে বলেন, আমরা কৃষকদের জালের বদলে ড্রাম বাজানো বা অন্য পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি।
উপজেলা বন রক্ষক কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, পাখি নিধন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, শীঘ্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।