প্রায় আট মাস পর বরগুনার আশারচর, নিদ্রারচরসহ উপকূলের শুঁটকিপল্লীগুলোতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। হাজারো ব্যবসায়ী, জেলে আর শ্রমিকের পদচারণায় এখন মুখর এ অঞ্চল। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে পুরোদমে কাজে নেমে পড়েছেন জেলেরা। সারাদিন শুঁটকি শুকাতে ব্যস্ত নারী-পুরুষ, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের শ্রমিক।
প্রাকৃতিক ও বিষমুক্ত উপায়ে মাছ শুকিয়ে এখান থেকেই তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে এ শিল্পকে আরো উন্নত করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করছেন। তবে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোসহ নানাবিধ সমস্যায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি। কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে শুঁটকি মৌসুম। তবে, এজন্য তাদের অক্টোবর মাস থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জেলে ও শ্রমিকরা আসেন বরগুনার তালতলী উপজেলার আশারচর, নিদ্রারচরসহ উপকূলের বিভিন্ন শুঁটকিপল্লীগুলোতে। মৌসুম জুড়ে শ্রমিকরা শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর তারা কোনো ধরনের রাসায়নিক বা অতিরিক্ত লবণ ছাড়াই শুঁটকি উৎপাদনের চেষ্টা করছেন। যেটা অধিক স্বাস্থ্যসম্মত এবং চাহিদাসম্পন্ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মিঠা পানির দেশি মাছের শুঁটকিপল্লী হিসেবে পরিচিত বরগুনার তালতলী উপজেলার আশারচর ও নিদ্রারচর। এসব পল্লীতে এ মৌসুমে কাজ করছেন সহস্রাধিক জেলে ও শ্রমিক। প্রতিদিন নানা প্রজাতির মাছ শুকানো হচ্ছে।
আশারচর ও নিদ্রারচর শুঁটকিপল্লী থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০০ মণ শুঁটকি রপ্তানি হয়। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকারিভাবে শুঁটকি রপ্তানি করা হলে তারা বেশি লাভবান হবেন।
বরগুনার তালতলীর শুঁটকিপল্লীতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলে, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ মিলে সহস্রাধিক মানুষ কাজ করছেন। শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই হচ্ছে নারী ও শিশু। সেখানে প্রায় ৫০টি ছোট ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে। পল্লীতে কেউ মাছ মাচায় রাখছেন, কেউ মাচায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউবা শুকনো মাছ কুরিয়ে জমা করছেন।
সূত্র জানায়, আশারচর, নিদ্রারচর, সোনাকাটা, ফকিরহাট, জয়ালভাঙাসহ দেশের পুরো উপকূলে প্রায় পাঁচ মাস সরব থাকেন ক্রেতা, বিক্রেতা ও শ্রমিকরা। এসব এলাকার প্রায় শতাধিক শুঁটকিপল্লী রয়েছে। নদী থেকে কাঁচা মাছ শুঁটকিপল্লীতে নিয়ে আসার পর নারী ও শিশু শ্রমিকরা তা পরিষ্কার করেন। এরপর মাছগুলো ধুয়ে মাচায় ও চরে মাদুর পেতে শুকানো হয়। তিন-চার দিনের রোদে মাছগুলো শুকিয়ে শক্ত করা হয়।
নদী থেকে চিংড়ি, লইট্টাসহ বিভিন্ন জাতের মাছ একসঙ্গে কিনতে হয়। প্রকার ভেদে মাছের দাম কেজিপ্রতি ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এখানকার শুঁটকিতে কোনো ধরনের বিষ-কীটনাশক ছাড়াই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করা হয়। এ এলাকার শুঁটকির বিশেষ চাহিদা থাকায় এখান থেকে শুঁটকি চলে যায় চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, খুলনা ও জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া, কিছু শুঁটকি বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।
আশারচর শুঁটকিপল্লীর শ্রমিক হানিফ আমার দেশকে বলেন, নদীতে মাছ ধরা পড়ায় এ বছর শুঁটকি উৎপাদন ভালো হচ্ছে। তাছাড়া, এ বছর কাঁচা মাছের চাহিদাও বেশি। দাম কম থাকায় শুঁটকিতে লাভ ভালো হবে বলে আশা করছি। তবে, ব্যবসা এখন আগের মতো নেই। সরকারিভাবে দেশে-বিদেশে এ শুঁটকি রপ্তানি হলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে।
শুঁটকি ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, এখানে শুঁটকি শুকানো শুরু করেছি। সাগর পাড়ে শুঁটকি খুব ভালো শুকায়। তাই বাধ্য হয়ে এখানে টং পেতেছি। স্থায়ী জায়গা নির্ধারণ করলে বছরের বারো মাস এ ব্যবসা করতে পারতাম।
এখানকার শুঁটকি ব্যবসায়ী ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জান গেছে, প্রায় ২৫ থেকে ৩০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয় এখানে। এর মধ্যে, রূপচাঁদা, ছুরি, তপসে, কোরাল, সুরমা, লইট্টা, ফেসা অন্যতম। এছাড়া, চিংড়ি, ভোল, মেদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছেরও রয়েছে প্রচুর চাহিদা। বর্তমানে প্রতি কেজি ছুরি মাছের শুঁটকি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, রূপচাঁদা এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা, লইট্টা ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা, চিংড়ি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং অন্যান্য ছোট মাছের শুঁটকি ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এখান থেকে প্রাপ্ত সাদা মাছ বরগুনা, পাথরঘাটা, মহিপুর, কুয়াকাটাসহ দেশের বিভিন্ন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এছাড়া, এখানকার শুঁটকিপল্লীর শুকনো মাছের গুঁড়ি দেশের পোলট্রি ফার্ম ও ফিশ ফিডের জন্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
ব্যবসায়ী আবু জাফর জানান, শীতের সময়েই সবচেয়ে বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয়। আমরা সরকারকে প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব দেই। কিন্তু, প্রধান সড়ক থেকে শুঁটকিপল্লী পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তা খুবই খারাপ। ট্রাক আসতে না পারায় পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। আমরা চাই সরকারিভাবে শুঁটকি রপ্তানির ব্যবস্থা হোক।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলা মৌসুমে বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকরা পরিবারসহ বরগুনার তালতলীতে কাজ করতে আসেন। স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে উপজেলার আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গা ও ফকিরহাটসহ আরো কয়েকটি এলাকায় শুঁটকি উৎপাদনের কাজ করেন তারা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা শ্রমিকদের অস্থায়ী ছোট-ছোট ঘর তৈরি করে থাকতে হয় এখানে। তবে থাকা-খাওয়াসহ পল্লীতে পয়ঃনিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এখানকার শ্রমিকদের। বিশেষ করে স্থায়ী কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় বেশি বিপাকে পড়েছেন নারী শ্রমিকরা।
শুঁটকিপল্লীতে প্রায় দুই যুগ ধরে কাজ করছেন কুলসুম বেগম। তিনি বলেন, আমরা নারী-পুরুষ এখানে সমানভাবে কাজ করলেও নারীদের জন্য বিশেষ প্রয়োজনে কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। পুরুষরা তাদের প্রয়োজনে যে কোনো জায়গায় যেতে পারে কিন্তু আমরা নারীরা তা পারি না। টিউবওয়েলসহ এখানে যদি স্থায়ীভাবে টয়লেট নির্মাণ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়।
তালাতলী উপজেলার শুঁটকি সমৃদ্ধ সোনাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরাজি মো. ইউনুছ আমার দেশকে বলেন, এক সময়ে সপ্তাহে এখানকার প্রতিটি পল্লী থেকে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ মণ শুঁটকি দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হতো। প্রায় ১০ হাজার জেলে ও প্রক্রিয়াজাত শ্রমিকসহ তিন থেকে চার লাখ মানুষের জীবন–জীবিকা জড়িত ছিল এ শিল্পের সঙ্গে। কিন্তু, বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এখানের অপরিশোধিত বর্জ্য সাগরের পানি দূষিত করছে এবং এতে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। মাছের উৎপাদন কমে গেলে সঙ্গত কারণেই ব্যবসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরো জানান, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি অচিরেই বিলুপ্ত হতে পারে। তাই সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় এ খাতটিকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, মাত্র দু’সপ্তাহ হলো আমি বরগুনায় যোগদান করেছি। আমি শুনেছি, এখানকার বিভিন্ন শুঁটকিপল্লীতে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত।
তিনি বলেন, খোঁজ নিয়ে জানলাম, বর্তমানে নানা কারণে শিল্পটির কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। অচিরেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। জেলে ও ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে তালতলীর ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেবক মণ্ডল আমার দেশকে জানান, এখানকার শুঁটকি শিল্পটি দেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত। এটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি জানান, এখানে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো আমলে নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত কাজ করা হচ্ছে।